LATEST$type=ticker$count=12$cols=4$cate=0

$type=grid$count=4$tbg=rainbow$meta=0$snip=0$rm=0$show=home

আমার কবিতার সঙ্কলন | My Poetry Collection

আমার কবিতার সঙ্কলন | My Poetry Collection
এখানে ক্লিক করে কবিতাগুলো ডাউনলোড করুন APK ফরমেটে। 

রক্তে ভেজা মাটি, কান্নার নদী


আমি পলাশপুরের অঞ্জলি,
ছেঁড়ে আইছি সেই গেরাম থাইক্যা,
যেখানে পাখির গান হুনতাম,
নদীর ঢেউয়ের নাচন দেখতাম।
বাপ-দাদার ভিটা আছিল—
পদ্মাপাড়ের নরম মাটিত—
এহন এই কারখানার ঘিনঘিনে আওয়াজ—
আমার কানের পোকা।

মেশিনের ক্যাঁচক্যাঁচানি—
লোহা পিটুনির শব্দ—
সব মিশ্যা এক দমবন্ধ করা চ্যাঁচানি।
আর বুকের ভিতরে জমাট বান্ধা কান্দনের ঢেউ—
যেন কেউ গলা টিপ্পা ধইরা রাখছে।

কাগজওয়ালারা মিছা কথা কয়—
বড় বড় কথা কয়—
কয়—
দেশ নাকি আকাশ ছুঁইছে।
টিভিওয়ালারা হাসে—
রংচং মাখা মুখ দিয়া—
ফালতু গল্প দেয়—
নতুন দিনের স্বপন দেখায়।

কিন্তু আমার চোখে তো শুধু জমাট বান্ধা আঁন্ধার—
যেন শ্রাবণের মেঘে ঢাকা অমাবস্যার রাইত।
সেই রাইতের লাহান কালো—
যে রাইতে কিছু দেখা যায় না—
শুধু ভয়—
আর অজানা ডর ঘোরে।

এলাকার মাতব্বররা—
ছোট নেতারা—
সব মিশ্যা চ্যাঁচায়—
ক্ষমতার গরম দেখায়—
তাদের খ্যাঁখ্যাঁনিতে—
আমার ছোট্ট কুঁড়েঘরডাও কাঁপে।
আমাদের বস্তিত শুধু ডর—
আর ফিসফিসানি—
যেন মরণের ঠান্ডা নিশ্বাস ঘোরে—
আঁন্ধারে হাত বাড়ালেই ধরা যায়।

সকালে যখন কারখানার বড়বাবু আসে—
ভাঙা গেটটা ক্যাঁচক্যাঁচ কইরা খোলে—
পুরোনো লোহার কান্দনের লাহান—
তখন আমার কলিজা কাঁপে—
পেটের দায়ে তবুও দৌড়াই।

যদি এই কামডাও যায়—
এই মেশিনের পাশে বসনের অধিকারডাও কেড়ে নেয়—
তাইলে খামু কী?
কনে যামু আমি?
এই শহরে তো আমার কেউ নাই—
যেন পায়ের তলার মাটিও সইরা যাইতাছে।

মনে লয়—
দম বন্ধ হইয়া আইতাছে আমার—
আর নিশ্বাস লইতে পারছি না।

এই দেশটা কি তাইলে...
আমার লাহান গরিব মাইনষের লাইগ্যা নরক হইয়া গেল?


এই দেশটা এহন খারাপ মাইনষের হাতে—
যেন ডাকাতের পাল্লায় পড়ছে গেরাম।
যা খুশি তাই করে—
কেউ কিছু কইতে সাহস পায় না—
মুখ খুললেই বিপদ।

মোবারকের দল ঘোরে—
হাতে লাঠি—
মুখে গাইল—
চোখে আগুনের ঝিলিক।
হিন্দু দেখলেই তেড়ে আসে—
যেন আমরা মানুষ না—
অন্য কিছু।

বাপ আমার ডরে কাঁপে—
প্রতি রাইতে ঘুম আসে না চোখে—
শুধু জাগা থাকে—
আর ভগবানের নাম জপে।

একটু ভুল হইলেই মার—
ধর—
নির্যাতন—
নাম দেয় ওরা—
রাজনৈতিক ঝামেলা—
যেন মারধর—
আর রক্তপাতই—
এহনকার রাজনীতি।

আমাদের আজাদির—
যা কিছু আছিল—
যা কিছু সুন্দর আছিল—
সব ভাইঙ্গা চুরমার কইরা দিছে—
যেন শিকড় উপড়াইয়া ফালাইছে—
আমাদের পরিচয়।

এহন এই দেশ পরাধীন—
এক নতুন কইরা বন্দি হইছি আমরা—
দেখা না যাওয়া শিকলে বান্ধা।

চারিদিকে শুধু ভন্ডামির গন্ধ—
ধর্মের নামে পচা বাতাস—
যেন নিশ্বাস লইতেও কষ্ট হয়—
দম আটকাইয়া আসে।

মনে লয়—
এই বাতাস আর বেশি দিন বইলে—
আমরা আর বাঁচুম না।


হিন্দু মাইয়াগো এহন—
বোরখা ছাড়া চলনের উপায় নাই—
যেন নিজের পরিচয় লুকানোই বাঁচন—
না লুকাইলে—
ইজ্জতও বাঁচানো কঠিন।

এক কেমন নিয়ম চলতাছে—
মুখে কেউ কয় না—
কিন্তু চোখের দেখায়—
কাজের চোটে সবাই জানে।

মাইয়ারা সব ঘরে বন্দি—
যেন আকাশ দেখনেরও অধিকার নাই—
দিনের আলোয় বাইর হইলেই ভয় লাগে।

ধর্ষণের বন্যা বইতাছে এই দেশে—
যেন নদীর পানি বাড়তাছে তো বাড়তাছেই—
থামার আর নাম নাই।

কে রাখে হিসাব?
কার কাছে বিচার চাই?
থানায় গেলে উল্টা দোষ দেয় আমাগোরে—
কয়—
সব নাকি আমাগোই ভুল।

অঞ্জলি আমি—
শুধু একটু শান্তিতে নিশ্বাস লইতে চাই—
একটু নিজের লাহান বাঁচতে চাই।

আমার জনম এই সবুজ বাংলায়—
পলাশপুর গেরামে—
শান্ত নদীর ধারে—
যেখানে ডিঙি নাও চলতো—
আর মাছ ধরা পড়তো।

গার্মেন্টসে কাম করি—
সারা দিন মেশিনের ঘড়ঘড়ানিতে—
মাথা ঘোরে—
হাত ব্যথা করে—
তবুও কামাই করি।

কখন যে কাম বন্ধ হইয়া যায়—
মালিকের মন কখন খারাপ হয়—
সেই ডরে তটস্থ থাকি—
যেন এক সুতার উপরে ঝুইল্যা আছি।


সামনে শুধু আঁন্ধার—
যেন পথ নাই—
দিশা নাই—
শুধু এক গভীর খাদ।

মনে লয়—
আমার দেশটা ধীরে ধীরে মরতাছে—
যেন কেউ বিষ খাওয়াইছে—
আর আমরা সবাই—
সেই বিষের জ্বালায় ছটফট করতাছি।

আর আমিও তার সাথে ডুবতাছি—
যেন এক পাথর বান্ধা পায়ে—
টানতাছে গভীর জলের তলে।

কারখানার বাঁশি যখন বাজে—
ভোরে আর দুপুরে—
মনে লয়—
ওটা যেন আমার শেষ বিদায়ের ডাক—
কেউ যেন আমার নাম ধইরা ডাকতাছে।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ ঘোরে—
বন্দুক হাতে—
তাদের চোখে সন্দেহ—
আর রাগ—
যেন আমরা সবাই—
চোর ডাকাত।

কেউ হাসে না মন খুইলা—
কেউ কথা কয় না শান্তিতে—
যেন সবার মুখে তালা মারা—
বুকের ভিতরে ভয়।

নিঝুম রাইতে শুধু কান্দনের আওয়াজ ভাসে—
অসহায় মাইনষের চ্যাঁচানি—
আর কুকুরের করুন ডাক—
যেন তারাও জানে—
কিছু খারাপ ঘটতাছে।

আমার মনে লয়—
এই মাটি অভিশাপের বোঝা বইতাছে—
এই মাটিতে আর শান্তি নাই।


আমার মনে স্পষ্ট আছে—
ছোটবেলায় বাপের কাঁধে চড়ে—
বৈশাখী মেলায় যাইতাম—
কত না রংবেরঙের জিনিস দেখতাম—
কত হাসি—
কত আনন্দ আছিল সেই মেলায়।

মা তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালাতো সন্ধ্যায়—
আর বড়দা পুকুরে ডুব দিয়া—
আনতো শাপলা ফুল—
সেই শাপলা দিয়া মা—
কত সুন্দর মালা গাঁথতো।

তখন আকাশটা কত পরিষ্কার আছিল—
মেঘ ছাড়া নীল আকাশ—
আর বাতাস কত ঠান্ডা—
যেন প্রাণ জুড়াইয়া দিত।

এহন সব মনে লয় ধোঁয়া ধোঁয়া—
যেন পুরানো দিনের গল্প—
রূপকথার লাহান।

কারখানার ধুলো—
আর কষ্টের দাগ আমার মনে—
আমার স্বপনে।

মনে লয়—
সেই সুখের দিন—
আর কোনোদিন ফিরব না—
যেন কেউ চুরি কইরা নিয়া গেছে সব।

এই দেশটা যেন পোড়া বাড়ি—
যেখানে আগুন লাগছিল—
আর এহন শুধু ছাই—
আর ভাঙা ইট পইড়া আছে—
আর সেই পোড়া গন্ধ—
আমার নাকে লাগে।


আমার বুকের ভিতরে শুধু কষ্ট—
যেন পাথর চাপা দিছে কেউ—
আর সেই পাথরটা—
ধীরে ধীরে আমার কলিজাটা—
ছিঁড়ে খাইতাছে।

চোখের পানি শুকাইয়া গেছে—
কান্দতে কান্দতে—
আর পানি নাই চোখে—
শুধু একটা শুকনো—
কাঠ ফাটা কান্দন জমা আছে।

আর কান্দনেরও যেন শক্তি নাই—
শরীর অবশ হইয়া গেছে।
শুধু একটা খালি খালি ভাব—
যেন সব কিছু কেড়ে নিছে—
আর ভিতরে কিছু নাই।

মনে লয়—
আমি যেন মরা মানুষ—
যার কোনো আশা নাই—
কোনো ভরসা নাই—
শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস—
বুকের ভিতরে ঘোরে।

আমার দেশটা মনে লয়—
নিজের হাতে—
নিজের গলা টিপ্পা মারতাছে—
ধীরে ধীরে শ্বাস বন্ধ কইরা দিতাছে।

আর আমিও তার সাথে—
তলিয়ে যাইতাছি আঁন্ধারে—
যেন একটা গভীর গর্তে পইড়া যাইতাছি—
আর কেউ হাত ধইরা তোলার নাই।
[next]

ভস্মীভূত ভালোবাসার পদাবলী

আজ আমি কালের তরে লিখছি।
শ্মশানঘাটের চিতার ভস্মমাখা নীরব আঁধারে দাঁড়াইয়া আমি কহিলাম,
‘যা কিছু পুড়ে ছাই হয়, তারও কি কোনো অলীক স্মৃতি র’য়ে যায়?’
তুমি কহিলে, ‘মোহ ও মায়া।’
দূরে শঙ্খধ্বনির করুণ গুঞ্জন।
কালচক্র ধেয়ে আসে।
আমার তো তবে পৌঁছাতেই হবে সেই অনন্তের তীরে। শীঘ্র করি।
তারপরে বিলীন হতে হবে ধীরে,
চলে যেতে হবে সকল বন্ধন ছাড়ি অন্য অভিমুখে।
আমি তাই ভস্মতলে দাঁড়াইয়া লিখছি,
‘তোমা লাগি মোহ রাখি, মায়া ধরি চলিলাম নির্বাণ-ধামে।’
শ্মশান-আঁধারে আমার সত্তা তখন কাঁপে।
আর তুমি কহিতেছ, ‘ও কম্পন নহে, এ তো আত্মদহন।’
– দহন কেন তবে?
– কারণ মোহশূন্য আত্মা জানে কতটা সে একা আর অসত্য!
– কিন্তু তুমি?
আমি বিস্ময়ে দেখিলাম, কোথাও তুমি আর নাই।
অথচ তোমার মায়া মিশে র’য়ে গেল মোহের গভীরে।
সেই ক্ষণে প্রথম আমার মনে জাগিল,
‘এই সংসারে কত কত রূপ, অথচ সকলই অস্পষ্ট আমার নয়নে।
কিন্তু এই তুমি কী ভীষণ সত্য!’
আমি চলিতে উদ্যত হইয়াও তাই মোহ ধরিলাম মায়ার বন্ধনে।
কারণ আমি তো বরবাদ হতেই ভালোবেসেছি, এ জন্মের তরে নয়।

দিনের পর দিন

এই যে দিনের আলো নিভে যায় ধীরে,
তবু প্রেম ছাড়া বাঁচে কিসে এ হিয়া?
যদি রুষ্ট হয় কাল, না আঁকে ললাটে নবোদিত রবি?
যদি শুকায় অধর, বিরহের ছবি!
যদি রক্তাম্বর তার রক্তিমতা ভোলে, উড়ে যায় দেবদারু শ্বাস,
যদি চিত্ত হয় হিমালয় শিখর, অনন্ত তুষারে উদাস।
আমি দূরে গেলে কোন দেবালয়ে প্রণতি জানাবে ব্যাকুল,
কে মিশে রবে ছায়ার গভীরে, তোমাতে অতল!
এই যে পশ্চাৎপসরণ ক্লান্তি লয়ে, একবার চাও?
রুদ্ধশ্বাসে কও, রও? তোমা বিনু অন্য গতি নাহি কোথাও!
হৃদয়ের গ্রন্থ যদি রিক্ত রহে, শূন্য রহে প্রাণ,
আমা ভিন্ন তুমি, তোমার নয়নতারা, রবে কতোকাল অম্লান?
তবে ফেরাও এবার, ওগো অনন্তের নারী,
আমাতেই ধ্রুব তুমি, আমাতেই বিহারী।
তবে পুনশ্চ কামনা জাগুক,
জঠরে জঠরে জন্ম নিক অনন্ত পিপাসার সিন্ধু,
তোমার ঐ জ্যোতির্ময় বিন্দু।

বিষবৃক্ষের চাষ

ধরণির কোলে আজ বিষেরই ফসল ফলে,
হিংসার বীজ বোনা প্রতিক্ষণে চলে।
বিষাক্ত বাতাস বহে দিগ্বিদিক হতে,
অশান্ত স্রোতে।
কলুষিত মন আজ বিষে জর্জরিত,
স্নেহ প্রেম তিরোহিত।
মানবের মাঝে নাই প্রেমেরই প্রকাশ,
ঘৃণারই উল্লাস,
অন্ধকারে নিমজ্জিত ধরার আকাশ,
নিদারুণ ত্রাস।

চিত্ত হতে চিত্তান্তরে বিদ্বেষের বহ্নি জ্বলে,
দগ্ধ করে মানবতারে,
অবিশ্বাসের কালিমায় ঢেকে দেয় তারুণ্যের কূলে,
নিষ্ঠুর অত্যাচারে।
নিষ্ঠুরতার বিষাণ বাজে আজি,
মানবতা কাঁদে নীরবে সাজি।
অশান্তির মেঘ জমেছে গগনে,
অশ্রুবারি ঝরে ধরাতলে অনুক্ষণে।

দেশের কথা

তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম সেদিন
যখন আমাদের স্বপ্নের নৌকাটি ডুবে গেল গভীর জলে
সবাই বলল এটা নাকি মুক্তির লড়াই
কিন্তু আমি দেখেছি শুধু রক্তের দাগ আর ধ্বংসের খেলা
দেখেছি কেমন করে স্বপ্নগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

শাসকেরা ছিল, বলা হলো, দুর্নীতিপরায়ণ
কিন্তু যারা এল তাদের নিয়ে, তারাও ছিল
উইপোকার মতো, খেয়ে ফেলল দেশের ভিত
বিপ্লব ছিল অস্ত্রোপচারের মতো, কিন্তু
চিকিৎসকদের হাতেই ছিল মৃত্যুর ছুরি।

স্বাধীনতার নায়কদের বলা হলো দেশপ্রেমিক
কিন্তু আমি দেখেছি তাদের শকুনের চোখ
ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে যারা ভুলে গেল
মানুষের কথা, দেশের কথা, স্বপ্নের কথা
এখন শুধু অন্ধকার গুহায় হাতড়ে বেড়াই।

ধর্মের নামে বিভেদ এখন গভীর থেকে গভীরতর
সংখ্যালঘুরা ভয়ে ভয়ে বেঁচে আছে
অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা পাখির মতো
স্বাধীনতা পেয়ে হারিয়ে ফেললাম স্বাধীনতা
নতুন শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ল দেশের আত্মা।

আজ রাতে আমি লিখছি এই কবিতা
যখন শহরের আলোগুলো একে একে নিভে যায়
ভাবছি কতটা পথ আমাদের হাঁটতে হবে
যতদিন না ফিরে পাই সেই হারানো স্বপ্নগুলো
যেগুলো ছিল আমাদের প্রথম প্রতিশ্রুতি।

অসহায় আর্তনাদ

হে বন্ধু, আজি এ দেশে,
অনাচারে, ক্লেশে,
কী দেখি এ ঘোর রূপ।
বিদীর্ণ এ হৃদয় কূপ?
শান্তির নীড় যেথা, ধর্মের মিলন,
সেথায় কেন এ হিংসার সমর ভীষণ;
অসহ্য এ তাপ,
নিদারুণ অভিশাপ।

হে ভ্রাতা, কী শুনি আজি এ ক্রন্দন ধ্বনি,
অসহায় নরনারী, আকুলিত বাণী।
কী দেখি এ ঘোর ত্রাস,
অমানবিক প্রয়াস।
গৌরবের চিহ্ন যেথা, শ্রদ্ধার আসন,
সেথায় কেন এ পশুর মতন;
অসহ্য এ চাপ,
নিদারুণ পরিমাপ।

কী মোর শকতি আছে এ দৃশ্য যে হেরিব আমি হায়,
হোক মন্দির, হোক দেবালয়,
শুধু ভয়, শুধু ত্রাহি ত্রাহি রব,
কেন এ নিষ্ঠুর উৎসব,
একদিন যবে,
নিশ্চিত থামিবে এ অন্যায় সবে।
নিজ হাতে তব যাহা গড়ি তুলেছিলে,
তাহা কেন ভাঙিয়া দিলে,
অবিচারে,
অনাচারে,
কেন এত ঘৃণা, কেন এত অহংকার তরে।

তার চেয়ে যবে,
অন্ধকার নিশি হবে,
নীরব রজনি আসিবে যখন,
নিভে যাবে সব কোলাহল তখন,
অজানা বেদনায় হৃদয় উঠিবে ভরি,
নীরবে অশ্রুবারি,
পথহারা সেই ব্যথা,
রবে চিরদিন গাঁথা।
যেতে যেতে জীবনের পথে,
অসহায় আর্তনাদ রবে সাথে,
দেখিবে সহসা—
মানবিকতার ক্ষীণ আশা,
একটি করুণ সুর কাঁপি থরথরে,
ছোঁয় শুধু বেদনার গভীরে,
সেই সুর, অজানা সে বেদনা,
সেই তো শুধু রবে চেতনা।

আমার যা শ্রেষ্ঠ ছিল, সে তো শুধু বিশ্বাস, প্রেম,
মানবতার অমর হেম।
বলে না আপন নাম, শুধু নীরবে কাঁদে,
অসহায় আর্তনাদে।
সেথা পথ নাহি জানি,
সেথা নাহি যায় হাত, নাহি যায় বাণী।
ভ্রাতা, তুমি সেথা হতে আপন অন্তরে,
অনুভব করো ধীরে,
না-চাহিতে না-জানিতে সেই বেদনা,
সেই তো শুধু রবে চেতনা।
আমি যাহা দিতে পারি সামান্য সে বাণী—
হোক ক্ষমা, হোক শুধু শান্তিখানি।

সত্য বলি, অন্য কিছু নয়

সত্য কহি, অন্য কিছু কব না।
হে রাজন, ধর্মপাল,
যে ভোজনশালাগুলি গোহত্যা বর্জিত,
তাহাদের উপর ক্রোধ কেন এত?
ইহা সত্য যে, এই বঙ্গদেশে কিছু
ধর্মন্মত্ত উন্মত্ততা সৃষ্টি করে।
আমাদের শাস্ত্রে অহিংসা পরম ধর্ম,
তবু কেন এই হিংস্র আস্ফালন?
হে রাজন, ধর্মপাল,
'আস্ফালন' অর্থ বলা কঠিন,
সহজ করিয়া যদি বলিতে হয়,
তবে বলিব—এ শক্তি-প্রদর্শন।
যাহা হউক, আশা ছিল সহাবস্থান
সকলের হৃদয়ে স্থান পাইবে,
প্রতিদিন প্রভাতে নবীন আলোকে
শান্তি ও প্রীতির বার্তা ধ্বনিবে।
কিন্তু তাহা হইতেছে কই?
আমি শুধু আতঙ্কের ছায়া দেখি,
নীরবে অশ্রুবারি শুধু ফেলি।
হে রাজন, ধর্মপাল,
এই অপেক্ষা কঠিন সময়
আমাদের আর কখনো আসে নাই।

নির্যাতনের প্রতিসরণ

ছিলাম সহমর্মিতার শান্ত ছায়াতলে একাত্ম।
কয়েক মুহূর্ত শুধু, তবু এখনো সেই একাত্মতার স্পন্দন
এখনো ভোলা গেল না।
সেই যে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠ, ভীত নয়নে আর্তনাদ,
সহ্য করা অত্যাচারের গ্লানি,
ক্ষমতার আস্ফালনে মিথ্যার বেসাতি, দালালের আস্ফালন,
কয়েকটি কণ্ঠ শুধু, কয়েকটি মুহূর্ত, মিথ্যে সান্ত্বনার প্রলেপ,
"নির্যাতন নেই" এই ঘোষণার নির্লজ্জ আস্ফালন,
গোবিন্দর হেঁশেল বন্ধ, "গোরুর মাংস নেই" এই অজুহাতে,
সেই আমার একাত্মতার শান্ত প্রতিচ্ছবি,
সেই আমার সহমর্মিতার শান্ত প্রতিচ্ছবি,
কয়েক মুহূর্ত শুধু, তবু এখনো সেই একাত্মতার স্পন্দন,
কয়েক মুহূর্ত শুধু, তবু এখনো সেই সহমর্মিতার স্পন্দন,
এখনো ভোলা গেল না।

ব্যথিত হব না

আমি আর ব্যথিত হব না,
কোনো স্মৃতিতেই আমি শুধু আর ব্যথিত হব না।
যে বৃক্ষ প্রাণের স্পন্দে উড়াতো বিহঙ্গ
এখন ঝঞ্ঝায় সেই বৃক্ষের শাখায়
ফাঁসির নীরবতা দেখে আমি ব্যথিত হব না।
সোনালি ধানের ক্ষেত চিরে চিরে
কৃষকের লাঙলের ফলায় গড়া উর্বর মাটির বুকে
আজ সেই ক্ষুধার্ত মানুষের কঙ্কাল দেখে
ব্যথিত হব না, আর শুধু ব্যথিত হব না।
শিক্ষক হারালে তার জ্ঞানের প্রদীপ, সমাজের ফুরালে বিশ্বাস,
দুর্নীতির প্রাসাদ হলে পবিত্র শিক্ষালয়, আমি ব্যথিত হব না।
শিশু যদি না হাসে প্রাণখুলে, না ফোটে কুসুম,
অদ্ভুত নিস্তব্ধ হলে কোকিলের কুহুতান, আমি ব্যথিত হব না।
মানুষ না চেনে যদি আপন সত্তা,
আমি ব্যথিত হব না, ব্যথিত হব না।
প্রতিবিম্বের কসম খেলাম আমি মুক্তি খুঁজব অন্তিমকালে,
এবার নিশ্চিহ্ন হব,
ওসবের কোনো কিছুতেই তবু শুধু আর ব্যথিত হব না।

অগ্নিঝরা দিন

জ্বলছে দেশ, পুড়ছে ঘর,
           ক্ষুধার জ্বালা বাড়ছে রে,
হানাদারদের ঐ প্রাসাদ
           ভেঙে দিতে আজ আসছে কে?

উঠুক তুফান, জাগুক প্রাণ,
           হুঙ্কার দাও সজোরে,
তাদের ঐ বৈভবেতে
           আগুন লাগাও ক্রোধভরে।

যাদের ঘরে অন্ন নেই,
           তাদের কান্না থামে না যে,
তাদের রক্তে ভেজা মাটি
           আজ প্রতিশোধ চায় শুধু যে।

আসুক প্রলয়, ভাঙুক ভয়,
           নতুন দিনের আহ্বানে,
জ্বলন্ত মশাল হাতে নিয়ে
           চলছি মোরা বিজয়রথে।

অগ্নিঝরা এই দিনে
           হানাদার হবে ছাই,
নতুন সূর্য উঠবে ঐ
           মুক্ত হবে দেশ তাই।

ফ্যাসিবাদী ফতোয়া

মুখটি বাঁকানো, দাঁত খিঁচোনো, বুড়ো এক জন,
মিটিং-এ হাঁকেন, "মোরা শুধু শুদ্ধ জন।"
মাথাটি নাড়ে, ফতোয়া ছাড়ে, গম্ভীর চালে কয়,
"আমরাই পণ্ডিত, আর কেহ পণ্ডিত নয়।"
বকবক করে শুধু, সবই যেন ফাঁকা সার,
"অমিল যে কয়, ফ্যাসিবাদী," দেয় শুধু ধিক্কার।
ভ্রুকুটি জ্বলে যেন জ্বলন্ত অঙ্গার,
রেগে বলে, "কে বুঝিবে এ সব তত্ত্বের পার?"
আরে বোকা, ওরে গাধা, চক্ষু তো তার অন্ধ,
কেবলই সে করে শুধু কুতর্ক আর দ্বন্দ্ব।
কোন্ পথে দেশ যায়, বোঝে না সে কিছুই হায়,
"অন্য দল এলেই ঘোর কলিকাল ধায়।"

চারিদিকে শুধু পোস্টার, মিথ্যারই বিস্তার,
"আমরাই সেরা," এই হাঁক, প্রচার শুধু অপার।
কোন্ বক্তা মিথ্যা কয়, কোনটা বা কয় খাঁটি,
কোন্ কথায় ভেজাল মেশে, অর্থ তার কেমন আঁটি।
হাঁকে সে মাইকে, "ঠকাঠক ঠক", ফাটে যেন তার স্বর,
"কোন্ চালে কে জব্দ হবে," এই তার বুলি নিরন্তর।
খুঁটিনাটি খবর আমি জানি ঠিকঠাক,
কেমন বিষ কার মুখে, কিসে হয় গোলপাক।
কেবা শান্ত, কেবা ভ্রান্ত, কেবা শুধু ম্রিয়মাণ,
কেবা জীবন্ত, সদা চঞ্চল, কেবা শক্তিমান।
জ্ঞান-অজ্ঞানের তর্ক করি, সত্য কোথা লুকায়,
মিথ্যে ফতোয়া দেয় যে, সে তো মিথ্যেতেই ডুব দেয়।

জন্মভূমির কান্না

কান্না ভেজা ব্যথিত হৃদয়, আয়রে সবে আয়,
দুঃখ ভরা গানের সুরে শোক জানাই আয়।
কাতর প্রাণে ভগ্ন মনে, নীরব বাঁশি বাজে,
হারানো সুর স্মৃতির মাঝে ফরিয়াদ শুধু খোঁজে।

স্মৃতির গানে হারানো দিনে, করুণ সুর ভাসে,
গভীর ব্যথা হৃদয়ে গাঁথা, মন কাঁদে দূর দেশে।
ব্যথিত মন, ঘুচাও বাঁধন, "হায় স্বদেশ" বলি,
অভাগা যারা, ভাগ্যহারা, নিয়তি বাঁধা চলি।

বেদনা ভরা, অশ্রু ঝরা, মাতম রঙ্গে কাঁদি,
শোকের ভবে, অশ্রু ছন্দে, শোকের গান বাঁধি।

মায়াবী প্রবঞ্চনা

প্রয়োজন বাঁধা হৃদয়,
সহজ বিশ্বাসে মগ্ন মন,
প্রতারক খোঁজে শুধু সেই ক্ষণ।

আমি একা নই,
প্রয়োজনই এখানে ঈশ্বর,
কাছে টানে মায়াজাল বিস্তার।

প্রয়োজনের তীব্রতা, যেন দৈববাণী, বুঝেছি আমি,
কাছাকাছি এলেই দেখি, সত্য দূরে, শুধু ছলনা,
সম্পর্ক গড়া যেন কঠিন এক প্রহেলিকা।

প্রয়োজনই এখানে নিয়ন্তা,
তাই দূরে, এক মায়াবী কুয়াশায়,
–লুকানো থাকে প্রবঞ্চনা,
আমাদের সরলতাকে গ্রাস করে।

কালের গহ্বরে

শুনিলাম আমি, হে বন্ধু, কালের গহ্বরে দাঁড়াইয়া,
জিজ্ঞাসিলে তুমি, কোন পরিচয়ে এই দেশে আছি বাঁচিয়া?
আমি কি তবে বহিরাগত?
তবে কি এই মাটি, এই জল, এই আকাশ নহে আমার মতো?

শোনো বন্ধু, ইতিহাস খুঁড়িয়া দেখো না কি পাইবে,
এই দেশে মোরা চিরদিন, এই মাটিতেই শিকড় ছড়াইবে।
বখতিয়ারের আগে,
আসিয়াছি মোরা এই দেশে, আপন কর্ম্মে, আপন ভাগে।

আদিবাসী? সে তো বহু দূরের কথা, বহু পুরাতন,
পাহাড়ের কোলে, অরণ্যে, নদীতে, বাস তাদের, অনন্তকাল ধরে, আপন ভুবন।
চাকমা, মারমা, সাঁওতাল,
ওঁরাও, মুন্ডা, আরও কত নাম, তাহারা আদিম, এই ধরায় তারা অনন্তকাল।

মোরা তো এই কালের স্রোতে, বহু রূপে, বহু বর্ণে মিশেছি,
এই মাটি, এই সংস্কৃতি, এই ভাষাতেই গড়িয়া উঠিয়াছি।
তবে কেন এই বিভেদ?
তবে কেন এই পরিচয়, যাহা শুধু কালের খেদ?

আমি পাহাড়ি নৃগোষ্ঠী, আমি আদিবাসী, আমি এই দেশের সন্তান,
এই পরিচয়ই আমার, ইহাতেই আমার গান।
নয় কালের গহ্বরে,
আমি বাঁচিতে চাই এই মাটিতে, এই পরিচয়ে, অনন্তকাল ধরে।

আমি সব গোপনে রাখি

প্রতিটি প্রতিশ্রুতি আমি খুব সাবধানে রাখি।
কলেজের সেই দিনগুলি, যখন তোমায় প্রথম দেখি।
ক্লাসরুম থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে।
আমি লাজুক চোখে তোমায় দেখি পাশে।

সাদা রঙের নোটবুক থেকে চিঠি লিখি তোমায়।
অধ্যাপক ছবি আঁকছেন ব্ল্যাকবোর্ডে সামনায়।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কিছুই জানে না।
কারণ আমি সব গোপনে রাখি তা।

লাইব্রেরির টেবিল থেকে বই তুলে নিলাম,
আর চোখের ইশারায় তোমায় ডেকে নিলাম।
বই গুছিয়ে ফের তা শেল্ফে রেখে এলাম,
হ্যাঁ, চিঠিটাও তোমার হাতে তুলে দিলাম।

ক্যাফেটেরিয়ায় দেখা হল, তুমি চা খাচ্ছ।
কেউ কিছু বুঝতে পারে নি।
কারণ আমি সব গোপনে রাখি।

তোমায় জিজ্ঞেস করলাম: ভবিষ্যতে কী করবে?
তুমি: অন্য শহরে চাকরি, কিন্তু ভালোবাসা থাকবে।
আমি আবার ক্লাসে গেলাম, খাতা খুলতে গিয়ে একটু শব্দ হলো।
তেমন কিছু নয় অবশ্যি।

দূরের শহরে যাওয়ার সময় অবশ্য কোনো কথা বলি নি।
টেলিফোনে কথা বলে দিন কেটে যায় একে একে।
প্রতিশ্রুতি ভেঙে গেল, তুমি চলে গেলে অন্য কারো কাছে।

এখন পর্যন্ত কেউ আমার ব্যথা বুঝতে পারে নি,
কারণ আমি সব অন্তরে রাখি।

বছর ঘুরে এসে বললে: ফিরে এসেছি, ক্ষমা করো।
আমি: যাই হোক, জীবনের পথ তো এমনি!
তুমি: কী বলছ! এখনো কি আমায় ভালোবাসো?

আমি (ভুলেই গেছিলাম তোমার নতুন জীবন): তা ঠিক,
সুযোগ বুঝে ফের হৃদয় খুলে ফেললাম।
প্রেম আবার নতুন করে জেগে উঠল।

অতীতের স্মৃতি দেখি জোরে জোরে কাঁদে।
ভালোবাসা নতুন করে শুরু হলো, প্রতিশ্রুতি নতুন করে বাঁধা হলো।
তুমি কী করছ দেখি - হ্যাঁ, নতুন সংসার সাজাচ্ছ।

কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের রহস্য জানে না,
কারণ আমি সব প্রতিশ্রুতি সযত্নে রাখি।

আমি তোমায়: তুমি কি সুখী এখন?
তুমি: থামো তো, জীবনটা এখন থেকে শুধু তোমার সঙ্গে।

আমি স্মৃতি থেকে সব ব্যথা মুছে নতুন করে শুরু করলাম।
ভালোবাসা আবার নতুন করে জাগল।
অতীত এখন মিলিয়ে গেছে।
ভবিষ্যত হাতছানি দিচ্ছে।

কিন্তু এখনো কেউ বুঝতে পারে না
কত গভীর এই ভালোবাসা।

তোমায় হাসতে হাসতে বললাম: এবার আর ছেড়ে যাবে না তো?
তুমি: শোনো, এবার থেকে শুধু তোমার সঙ্গেই থাকব!

আমি তোমার পাশে বসে নীরবে কাঁদলাম।
কিন্তু এখন অবধি কেউ জানে না
কত গভীর এই প্রতিশ্রুতি।

ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।
আর আমি? আমি নতুন করে তোমায় ভালোবেসে চলেছি।

অপসারিত নামের অভিশাপ

কালো রাতের অন্ধকারে
নাম মুছে দিলো কারা?
জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ -
অমর হয়েও হারিয়ে গেল
বিজ্ঞানের এই দিশারী তারা।

সাইনবোর্ডে কালির দাগ
ইতিহাসের পাতায় ক্ষত,
জীবনানন্দের ভেজা চোখে
বৃষ্টির ধারা বয়ে যায়
আর ডাঃ আলীম চৌধুরী
শহিদ হলেন দ্বিতীয়বার।

একটি-একটি করে খুঁচিয়ে
শিকড় উপড়ে ফেলা হলো,
যুক্তির আলো নিভে গেল
মঞ্চে শুধু কর্তাদের
ভীত সুরে অস্বীকার।

কেউ বলে, "আমি শুধু প্রস্তাব দিয়েছি!"
কেউ বলে, "আমি শুধু অনুমোদন করেছি!"
কেউ বলে, "দায় শুধু আমার নয়!"
ভারদ্বাজ পাখির মতো
বালিতে মুখ লুকিয়ে
ভাবে, বিপদ এড়িয়ে গেল।

খুলনার বুকে কান পেতে শুনি -
মনীষীদের অস্তিত্ব মুছে
ভবনগুলো কাঁদে নীরবে,
"একাডেমিক ভবন-১, ২, ৩"
নামহীন, পরিচয়হীন,
যেন বন্দিশালার কক্ষ নম্বর।

আঙুল তুলে যারা বলেছিল
"পলিটিক্যালি বায়াসড" নাম বদলাও,
তারাই আজ হতবাক -
"মাথাব্যথা করতেছে, তাই
মাথাটাই কেটে ফেললাম!"

লালন সাঁই-এর সুরের বদলে
নামহীন টিএসসি ভবন,
কবির ছন্দের বদলে
শুনি শুধু আমলাতন্ত্রের গর্জন,
যেখানে বিবেক বিক্রি হয়
কমিটির আড়ালে লুকিয়ে।

অন্ধকারের গহীন রাতে
শূন্য হয়ে যায় পাতা,
প্রাণের বদলে কঙ্কাল শুধু
পরিচয়ের বদলে সংখ্যা,
জাতির স্মৃতি মুছে ফেলার
প্রহসন এ আজ খুলনায়।

মনীষীদের নির্বাসিত আত্মা
আচার্য, বসু, দাশ, চৌধুরী,
ঘুরে বেড়ায় ক্যাম্পাসে,
শিক্ষার্থীদের কানে কানে বলে -
"তোমাদের হাতেই ন্যস্ত
ইতিহাসের পুনর্জন্ম।"

কে সাহস দিবে আবার
নাম ফিরিয়ে আনার?
কে জাগাবে বিবেকের ডাক?
মুখোশ খুলে ফেলার সাহস
জাগবে কি এবার?
জ্ঞানের আলো, সত্যের সন্ধানে।

রাখাল যেমন ভেড়া চরায়
তেমনি নামগুলো হাঁকিয়ে নিল,
কিন্তু জানে না ইতিহাস
পেছনে তাকিয়ে শতবার ফিরে আসে,
অপসারিত নামের অভিশাপে
একদিন কাঁপবে অহংকারী প্রাচীর।

ছায়াপথ

পূরব গগনে রক্ত রেখা ভাসে,
স্মৃতির ধুলো ওড়ে দিগন্ত-শেষে।
দেশভাগের প্রেত কাঁদে দীর্ঘশ্বাসে,
ছায়া নামে পথে, অলক্ষ্য বেশে।

সহস্র বর্ষের ভিটেমাটি ছাড়ে,
অশ্রুবারি মেশে নদীর স্রোতে।
হিংসার দাবানল, গ্রাম-গঞ্জ পোড়ে,
ভয়ের পদধ্বনি প্রতি রাতে।

অন্ন-বস্ত্র কাড়ে, আশ্রয়ও টলে,
ভূমিও গ্রাসে হিংস্র হায়েনা যত।
ঘর বাঁধার স্বপ্ন যায় রসাতলে,
নিঃস্ব হয় তারা, সহায় সম্বল গত।

সরকার শুধু কয়, ‘শান্ত হও সবে,’
আইন তবুও বাঁধে না ক’জনেরে।
বিশ্বের চোখে আঁখি মুদে রবে,
কান্নাধ্বনি পৌঁছায় না তো কর্ণান্তরে।

কালের স্রোতে তারা মিলিয়ে যায় ধীরে,
যেন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে।
গণনার খাতায় সংখ্যা নাহি ফিরে,
ছায়াপথ ধরে, অনন্ত গভীরে।

ভণ্ডুল-বিলাপ

সকলেই বলে, আমি নাকি এক মস্ত গাধার রাজা,
তাই শুনে এক শিং-ওয়ালা গিরগিটি আমায় বলেছিল,
"তোমার মাথায় ঘিলু নেই, তুমি যেন বোকাদের সেরা।"
আমি বলি, "দূর হ' হতচ্ছাড়া!"
এক থ্যাবড়ানো নাক-ওয়ালা পেঁচা আমায় বলেছিল,
"তোমার বুদ্ধি মটরের দানা, তুমি যেন বোকাদের সেরা।"
আমি বলি, "দূর হ' হতচ্ছাড়া!"
সকলেই বলে, আমি নাকি এক আলুসেদ্ধর মতো বোকা,
তাই শুনে এক গেঁজেল-মুখো চামচিকে ফুসুর-ফুসুর করে বলেছিল,
"তোমার মগজ ঘাস খায়, তুমি যেন বোকাদের সেরা।"
আমি বলি, "দূর হ' হতচ্ছাড়া!"
এক ন্যাংটো-পা কুমিরছানা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল,
"তোমার কথা শুনলে হাসি পায়, তুমি যেন বোকাদের সেরা।"
আমি বলি, "দূর হ' হতচ্ছাড়া!"
সকলেই বলে, আমার নাকি বুদ্ধি শুদ্ধি সব গেছে রসাতলে,
তাই শুনে এক ঝোলা-মুখো বনবিড়াল মিউমিউ করে বলেছিল,
"তোমার বুদ্ধি কচুরিপানার মতো, তুমি যেন বোকাদের সেরা।"
আমি বলি, "দূর হ' হতচ্ছাড়া!"
এই দেখো, আজ চাঁদের আলোয় সাক্ষী থাকুক সব ভণ্ডুলেরা,
আর শোনো, ওই বটগাছের ডালে বসে থাকা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁসগুলো,
শোনো, ওই পুকুরের পাড়ে ঘাপটি মেরে থাকা গেছো-কুমিরটা;
আজ আমি শপথ নিলাম, ওই শিং-ওয়ালা গিরগিটির কথা শুনব না,
আমি ওই থ্যাবড়ানো নাক-ওয়ালা পেঁচার কথা শুনব না,
আমি ওই ঝোলা-মুখো বনবিড়ালের কথা শুনব না।
আমি আজ কারো ছলনায় ভুলব না,
আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে চলব।

উল্টো পুরাণ

সেই আজব দেশে কোথাও পুরুষ কাঁদে না,
নারীর কান্নার জলে ফোটে শুধু বিষকাঁটা,
পুরুষেরা হাসে খিলখিলিয়ে।
সেখানে বটের ঝুড়ি ধরে ঝোলে অপ্সরা,
আর শিমুল গাছের ডালে বাঁধে পুরুষেরা বাসা,
রঙিন পালকের মতো স্বপ্ন বোনে।
সে দেশে প্রশ্ন ওঠে না কেন পুরুষেরা ধর্ষক,
বরং আঙুল ওঠে কত নারী হয়েছে কলঙ্কিত,
যেন দোষটা তাদেরই, যারা শিকার।
বিদ্যালয়ের মাঠে নয়, ঘরে কাঁদে কিশোরী,
কত ছেলে করেছে হেনস্থা, সে হিসেব কেউ রাখে না,
কেবল গুনতি চলে কত মেয়ে হয়েছে লাঞ্ছিত।
ধর্মের দোহাই দিয়ে চলে নিষিদ্ধ গর্ভধারণ,
পুরুষের বীজ নয়, নারীর গর্ভই যেন অপরাধী,
কে রাখে খবর কত ছেলে করেছে সর্বনাশ?
কালো পিঁপড়ের মতো ছেয়ে গেছে মিথ্যার পাহাড়,
সত্যের আলো যেন এক নিভু নিভু জোনাকি,
তবুও প্রশ্ন জাগে, কেন এই উল্টো পুরাণ?
কে বোঝে নারীর যন্ত্রণা, পুরুষের উল্লাস?
কে বোঝে সমাজের চোখে কেন এত পক্ষপাত?
উত্তর খোঁজে ক্লান্ত মন, ফেরে দিশেহারা।
ওই শোনো, দূর আকাশে কান্নার রোল,
যেন লক্ষ পাখির আর্তনাদ, লক্ষ ফুলের হাহাকার,
তবুও কেউ শোনে না, কেউ বোঝে না।
আহা! যদি পেতাম এক আজব চশমা,
দেখতাম সব উল্টে, দেখতাম সত্যের মুখ,
দেখতাম পুরুষের কান্না, নারীর জয়গান।

অনন্ত প্রেম

ওই যে আলো ঝিলমিল করে,
চাঁদ না কি প্রেম, ঠিক বুঝি না।
এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে আসি,
ভাবতে থাকি, ধরব কি না।

ভাবতে থাকি, ঠিক কতবার
মনের গহীনে ভুল দেখেছি।
পূর্ণিমার চাঁদ ভেবে আমি
অমাবস্যায় হাত রেখেছি।

চাঁদ, তুমি কি চাঁদ তো ঠিক?
হও যদি সেই প্রেম-জ্বালা, তবে
এই অবেলায় প্রেমের খেলায়
ফের যে আমায় পুড়তে হবে।

বলেছিলে

বলেছিলে, এ জগতে নেই কোনো ন্যায়বিচার,
মিথ্যুক সব কথা কয়।
সত্যের পথে কে আর হাঁটে, সকলে তো ভয়ে রয়,
ভণ্ডদের হাতেই তো সব অধিকার।

বলেছিলে, আঁধারেই ঢাকা থাকবে সব আলো,
আঁধারেই হবে শেষ।
আলোর ঝরনা উঠবে জেগে, ভেঙে দেবে যত ক্লেশ,
দেখবে সেদিন, আঁধার মিথ্যে হলো।

বলেছিলে, মানুষ শুধু স্বার্থ নিয়েই বাঁচে,
পরের দুঃখে কে কাঁদে?
মানুষ জাগবে, মানুষ বুঝবে, মানুষ তো মানুষেরই স্বাদে,
ভালোবাসা ছড়াবে পথে-ঘাটে-মাঝে।

আর দেখো, ওই হিমালয়ের চূড়ায় মেঘেরা সরে গেছে,
আলোর বন্যা নেমেছে নিচে।
মানুষ জেগেছে, মানুষ লড়ছে, মানুষ তো আর থামে না মিছে,
দেখো, মানুষ তার অধিকার বুঝেছে।
মানুষই শ্রেষ্ঠ, মানুষই তো সব, প্রিয়তমা, এই পৃথিবীতে।

দুঃশাসন

জ্বলছে দেখো মিথ্যে কথার আগল রাশি,
জ্বলতে আমি ভালোবাসি, মন্দ বাসি।
জ্বলতে দেখো আজকে দেশের অগ্নিকুণ্ড।

দেখো, এখন সময় কঠিন, সময় ধন্ধ,
যখন আগুন ভীষণ জ্বালায়, ভীষণ মন্দ,
এবং মানুষ চাইছে শুধু একটু জল!
দুঃশাসন আজ সফল, খুবই সফল!

আমাদের দ্বিমুখী মানদণ্ড

চৈত্রের নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়
এক অদ্ভুত প্রশ্নের জন্ম হলো আমার মনে
সংবাদপত্রের পাতায়, সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে
কিংবা রাজনীতির রঙিন চশমায়
বিচারের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আমি
চিন্তায় মগ্ন ছিলাম
আমাদের দ্বিমুখী মানদণ্ডের সেই ব্যাখ্যা
শুনে তুমি হয়তো বিস্মিত হবে!

কেন আমরা প্রতিবাদ করি না
সিরিয়ার রক্তাক্ত মাটির জন্য
কেন আমাদের আলোচনায় নেই
পাহাড়ের জমি দখল, হিন্দুদের সম্পত্তি হরণ
কেন আমরা নীরব থাকি যখন উগ্রবাদীরা আঘাত হানে
কেন আমরা মুখ ফিরিয়ে নেই অন্যের বেদনা থেকে!
তার বদলে কেন শুধু বিলাপ করি
ফিলিস্তিন, গাজা, ইসরাইল, হামাস
আমাদের পছন্দের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে!

রাতে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল
আমাদের হৃদয়ে মানবতা
কিন্তু চোখে যেন ব্যান্ডেজ বাঁধা, কানে তুলো গোঁজা
খুলে দিয়েছি নির্বাচিত সংবেদনশীলতার দরজা
খাস বিবেকের সেই মাপকাঠি নিয়ে
ওড়ে আমাদের ন্যায়বোধের পতাকা
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখি শুধু
আমাদের পছন্দের অত্যাচারকে!
কবে কোথায় কোন অন্যায় উপেক্ষা করি সব জানা আছে!
কিন্তু আমরা ভুলে গেছি
যে মানবতার মূল্যবোধে ভর করে
আমরা মানুষ হয়ে উঠেছিলাম
নির্বাচিত বেদনার আবেগে তা ঢেকে রাখা যায়নি!
এখনও যাবে না।

আমি দেখতে পাচ্ছি
এক নতুন জাগরণ ক্রমশ উদিত হচ্ছে
মৌন থেকে প্রতিবাদ, প্রতিবাদ থেকে ক্রমশ পরিবর্তন
তার প্রতিটি আওয়াজে আওয়াজে ন্যায়ের বাতাস
সত্যের আর লুকানোর উপায় নেই!

কখনো ন্যায় পাওয়া যায় না

সেই উচ্চ আদালতে কখনো ন্যায় পাওয়া যায় না
আমারই হৃদয়ের রক্ত দিয়ে আইনগুলোকে
রঙিন করতে হয়
সেখানে যে বিধি জন্মে, আর শাসনে
যে কঠোর কালো রঙের ফরমান জারি হয়
তা আমারই টুকরো টুকরো স্বাধীনতা, যা জমে শিকল হয়েছে
প্রেমগুলোর বিচার হবে, দণ্ডে ভাঙতে হবে,
তারপর নিষিদ্ধ করতে হবে
যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের রূপ হবে
মধ্যযুগীয় তালিবানের চিন্তার মতো নিষ্ঠুর শ্বেতবর্ণ
ধর্মান্ধতার বিকৃত বিচারে নিষ্ঠুর শ্বেতবর্ণ

কে রাত না পোহাতেই কাঁদে?
কে আইনের ভয়ে ভালোবাসা ঢাকে?
কে প্রেমের বোঝা নিয়ে ভীত হয়ে হাঁটে?
আর কেই বা নুরজাহানের মতো মাটিতে মিশে যায়?
কে স্বপ্ন বপন করে?
আর তার বিনিময়ে যা পায়, তা হ'লো
পাথর, কড়া হুকুম, ধর্মের খোলস,
ছিন্নভিন্ন ভালোবাসা, নতুন আইনের পাতা?
আর এরপরেও তাকে শাস্তি দেওয়া হয়
ফতোয়া আর মৌলবাদের আঘাতে
কে সেই মানুষ?
কে মনের খেতে ভালোবাসা বোনে?
আর সারি সারি স্বপ্নগুলোতে
আশার আলো জ্বালায়?
কে সেই মানুষ?
কে উচ্চাসনে বসা বিচারককে ক্ষমতা, অহংকার,
পুরুষতন্ত্রের অস্ত্র দেয় আর
পাথরের নিচে চাপা দেয়
প্রেমিকাদের কোমল হৃদয়?
কে ধর্মকে ঢাল করে
তাকে রাতারাতি বিকৃত করে
মস্তিষ্কে বিষ ছড়ায়?
-কে সেই মানুষ?
তাদের জিজ্ঞাসা করো
যে পাখিরা মুক্ত আকাশে ওড়ে
যে নদীরা অবাধ গতিতে
এদিক ওদিক বয়ে চলেছে
যে হাওয়া এই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে উড়ে বেড়ায়
তারা সকলেই উত্তর দেবে
ঐ অন্ধ বিচারকটি-
যে দিনরাত ধর্মের নামে অন্যায় করছে।
আহা!
আমাকে অন্তত ঐ স্বাধীনতার চূড়োয় উঠতে দাও
সেখানে বসে আমি শ্বাস নেব
মুক্তিযুদ্ধ থেকে যে স্বাধীনতা বয়ে বয়ে আসে;
আর সত্যের মধ্যে আমি নিশ্চয়ই বুঝে যাব
আমি একজন স্বাধীন মানুষ
আমার জন্যেই এই দেশ।

কালের চক্রে ঋতু

প্রলয়-শীতের শেষে মহাকাল জাগে ধীরে,
বসন্তের আবাহনে ভরে দিক্-দিগন্ত রে।
শ্মশানের চিতাভস্মে লুকানো প্রাণের কল্লোল,
ফিরে আসে সৃষ্টি যেন, ভাঙ্গিয়া কালের শৃঙ্খল।
হিমগিরি গলিতেছে, গঙ্গা বহে কল্‌কল্‌,
নব পল্লব জাগে, কাননে জাগে গুঞ্জরন অবিরল।
রাধা-কৃষ্ণ লীলারসে মধুময় বৃন্দাবন,
ফিরে আসে প্রেম যেন, বাঁশীর সুরের মতন।
মহাদেবের তৃতীয় নেত্রেও ফোটে স্বর্ণকমল,
বিরহের অন্তে আসে মিলনেরই লগন কেবল।
অনন্ত কালের চক্রে ঘোরে ঋতুর আবর্তন,
শীত যায়, বসন্ত আসে, এই তো সনাতন।

ক্ষুধার্তের হাহাকার

সিংহাসনে বসে আছো রাজা তুমি মহানুভব,
পদতলে কাঁদে দীন, নাহি পাও অনুভব।
প্রাসাদের প্রাচীরে ঘেরা সুরম্য তোমার ভুবন,
ক্ষুধার্তের আর্তনাদে কভু না ভরে মন।
ভোজনপাত্র সোনা-রুপা, পঞ্চব্যঞ্জন থরে থরে,
অন্নের অভাবে শিশু মরে পথে কাতরে।
মন্দিরের চূড়া ওই আকাশ নীলিম দিগন্ত,
পেট খালি, দেবপূজা – এ কেমন দুর্বিনীত?
ঐশ্বর্যের স্তূপে ব’সে ভুলে গেছ মৃত্তিকার ঘ্রাণ,
ধুলোমাখা পথে হাঁটে ক্ষুধিতের ম্লান প্রাণ।
পুরাণের কথা গাঁথা, ইতিহাসে লেখা রয়,
পূর্ণ যারা দরিদ্রের ব্যথা নাহি বোঝে নিশ্চয়।

যে যেখানে পারে

যে যেখানে পারে স্বপ্ন যে ছোঁয়,
সে পায় আলোর দিশা,
কিছু থাকে তার হাতের মুঠোয়,
কিছু হারায় প্রত্যাশা।
যে প্রেম রেখেছি হৃদয় খাঁচায়,
সে আজ চাঁদের আলো,
কিছুটা ঝরে যায় রাতের মায়ায়,
কিছু থাকে চিরকাল ভালো।
সিন্দুর সিঁথি আর কৃষ্ণচূড়ার ঘ্রাণ
এই রাতের যে তার,
জানা নেই তারই পেছনেতে প্রাণ
করে শুধু হাহাকার।
যে যেখানে পারে রাখে সেইখানে
প্রেমের অমূল্য ধন,
তাই দেখে হাসে রাধার দু'নয়নে
চাঁদের আলোর কিরণ।

জীবন মরণ

আয় দেখি খুলি তোর চোখ, দেখি কত আঁধার লুকানো,
দেখি কত মিথ্যে স্বপ্ন, কত ব্যথা মনেতে বাঁধানো।
কোন দিকে মন ছুটে চলে, কোন দিকে থেমে যায় আশা,
কতখানি কান্না জমে, কতখানি নীরব হতাশা।
জীবন তোর কোন দেশে থাকে, কেন তুই ভুলে যাস কথা—
আয় দেখি কোন ফাঁক দিয়ে, মরণেতে ডুবে যাস কোথা।
বিষণ্ণ মেঘে ঢাকা মুখ, ভাঙা-চোরা স্মৃতি যেন,
আয় দেখি বিশ্লেষ ক'রে—চুপ করিস কেন বল্ তো এখনো?
বাঁকা হয়ে দাঁড়া দেখি, হৃদয়ের ক্ষতখানা দেখা,
ভালো ক'রে বুঝে শুনে দেখি—বিজ্ঞানেতে এই তো লেখা।
মৃত্যুর চুম্বক ধ'রে, দীর্ঘশ্বাসে প্রতিঘাত ক'রে,
অশ্রু দিয়ে গতিবেগ মাপি, জীবন তোর ঘোরে কি না ঘোরে।

কারার ঐ লৌহ-কপাট ভাঙবে যখন রক্ত ঝরে

কারার ঐ লৌহ-কপাট ভাঙবে যখন রক্ত ঝরে,
আমার চোখে আঁধার নামে, হৃদয় কাঁপে ভয়ে ডরে।
এই যে কারা, মৃত্যুপুরী, নিঝুম রাতে কান্না শুনি,
শত শহিদের রক্ত মাখা, স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনি,
পূর্ণ হবে এই জীবন, যেদিন তুমি আসবে ঘরে।

তোমার চোখে ভয়-ডরের কালো মেঘের ছায়া নাচে,
আমার মনে আশার আলো, প্রেমের বাঁধন আরও বাঁচে।
যে প্রেম জ্বালায় মুক্তির মশাল, রক্তে ভাসে স্লোগান যত,
সংগীতে সে উঠবে জেগে, দুঃস্বপ্নেরও হবেই গত,
যেদিন তুমি মুক্ত হয়ে, উড়বে স্বাধীন পাখির স্বরে।

অশ্রুসিক্ত হতে চায় মন

কতটুকু পথ চলা?
শতাব্দীর দীর্ঘশ্বাস
নিমেষে পার হয়ে,
আমি আজ জনতার দ্বারে
এসে নতজানু হই।

ক্ষমতার উষ্ণ স্পর্শে উন্মত্ত
এই রঙ্গমঞ্চে নামার আগে,
অদৃশ্য শিকলে বাঁধা স্বপ্নগুলো
বুকে টেনে আনি,
বেদনার অশ্রুজলে সিক্ত করতে চাই।

আমার এই ক্লান্ত বুকে
যেন ঝড় বয়ে যায়,
আমার এই দীর্ঘ জীবনের
সব হিসেব মিথ্যা হয়ে যায়।

বহুদিন পরে "স্বাধীনতা" শব্দটা
আজ বড় অচেনা লাগে,
ইচ্ছে করে জনতার দুঃখের সাথে
নিজের দুঃখ মিশিয়ে আলিঙ্গন করি।

সামাজিক মুখোশের আড়ালে ঢাকা
আসল চেহারা উন্মোচিত করে,
জন্ম নেয় এক নতুন মুহূর্ত।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে
জনতার পায়ের কাছে…

বাইরে আজ তুমুল কোলাহল,
ক্ষমতার দাপটে অস্থির জনজীবন,
ধ্বংস আর সৃষ্টির খেলায়
যেন এক অদ্ভুত প্রহসন।

অসহায় মানুষের ঘামে ভেজা মুখগুলো
যেন এক জীবন্ত উপহাস,
তবুও এই সময় যেন সবচেয়ে মূল্যবান,
যখন মানুষ ফেরে
তার ব্যক্তিগত স্বর্গের অতৃপ্ত সিঁড়িতে।

যখন বন্দি আত্মার মাঝে
ভেসে ওঠে হারানো শৈশবের স্মৃতি,
তোমার সেই স্বপ্নময় মুখের দিকে
আমার স্থির দৃষ্টি,
ক্ষমতার অহংকারে গড়া প্রাচীর
যেন ভেঙে যায়।

প্রতীক্ষা করি সেই মুক্তির বজ্রকণ্ঠের,
নীরবে কাঁদে ভাবনা,
ভেঙে পড়ে পাঁজর।

বুকে বুক রেখে যদি ছোঁয়া যেত
এই দুঃখের সমুদ্র,
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে আসি
অচেনা পথের যাত্রী হয়ে।

চোখ শুকনো,
তবু স্বাধীনতার স্পর্শে
অশ্রুসিক্ত হতে চায় মন!

একদিন মনে পড়ে

ভাঙা মন্দিরের প্রদীপ,
একদিন মনে হয়,
বাঃ আলো কী সুন্দর!
যেমন রাত্রির বুক চিরে নেমে আসে
ভোরের রক্তিম সূর্য।

রোজ মনে পড়ে না,
একদিন মনে পড়ে,
একদিন মনে পড়ে,
দেশভাগের সেই কি নিদারুণ
বিষাদের কালো ঝড় উঠেছিল।

রোজই তো কত মানুষের দিকে তাকাই,
শুধু একদিন চোখে পড়ে,
বেদনার্ত মুখ।

বাতাসে ভেসে বেড়ায় আর্তনাদ,
শুধু একদিন টের পাই,
সব বাতাসেই ঘৃণা।

স্মৃতির গহ্বরে লুকিয়ে থাকা
পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি,
তাতে জড়িয়ে আছে অশ্রুর ইতিহাস।

শুধু একদিনই টের পাই,
অস্তিত্বের চেয়ে কত বিরাট
এই হারানোর যন্ত্রণা।

হঠাৎ এক মধ্যরাতে,
আগুনের লেলিহান শিখা এসে
ভয়ংকর উল্লাসে
চেয়ে থাকে আমার দিকে,
সে কী যে দেখে!

কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে ঘৃণার বীজ,
তার থেকে উঠেছে বিদ্বেষের ঝিরিঝিরি
অভিশপ্ত এক অন্ধকার চারা,
কাল তো ছিল না!

বিশ্বাস করো বা না করো,
খবরের কাগজে ছাপা হয় না এমন এক
বিশাল ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে বাইরে।

তার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিলীন হয়ে যেদিন
দেখতে পাই,
ধ্বংসস্তূপের ক্লান্তির মতো একটি দিন,

সেদিন মনে হয়,
শুধু সেই দিনের জন্য,
বড় ব্যর্থভাবে বেঁচে আছি।

মিলন-তীর্থের পথে

এসো সবে মিলি, দূর হোক গ্লানি,
নতুন দিনের গান।
হিংসা-বিদ্বেষ, মিছে অভিমানী,
ঘুচুক সব ব্যবধান।
ভালোবাসা আর শান্তির বার্তা,
আনুক খুশির নতুন কবিতা,
ভ্রাতৃত্বের হোক চির-নব গাঁথা,
উড়ে চলুক প্রাণ।
উৎসবে মাতি ঘুচাও সকল
বেদনার অভিমান।

স্বর্ণ থালা নয়, নেই আয়োজন,
নেইকো প্রাচুর্য আর,
হৃদয়ের প্রীতি, করিও গ্রহণ,
স্নেহের উপহার।
মিলনের পথে, সব ভেদাভেদ ভুলে,
এসো হাতে হাত, দু'চোখ মেলে,
গরীব-দুঃখীর অশ্রু মুছে ফেলে,
করি অঙ্গীকার।
শান্তির সুধা বিলিয়ে দিই আজ,
সবার মাঝে আর।

রাজা নও তুমি, হে প্রিয় বন্ধু,
তুমি যে প্রাণের সাথী।
হিংসা ভুলে আজ, বাঁধো প্রীতি-সিন্ধু,
ভালোবাসার গাঁথি।
দারিদ্র্য-জ্বালা, হোক আজ দূর,
মিলনের মন্ত্র, বাঁধুক সুর,
শান্তির শিখা, হোক সুমধুর,
এসো একসাথে হাঁটি।
ভেদাভেদ ভুলে এসো সবে মিলি,
বন্ধন করি খাঁটি।

দাও আমাদের শান্তির বাণী,
দাও মুক্তির সুর।
জীবন হোক আজ, নতুন কাহিনি,
দূর হোক সব দূর।
ত্যাগ আর প্রেমের, হোক এই উৎসব,
হিংসা ভুলে গিয়ে ঘুচাও সব,
মুক্তির আলোয় হোক অনুভব,
হৃদয় ভরপুর।
মৃত্যু-শঙ্কা, দুঃখ সব ভুলে,
চল শান্তির পুর।

কোথায় গেলে পিতা

সপ্তবর্ষ আগে আঁধার করে
কোথায় গেলে পিতা, কোথায় রে?
তোমার পুত্র কাঁদে নিশিদিন,
স্মৃতিরা দেয় শুধু ব্যথা ঋণ।
জাগে স্মৃতি যত, জাগে বেদনা,
অশ্রু ধারায় ভেজে কামনা।
শূন্য আঙিনা, শূন্য এ ঘর,
কোথায় গেলে পিতা, নিরুত্তর?
কাঁদে মন আজ, কাঁদে আকাশ,
স্মৃতিরা যেন দেয় দীর্ঘ শ্বাস।
নিভে গেছে দীপ, নিভেছে আলো,
বেদনা-সাগরে মন হলো কালো।
কোথায় সে হাসি, কোথায় সে মুখ,
শূন্য এ বুকে আজ শুধু দুখ।
শূন্য এ পথে, শূন্য এ দেশ,
কোথায় তুমি পিতা, নাহি শেষ?
স্মৃতিরা কাঁদায়, স্মৃতিরা পোড়ায়,
তোমার অভাব প্রতি পলে জড়ায়।
ফিরে এসো পিতা, ফিরে এসো তুমি,
তোমার অভাবে আমি নিঃস্ব ভূমি।
শূন্য এ জীবন, শূন্য এ গান,
কোথায় গেলে পিতা, দাও সন্ধান।

নিঃশব্দ প্রস্থান

দেশের কি হৈল করুণ কাহিনি ।
পুরাতন ঘরে জ্বলে না প্রদীপ
মন্দির শূন্য এখনি ।।
সন্ধ্যার বেলায় শঙ্খ না বাজে
থামিয়া গেছে আরতি ।
পূজারী বিহীন দেউল এখন
কেমনে কাটিবে রাতি ।।
তুলসী মঞ্চেতে শুকায়ে পাতারা
ধুলায় ঢাকিয়া যায় ।
কার্তিক প্রতিমা দাঁড়ায়ে একাকী
বিষণ্ণ নয়ন চায় ।।
পথিকের মত চলিয়া যায় যত
পূর্বের বাসিন্দাগণ ।
বঙ্গ কয় আজ নীরবে সবায়
বিদায়ের নিবেদন ।।

রূপের মায়াজাল

চোখের দেখায় ভুলো না মন রে
রূপের মায়ার ছলে,
হৃদয় যে তার পারে না বুঝিতে
ডুবে যায় আঁখিজলে।

সৌন্দর্য দেখি মুগ্ধ যে জন
ছুটে চলে সে উন্মাদের মতন,
কিন্তু সে রূপ ক্ষণিক স্বপন
মিলায় সময়ের তলে।

যারা রূপসি তাদের কাছেতে
যাও না কভু প্রেম নিবেদিতে,
অন্যেরা আছে তাদের পূজিতে
বসে আছে ভক্তদলে।

রূপের নেশায় মাতিও না প্রাণ
শুধু বাহিরের এ মিথ্যা টান,
অন্তরের রূপ করো অনুসন্ধান
গভীর হৃদয়তলে।

যদি পাও কারে হৃদয়ের মাঝে
তবেই জেনো সত্য প্রেম সাজে,
নইলে শুধু আঁধারেতে বাজে
ব্যথার সুর একা চলে।

ধীরে ধীরে তুমি চিনো ভালোবাসা
বুঝে নাও তার গভীর ভরসা,
রূপের মোহে ভেসো না মিছা
ভেসো না মায়ার জলে।

চোখের দেখায় ভুলো না মন রে
রূপের মায়ার ছলে।

ছুটির দিনে

শুনতে পেলাম অফিস থেকে-
আবার নাকি ডেকেছে দেখে?
শনিবারেতে কাজের তরে?
এমন কাজ কি করে করে!
বসে আছেন যারা ওরা
বুদ্ধি যেন পাথরের গোড়া;
মাথার ভেতর শুধু ঘুণ
চিন্তাভাবনা সব বিগুণ;
নিয়মকানুন? বলছি মশাই-
এমন জগতে দেখিনি তাই!
ত্রিশটা বছর চাকরি করে
বুদ্ধি তাদের গেছে মরে।
মানুষ নাকি? রোবট যেন-
হুকুম মতো চলছে কেন?
কর্তা আছেন একজন ভারী
যেন কোনো এক যম অনুচারী;
দ্বিতীয়জন তার চেলা
সারাদিন শুধু করেন খেলা।
তৃতীয়জন বসে থাকে
ফাইল দেখে আর চা খাকে।
এমন জায়গা দেখে মোর
মাথাটা করে ঘোর ঘোর।
তবুও তারা বড়ো ঘর,
সরকারি পদে বংশধর!
রাম শ্যাম যদু মধু সব
এখানে এসে হয় নবাব।-
তবু বলি এই দফতর,
নরক যেন এর ভিতর,
এর চেয়ে ঢের ভালো ভাই,
জেলখানাতে শান্তি পাই।

স্বপ্নভঙ্গ

জ্বলে ওঠে আগুনের লাল রক্তধারা,
স্বপ্ন ভেঙে চুরমার, নাই আর পারা।
কালো ধোঁয়া আকাশেতে
উঠে যায় মেঘ হতে,
যা ছিল তা ছাই হতে
দেখি না ডরা।
স্বপ্ন ভেঙে চুরমার, নাই আর পারা।

একদা যে বাগানেতে ফুটেছিল ফুল,
সেথা এবে ছাই ছড়া, সকলি আকুল।
নতুন যে আলো জ্বলে
পুরানো সে আঁধারেতে,
কী যেন সে খোঁজে এতে
হয়ে ব্যাকুল—
সেথা এবে ছাই ছড়া, সকলি আকুল।

কার বাঁশি বাজে দূরে অন্ধকারে?
মনে হয় চেনা সুর ভাসে বারে বারে।
নতুন সে সুর নয়,
পুরানো সে ব্যথা লয়,
তবুও কি আশা রয়
এই সংসারে?
মনে হয় চেনা সুর ভাসে বারে বারে।

শোনো ওগো, যারা আজ নতুন জাগিয়া,
পুরানো সে বন্ধন কি যাবে ভাঙিয়া?
নূতন যে স্বপ্ন দেখি
পুরানো সে চোখে ঢাকি,
কেমনে সে হবে একি
সত্য হইয়া?
পুরানো সে বন্ধন কি যাবে ভাঙিয়া?

কোথা গেল সেই স্বপ্ন? কোথা সেই আশা?
ভেঙে গেল, ছিঁড়ে গেল যত ভালোবাসা।
যা ছিল তা গেল চলে,
নতুন কি আসে বলে?
ডুবে যায় চোখের জলে
সব ভরসা—
ভেঙে গেল, ছিঁড়ে গেল যত ভালোবাসা।

কিছুই হয়নি কাকা

শুনেছি দূর দেশে এক আজব বিধান,
"কিছুই হয়নি" এই মন্ত্রই প্রধান।
রণ, মড়ক, নারীহরণ?
"স্বপ্ন শুধু, অলীক স্বপন,"
কহে কাকা, "মিথ্যা এ ঘোর কলির টান!"

"গণহত্যা?" শুনে কাকা হাসে খলখল,
"ওসব বুজরুকি কথা, আজগুবি সকল।
কঙ্কাল, পোড়া ভিটে?
দৃষ্টিভ্রম, মিছে ভিড়ে,"
কাকা বলে, "কিছুই হয়নি, সবই মায়া, ছল!"

ধর্ষিতা নারীর কান্না, বাতাসে হাহাকার,
কাকা বলে, "ওটা শুধু মায়াবী ঝংকার।
বেদনার সুর নয়,
মিছে শোকের আলয়,"
কাকা বোঝায়, "কিছুই হয়নি, সবই অলীক প্রহার!"

যে দেশে ভণ্ড সাধু পূজিত হয় রোজ,
ঘাতকের নামে বাঁধা হয় নতুন সুর, ভোজ,
সে দেশে সত্যি কি আর,
কিছু ঘটা সম্ভব তার?
কাকা বলে, "মিথ্যে সবই, মিছে স্তব, মিছে খোঁজ!"

তাই বলি, কাকা যখন "কিছুই হয়নি" কয়,
তখন বুঝবে সবই হয়েছে, নিশ্চয়।
নীরবতা এক গভীর সুর,
মিথ্যার এক কঠিন দূর,
কাকা বোঝে, "কিছুই হয়নি,"—এই তো সবের জয়!

আমার জন্মভূমি

প্রতিদিন সকালে মন্দিরের ঘণ্টা বাজে
আমি চুপি চুপি পূজা করি ঘরে
কেউ জানে না আমার বেদনার কথা
যেখানে জন্মেছি, সেখানে পরবাসী
মায়ের আঁচলের মত এই মাটি
তবুও কেন আমি এখানে ভিখারি?

বাড়ির পাশের পুকুরে পদ্মফুল ফোটে
মসজিদের আজান ভেসে আসে হাওয়ায়
আমার ঠাকুরদার বাগানে এখন
অন্য কেউ বসে গল্প করে চায়
তবুও প্রতিদিন সন্ধ্যায় দীপ জ্বালি
যেন এক নীরব প্রার্থনার মতো।

গ্রামের পথে হেঁটে যাই যখন
চোখে পড়ে ভাঙা মন্দিরের চূড়া
কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে
সাক্ষী হয়ে কত ইতিহাস ভুলে যাওয়া
আমার পূর্বপুরুষের রক্ত মাখা
এই মাটিতে আজও আমি অচেনা।

বাজারে যখন যাই কেনাকাটা করতে
দোকানি জিজ্ঞাসা করে, "কোথায় থাকেন?"
আমি বলি, "এইখানেই" - কিন্তু ভিতরে জানি
এই "এইখানে" কত দূরের হয়ে গেছে
তবুও ভালোবাসি এই নদী, এই মাঠ
যেখানে আমার শৈশব ছুটে বেড়িয়েছে।

সন্ধ্যায় দেখি আকাশে পাখি ফেরে
ওরা জানে না সীমানা, জানে না ধর্ম
আমিও চেয়েছিলাম তেমন উড়ে যেতে
কিন্তু শিকড় আমায় ধরে রেখেছে এখানে
এই মাটিতে আমার জন্ম, আমার মৃত্যু
এই আমার অভিশপ্ত স্বর্গ।

প্রজ্ঞা

আরো একটু প্রজ্ঞা দিয়ে দাও।
নইলে এই কালের প্রবাহ
সহজে ও যে বুঝতে পারবে না!

এখনো যে ও সরল আছে প্রভু!
এবার তবে গভীর করে দাও—
নইলে এই কালের প্রবাহ
সহজে ওকে ছুঁতে পারবে না।

নম্রতার শিক্ষা

অহংকার ছেড়ে দিতে পারি
যদি বলো; নতুন আঁধারি
পথে হাঁটা শিখব নিঃশব্দে।
যে মনটা ছিল অতি গর্বে
ভরা আজ, কাল নত হবে
(তুমি যেন বলেছিলে কবে)
– সে কখনো হারে নি এমন!
বেশ; করি নিজেকে দমন
আজ থেকে, যদি তুমি চাও
ভুলগুলো স্বীকার করে নাও
খুলে দেবে জ্ঞানের দুয়ারি,
আমার অহমের পাহাড়ি
চূড়াগুলো ভেঙে যাক ধূলে।
অহংকার ত্যাগ করা ভুলে
যায় সহজে; জয় পেতে হলে...
বিনয় আছে তো তব পথে?

মৃত্যুর আগে

এই তো শেষ রাত, দাঁড়িয়ে আছি আমি
নক্ষত্রের নীচে একা—
মুছে দাও আমার সকল স্মৃতি যদি
তবু রাখো প্রেম বাঁচা।

কোথায় গেল সেই অমৃত স্পর্শন
কোথায় হারায় সব আলোর ছটা!
চিতার আগুনে পুড়ে যায় জীবন
শুধু থাকে এক গভীর ব্যথা!

জ্বালাও আকাশে তারার প্রদীপ
অন্ধকারের বুকে জ্বলে;
স্থির করে দাও আমার চেতনা
প্রেম থাক এই ভূমণ্ডলে।

না কি এ হৃদয়ে বিরহের বীজ থেকে
কোনো ফসল নেই উঠবে আর
মিছে এই প্রাণ ধরণির 'পরে?

না কি এ জীবনে অনন্ত প্রতীক্ষায়
পুড়ে যায় সব স্বপ্ন-স্মৃতি
এবং কালের গর্ভে মিশে যায়
সহস্র প্রেমের গীতি?

আমারই বুকে এত দিয়েছ যন্ত্রণা
শূন্য ক'রে প্রাণ কোথায় যাবে?
মুছে দাও আমার সকল স্মৃতি প্রভু
তবু প্রেম থাক এই পৃথিবীতে।

মরীচিকার লক্ষকোটি বিন্দু

আমি বলি, এ কী শুনি, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিছু,’—
যেন সিন্ধু হতে এক বিন্দু জল করি’ বিয়োগ!
লক্ষ লক্ষ বিন্দু মিলি’ সিন্ধু হয়, নাহি পিছু
হটে কভু, রচি’ চলে অনন্তের এক যোগ।

বিচ্ছিন্ন—এ শব্দ শুধু প্রবঞ্চনা, ঘোর মায়া,
অঙ্কের কুহক যেন, লুকোচুরি আঁখি’ সাথে;
এক-এক বিন্দু যেন তীব্র বিষ, প্রাণে হানে ছায়া,
লক্ষ বিন্দু মিলি’ গ’ড়ে মারণের স্রোত রাতে।

কহ’ দেখি, ক’ত ঘর পুড়ে ছাই হল, ক’ত নারী
হারালো সম্মান, ক’ত শিশু হলো পিতৃহীন?
‘বিচ্ছিন্ন’ বলিয়া সবে করি’ দিবে পরিহারি’,
যেন কিছু হয় নাই, সব শান্ত, সুগভীর, লীন!

এ নহে বিচ্ছিন্ন কিছু, এ যে এক বিষাক্ত বাণ,
লক্ষ লক্ষ রূপে হানে, বিদ্ধ করে মোর প্রাণ।

হৃদয়-উৎসব

ওগো অন্তরদেব, এ পোড়া হৃদয়খানি,
কাদা-মাখা পদ্ম যেন, মলিন, ম্লানি।
সহস্র বাসনা-কীট নিয়ত কুঁড়ে খায়,
অহং-বিষে জর্জরিত, শান্তি নাহি তায়।

দয়া করি’ তারে তুমি করো নাথ, মার্জনা,
বিকশিত করো, যেন হয় নবীন চেতনা।
কালিমা ঘুচায়ে দাও, জ্যোতির্ময় করে’,
সুন্দর করো, যেন প্রেম-সুধা ঝরে।

কামনার কণ্টকবনে পথ হারাইয়া,
ভ্রান্ত এ মন ফেরে দিগ্বিদিক ধাইয়া।
লোভের মরীচিকা পিছু ধায় অনিবার,
তৃষ্ণা মেটে না কভু, শুধু হাহাকার।

হৃদয়ের মন্দিরে তুমি এসো, হে অন্তরযামী,
জ্ঞান-দীপ জ্বালো, ঘুচাও এ তিমির-রাশি।
বৈরাগ্যের বারি সিঞ্চিয়া করো শীতল,
প্রেমের পরশে যেন হয় সে উজ্জ্বল।

হিংসা-দ্বেষ-কলুষিত এ চিত্ত আমার,
পাপ-পঙ্কে নিমজ্জিত, নাহি পরিত্রাণ আর।
তোমার কৃপা-বারি বিনা কে করিবে ত্রাণ,
তুমিই তো গতি, তুমিই তো শেষ আশ্রয় স্থান।

হৃদয়-সরোবরে ফুটাও প্রেম-শতদল,
আনন্দ-মধু ঝরে যেন অবিরল।
তোমারি চরণে যেন থাকে অটল ভকতি,
ইহাই তো জীবনের পরম মুক্তি, পরম গতি।

মম অন্তরের গান

ধীর পদে চলি আমি, ধরণির 'পর,
স্পর্শ করি মৃদুভাবে, যেন ফুল্ল স্বর।
ক্ষুদ্র কীট হতে করি ভয়,
কাহারও না হয় কিছু ক্ষয়,
কোমল হৃদয়ে মম, প্রেম নিরন্তর।।

মৃত্তিকার বুকে পা, রাখি সাবধানে,
পাছে ব্যথা পায় ধরা, মম অজ্ঞানে।
নাহি চাহি কারো মনোভঙ্গ,
নাহি করি কারো আশাভঙ্গ,
স্নেহ-সুধা বিতরিব, এই মাত্র ধ্যানে।।

জগৎ-মাঝে আসি আমি, অতিথি যেমন,
নত শিরে চলি পথে, করি না ভ্রমণ।
নাহি চাহি যশ-খ্যাতি-মান,
নাহি চাহি কারো প্রতিদান,
শান্ত স্রোতে বহিব, এ জীবন এমন।।

কোমল চরণচিহ্ন, রাখি ধূলিতলে,
যেন শিশিরের বিন্দু, ঝরে বৃক্ষতলে।
নাহি চাহি কারো নিন্দাবাদ,
নাহি চাহি কারো আশীর্বাদ,
নীরবে করিব কাজ, আপন অন্তরে।।

পাপ-পঙ্কিল পথে, নাহি করি বিচরণ,
পবিত্র হৃদয়ে মম, প্রেমের সঞ্চরণ।
নাহি চাহি কারো কাছে কিছু,
নাহি করি কারো পিছু পিছু,
স্নেহ-ডোরে বাঁধি সবে, এই মোর পণ।।

বন্দিকৃত কণ্ঠস্বর

কোথা সেই ন্যায়দণ্ড, ধর্ম সাক্ষী যার,
অষ্টসূত্রে বাঁধা ছিল আর্তের ক্রন্দন?
অসহায় কণ্ঠে আজি উঠেছে হুঙ্কার,
মিথ্যা অভিযোগে বন্দি, মানব-রতন।
কোথা সেই সুবিচার, ন্যায়ের আলয়,
অষ্টদিক হতে আসে কাতর আৰ্তনাদ?
নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বন্দি একজন নয়,
লক্ষ কোটি কণ্ঠে বাজে শুধু বিষাদ।

‘‘নিরাপদ করো’’ ছিল তাদের আহ্বান,
ক্ষুদ্র জাতি, ধর্ম ভিন্ন, ভীত, কম্পমান।
অষ্টদাবী, শান্তি-মন্ত্র, মুক্তির আশ,
প্রতিদানে কারাগার, রুদ্ধ শ্বাস-প্রশ্বাস।

এ লজ্জা দেশের, হায়! এ লজ্জা কাহার?
বন্দিত্বের গ্লানি নহে, এ দেশেরই ভার।

কাল-কণ্ঠ

কোথা দেশ? এ কি ঘোর তিমির নিশীথে
নিমগ্ন ধরণি, কাঁদে বিশ্ব হাহাকারে?
নীরব কেন রে কবি, বজ্র নাহি কি তে
তোমার কণ্ঠে, ভেদিবে এ ঘোর আঁধারে?
‘‘ভালো আছি’’ বলিবারে হবে নিরন্তর,
যদিও অন্তরে জ্বলে অনল ভীষণ;
সহিতে সকলি, যেন পাষাণ অন্তর,
নহিলে নামিবে কাল-নিয়তির শাসন।
শান্তির বারতা যদি করি উচ্চারণ,
‘‘জঙ্গি’’ আখ্যা মিলিবে, এ ঘোর কলিতে;
শ্রীকৃষ্ণের বাণী যদি করি বিতরণ,
‘‘জবাই’’ হুঙ্কার উঠিবে নর-পশু মুখেতে।
অধিকার-তরে যদি করি জাগরণ,
মিথ্যা জালে বাঁধিবে, করিবে নিপীড়ন।

যেমন খুশি তেমন সাজো

শুনেছি এ বঙ্গভূমে এক নব লীলা,—
যেমন খুশি তেমন সাজো, ঘোর কলি এ কী এলা!
নারীকুলও নামে আজি ডাকাতির বেশে,
দশ জন ধরা পরে, আট জন তাদেরি সে দলে মেশে।
বয়সের ভেদ নাই, যে যেমন পারে,
অপরাধের স্রোতে ভেসে যায় অকূলে আঁধারে।
সবই ঠিক ছিল, যদি না করিত তারা এক ছল,—
মুসলমান হয়েও সিঁথেয় পরেছে সিঁদুর, এ কেমন কৌশল!
হিন্দু সেজে ডাকাতি, এ কেমন প্রপঞ্চ বিস্তার,
ধর্মের আবরণে লুকানো ঘোর অন্ধকার।
চারিদিকে শুধু আজ "যেমন খুশি তেমন সাজো"র ধুম,
নীতি-ধর্ম দূরে থাক, শুধু স্বার্থের অন্বেষণ সুতীব্র, নিৰ্ঘুম।
এ কেমন রঙ্গমঞ্চ, এ কেমন নাটকের পালা,
যে যেখানে যেমন পারে, সাজে সে তেমন বেশ, নাহি মানে কোনো বাধা।

কীট হতে রূপসি

সহজেই মুগ্ধ আঁখি প্রজাপতির রূপে,
বর্ণালি পাখায় তার মন হারায় সুখে।
উড়ে সে বাতাসে, যেন স্বপ্নিল ভেলা,
ভ্রমরের গুঞ্জনে মাতে অবিহেলা।
কিন্তু ক’জন ভাবে সেই কীট-জীবনের কথা,
যেথা ছিল শুধু ক্ষুধা, ক্লেদ, আর ব্যথা?
কুৎসিত শরীর তার, গতি অতি মন্থর,
পত্র-পল্লব চর্বি কাটে দিন বিভোর।
সহস্র যাতনা স’য়ে, তিলে তিলে মরে,
তবে তো সে পায় এই রূপ মুক্তি ভরে।
যেন এক মায়া-খেলা, প্রকৃতির বিধান,
কদর্য অতীত ঢাকে সৌন্দর্যের গান।
আমরাও কি তাই নহি? লুকাই কি ক্লেদ?
রূপের আভায় ঢাকি জীবনের ভেদ?

তমসার বর্ষবরণ

এ হেন আঁধার নিশি, নববর্ষের কালে,
কভু নাহি হেরি আমি কোনো দেশে আর,
এ মোর জন্মভূমি, পতিত আঁধারে,
নীরবে কাঁদিছে যেন, করি হাহাকার।

কোথা সেই আনন্দ, উল্লাস, কোলাহল,
কোথা সেই দীপাবলী, আলোকসজ্জা ঘোর?
নিভিয়া গিয়াছে সব আলো, নীরব ধরাতল,
যেন প্রেতপুরী মাঝে করিতেছি বিচরণ মোর।

"শুভ নববর্ষ" বাণী, আজি বৃথা মনে হয়,
কাহারো মুখে নাহি শুনি সেই আহ্বান,
হৃদয়ে জমিয়াছে ব্যথা, বিষাদের সঞ্চয়,
কেমনে জানাইব আমি নববর্ষের গান?

অন্ধকারে ঢাকা এই নববর্ষ দিন,
কেমনে কহিব "শুভ", অন্তর মলিন?

কালান্তক রজনী

এমন আঁধার নিশি, নাহি হেরি কভু,
কোন দেশে, কোন কালে, এ ধরা ভিতরে।
বর্ষের অন্তিম দিন, যেন এক স্তব্ধ ঘুঘু,
নীরবে বসিয়া রহে কাল-সিন্ধু-তীরে।

অতীতের প্রেতগুলি কাঁদে মৃদু স্বরে,
ভবিষ্যৎ যেন এক ভীষণ কঙ্কাল।
নববর্ষের রবি উঠিবে না আর ভোরে,
এ ঘোর সন্দেহ আজি হৃদয়ে বিশাল।

দিগ্বিদিগ শূন্যময়, ধ্বনিহীন, শ্বাসরুদ্ধ,
প্রকৃতির বক্ষ ভেদি উঠিছে হাহাকার।
অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা মানব সমাজ স্তব্ধ,
যেন মৃত্যু-পুরীর নীরব প্রহরীর দ্বার।

কালচক্র থামিয়া গিয়াছে, অনন্তের পথে,
আজি রজনী প্রভাতবিহীন রবে সাথে।

আলস্য ও ভীরুতা

পুঁথি যদি মোর ভাগ্য নির্ণয় করে,
পাপভার যদি পুরোহিত স্কন্ধে ধরে।
বৈদ্য যদি কয় বিধান,
কি ভক্ষ্য, কি পান,
তবে কেন আমি ভাবি অনিবার, ওরে?

ভাবিতে চাহি না আমি, এ বড় ঝকমারি,
পরের উপর ভর, এ তো বেশ কারবারি।
মুদ্রা যদি ঢালি,
চিন্তা যাক দূরে চলি,
তবে কেন করি মিছে মগজের মারামারি?

আলস্যের তরি বাহি, আমি দিশেহারা,
ভীরুতার শৃঙ্খলে বাঁধা এ জীবন সারা।
পরের ইশারায় নাচি,
পুতুলের মতো বাঁচি,
স্বাধীনতা? সে তো মরীচিকা শুধু, ছলনা ভরা।

যারা রক্ষক সেজে করে শুধু ভান,
ধূর্ততায় ভরা তাদের সবার প্রাণ।
দুর্বল আমরা হলে,
চুষে খাবে তারা ছলে,
এই প্রহসনই তাদের রোজগার বিধান।

চিন্তাহীন জীবন যেন স্রোতের শ্যাওলা,
যে দিকে স্রোত বয়, সেই দিকেই চলা।
আত্ম-অন্বেষণহীন,
পরের পদানত দিন,
এ কেমন দাসত্ব, এ কেমন খেলা?

স্ব-শাসন হারায়ে যে খোঁজে পরিত্রাণ,
সে তো বন্দি রবে চিরকাল অজ্ঞান।
পরের হাতে ডোর,
নিজের ঘরেই চোর,
এ কেমন বিধি, এ কেমন পরিহাস, হায় ভগবান।

পরনির্ভর জ্ঞানের পিঞ্জর

দেখিনু এক জ্ঞানী পণ্ডিত মহাশয়,
পরের বুলি আওড়ে সদাই রয়।
নিজ চিন্তা নাহি জাগে,
ভয়ে ভয়ে সদা থাকে,
"প্রভু" "প্রভু" রবে স্তুতি গায় অতিশয়।

একদিন সে পণ্ডিত চলিল দূর দেশে,
গুরুর বচন পুঁজি করি' পরম হরষে।
পথে ঘন ঘোর বন,
শুনি' ব্যাঘ্রের গর্জন,
"গুরু" "গুরু" রবে কাঁপে যেন তরাসে।

ব্যাঘ্র কহে, "ওরে মূঢ়, কি তব তত্ত্বজ্ঞান?
নিজ বুদ্ধি নাহি, শুধু পরের গুণগান?
যদি থাকিতো মগজ,
পাইতিস নিজ খোঁজ,
এবে মোর ভক্ষ্য হবি, এই তব বিধান।"

শুনি' পণ্ডিত কাঁপে থরথর করি',
মনে ভাবে, "কি করিব, যাই কোথা ধরি'?
যদি থাকিত সাহস,
খুঁজিতাম নিজ রস,
এবে তো মরণ শুধু, নাহি কোন তরি'।"

পরের বুলি, ওরে ভাই, কতকাল ধ’রে,
বন্দি রবি’ এই ভবে, আঁখি মুদে’ রে।
‘আমি’র ডঙ্কা তোলো,
নিজে আলোয় চলো,
জ্ঞান-সূর্য উঠুক হৃদয়-গগনে তেজে রে।

স্বপ্নের জনপথে হাঁটা রাজা

স্টেশনের গন্ধমাখা লাল বেঞ্চির ওপরে বসে
চা-ওয়ালার হাত ঘুরছে—কাঁচের গেলাসে চুমুক দেয়া মানুষ
বদলে গেছে মুদ্রা।
পাড়ার বাতি নিভে গেছে চৌরাস্তার মোড়ে,
আঁধারের ঘ্রাণ পেতেই ফেরিওয়ালা হাঁক পাড়ে—
“সস্তা কাপড়! শীতের কম্বল!”
কাপড়ের আড়ালে উলঙ্গতার গল্প জমে ওঠে ধীরে।

দেয়াল লিখন—সাদা চুনকাম করা ইটের উপরে
জড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক পোস্টার—
হঠাৎ সেখান থেকে ঝুলে পড়ে মুখচোরা সত্য।
হাততালি-খাওয়া কিছু কান, ডানপিটে জিভ, আর
রৌদ্রে-পোড়া কয়েকটা মুখ
ঝুলে থাকে—
মহামারির বেকারত্বে।

কথা ছিল

কথা ছিল,
দুয়ারে ঝোলানো আলপনা হবে ছিন্ন পাতা আর কাশফুলের—
মাটির উনুনে আগুন ধরিয়ে
প্রাচীন চাঁদ কেবল শোনাবে রূপকথা।
কথা ছিল, চাঁদের আলোয় টিনের চালা মাখবে
একটি অশ্রু, একটি হাসি, একটি মায়াবী জোনাকির গান।

অথচ শোনো,
আজ খড়ের গাদায় ছাই চাপা পড়ে আছে;
আলপনা মুছে গেছে ধোঁয়া আর তেলের দাগে।
চাঁদও কেমন যেন কণ্টকিত,
তার আলো বুনো ঘাসের ধার ধরে
শুধু জমা করে হাহাকার।

কথা ছিল,
আমাদের শস্যক্ষেত হবে এক সোনালি মায়ার নাম—
শালিকের ঝাঁক নেবে তার কসম,
ধুলোমাখা গরুর গলায় বাঁধা ঘণ্টার শব্দে
বেজে উঠবে লোককথার সুর।
অথচ আজ, চক্রাকারে ধান কাটা হয়
কিন্তু মাড়াইকলের শব্দে মিলিয়ে যায় বৃষ্টির গান।

কথা ছিল,
শহরের বাইরে রাখালিয়ারা বেঁধে দেবে এক
গল্প-বোনা জীবন।
তাদের বাঁশির সুরে বয়ে যাবে সন্ধ্যার মেঘ।
অথচ কোথায় বাঁশি?
রাখালের হাত কেবল বয়ে বেড়ায়
মাটির শুকনো ধুলা আর
আকাশের ফাটা রোদ।

কথা ছিল,
তালগাছের ছায়া মেপে মেপে শিশুরা দৌড়াবে—
তাদের মায়ের আঁচলে বাঁধা থাকবে
একটি অদেখা স্বপ্নের গল্প।
অথচ এখন
তালগাছের নিচে শিশুদের মাথা ঢেকে যায়
লোহার শিকের ছায়ায়।
তাদের খেলাঘরে আগুন দেয়
অচেনা এক নগর।

কথা ছিল,
ভাঙা নৌকোর পাল হয়ে উঠবে আমাদের ভাষার প্রতীক,
আমাদের পায়ে থাকবে জলকাদার স্বচ্ছ প্রলেপ।
আমাদের দেবতা হবে
দেখতে একদম আমাদেরই মতো—
তৃষ্ণার্ত, রোদজ্বলা, ক্লান্ত।
অথচ দেবতার নামে আমাদের হাড় পর্যন্ত
তুলে নেয় আর্য বণিকেরা।

কথা ছিল,
আমাদের ধর্ম হবে মাটি আর রোদ্দুরের মিলন।
আমাদের জীবন হবে নদীর ধারে
অলস দুপুরের ছায়ার মতো সহজ।
অথচ এখন সবুজ মাঠ
নেমে আসে নগরীর তপ্ত ইট আর লোহার বুকে।
তরুদের সংসার ভেঙে যায়
মুখ থুবড়ে পড়া কাঠের ভাঁড়ারে।

তবু স্বপ্ন বুনি,
স্বপ্নের খেত চাষ করি, দিনের পর দিন,
ফসল বাঁধি স্বপ্নের আশায় আশায়।
কিন্তু হাওয়ায় উড়ে যায় ফুলের রং,
মনের মাঠে ফেলে রেখে কাঁটাশুঁড়।
দেখি দূরে স্বর্ণের পাহাড়,
আমার হাতে শুধুই মুঠোখানেক মাটি।
স্বপ্নের নদীতে ভাসে...ভাসে জাহাজ,
আমি তীরে দাঁড়িয়ে শুধুই চাই।

ভণ্ডামির কার্নিশে বসা কাক

সকালবেলায় ডালের খোঁপায় চড়ুই গুনগুন করে,
মসজিদের আযানের ধ্বনি ঢেউ তোলে বাতাসে—
সেই বাতাসে এখনও চা-পাতার গন্ধ,
বড় রাস্তায় গাছপালা ঝাড়ু দেয়ার শব্দে
মিশে যায় শালিকের তিরতিরে ডানা।
কিন্তু তুমি শুনছ না, প্রিয়,
আমাদের উঠোনে আজ আর মঙ্গলঘট নেই।
হিন্দুরা ঘরে ঘরে আলো জ্বাললে
তার চেয়েও বেশি রক্ত জমে যায় খবরে।

আমি ভাঙা কাঁচের গ্লাস হাতে বসে দেখি—
এক দেশের জোনাকি আরেক দেশের প্রান্তে পৌঁছে
অন্ধকার আলোকিত করে,
কিন্তু ঈশ্বর ভেঙে দু’ভাগ।
এমনকি স্রোতস্বিনী নদীও মাঝখানে লালিমা বয়ে আনে,
জলে আর কেউ খোঁজে না চাঁদের প্রতিচ্ছবি।
তুমি বলতে পারো, কার ঈশ্বর বড়?
কেন এ ঘাসে মিশে থাকে ভয়?

দুপুরে টিফিন ক্যারিয়ারের খোলায়
বাড়ির দেয়ালে ছায়া ফেলে জানলার গ্রিল—
মাঝে মাঝে মনে হয় ঈশ্বর সেই গ্রিলের মতোই,
তুমি ছুঁতে পারো না, কিন্তু
সে তোমাকে আটকে রাখে।
একদিকে বিসর্জনের উলু,
অন্যদিকে মাতমের বিষণ্ণ ধ্বনি;
এই দ্বন্দ্বের মাঠে দাঁড়িয়ে
তুমি আমায় কী বলবে?
ঈশ্বরের নাম নিলে কেন খোলা আকাশ ঢেকে যায়?

বিকেলবেলা লুঙ্গি পরা ময়লাচাটা লোকেরা
রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসে,
তাদের ঠোঁটে কোলগেটের বিজ্ঞাপনের মতো রঙিন বিভ্রম,
কিন্তু হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্ধকার।
তুমি কি জানো, এখানে গান গাওয়া একরকম অপরাধ?
মন্দিরের ঘণ্টা বাজালে হাত কাঁপে,
আর এদিকে মাইক ফাটানো সুরে
শুনতে হয় অনুপ্রেরণার কথা।

রাতে জানলার পাশে হাঁড়ি-কলসি রেখে
আমি এক টুকরো চাঁদের দিকে তাকাই।
তুমি বলতে পারো, কেন চাঁদের গায়ে দাগ?
কেন আমাদের ইতিহাসে এত ছিদ্র?
কেন আমাদের মন এই ইঁটকাঠের শহরের মতো
ভাঙাচোরা, অসম্পূর্ণ?
তুমি বলতে পারো, এই শহরের কুকুরেরা কি স্বপ্ন দেখে?
এই বেড়ালগুলো কি কখনো বলে,
‘‘এই বাঁচার পথে ভুল আছে?’’

তাহলে শোনো—
কুকুরেরা কি কখনো কবিতা লেখে?
বেড়ালগুলো কি প্রতিবাদ করে মিছিল করে?
জোছনা ভেজা রাতে কার্নিশে বসে থাকা কাক
গণতন্ত্রের ধ্বজা ওড়ায়, এ কেমন পরিহাস!
ধর্মের ধ্বজা হাতে হানাহানি চলে দেশে,
ঈশ্বর কি শুধু তাদের যারা মারতে পারে বেশে?
মানুষের পরিচয় আজ শুধু ধর্মের ফোঁটা,
পায়ের তলার মাটিও আজ বড় বেশি নড়বড়ে।
তবুও আকাশ ডাকে, পাখি ডাকে, ডাকে ভোরের আলো,
মিথ্যার বেসাতি ভেঙে, সত্য হোক জয়যুক্ত,
একদিন ঠিক ভেজাবে মাটি শ্রাবণের বৃষ্টি অবিরত।

মৃত্যুর আগে মৃত্যু

একদিন মরিতে চাই
মৃত্যুর আগেই—জানিতে চাই
কে আমায় ভালোবাসে;
বাতায়নের ধূসর আলোয় দিন যখন ভাসে,
ট্রামের শব্দে কাঁপে শহর—থার্ড স্ট্রিটের মোড়ে;
জীবনের রিকশা চলে ঘুরিয়া ফিরিয়া ঘোরে
বেঞ্চিতে বসিয়া আমি দেখি এই শহর জনপদ কাল;
কাহারা যেন চলিয়া যায়—হাতে তাদের টর্চের আলো অসামাল—
অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে।
একবার মরণের দিকে চেয়ে
বুঝিতে চাহিয়াছি আমি প্রেমের গভীর;
কত রাত্রি চলিয়াছি—কত সকালের নীর
ভিজিয়েছে চোখ—তবু জানি নাই কারে;
আজ তাই মরিতে চাই—যেন কেহ ধরে
আমার নিথর দেহ কাঁদিয়া অস্থির
হৃদয়ের গভীর।
ফ্ল্যাটের জানালায় দাঁড়াইয়া দেখি
সন্ধ্যা আঁধারে ঢাকি
নামিয়া আসে ধীরে।
পাখিরা ফিরিয়াছে ঘরে—
থামিয়া গিয়াছে ট্র্যাফিকের শব্দ সব;
কেহ নাই—শুধু আছে নীরব গরব
মৃত্যুর—যে মৃত্যু আমি খুঁজিতেছি আজ;
হয়তো বা কেহ আসিবে—করিবে বিরাজ
আমার শয্যার 'পরে—চুমায় ভরিয়া।
তবুও কি জানা যাইবে—কে আমায় নিয়া
যাইবে চলিয়া অনন্তের পথে?
কাঁদিবে কি কেহ মোর মৃত্যুর শোকেতে
নীরবে একাকী?
সব কিছু দেখিবার তরে আমি থাকি
চেতনার কোণে;
শুনিব কাহার কণ্ঠ প্রেমের স্বপনে
কাঁদিয়া উঠিবে।
হয়তো বা কেহ নাই—কেহ না আসিবে
জানালার ধারে;
শুধু রাত নামিবে আঁধারে
নিঃশব্দ পৃথিবী।
কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়ায়ে তখন শুধু দেখি অনুভাবী—
যে জীবন চলিয়া যায় তা'র কোনো মানে নাই;
মৃত্যুর আগেই মৃত্যু চেয়েছিলাম—তাই
জানিয়াছি এ কথা।
এখন আমার চোখ দিয়া শুধু অবিরাম বৃষ্টির ব্যথা
ঝরে পড়ে ধীরে;
কেহ নাই—কেহ নাই—শুধু রাত নামে গভীরে।

শীতের প্রত্যাবর্তন

দিগন্তের শেষে—যেথা সরিষার ক্ষেত
হলুদ আভায় কাঁপে—শীতের নিশ্বাসে—
সেইখানে ঝরাপাতা অস্থির বৃক্ষের নিচে
বসন্তের স্বপ্ন আজ ফিরে আসে—আসে—

ধীরে ধীরে জেগে ওঠে—প্রভাতে।
শীর্ণ ডালে বসে থাকে শালিক একা
চেয়ে দ্যাখে; কাঁচের মতন শীত আর
ধূসর আকাশে মেঘের অদ্ভুত মুখ দেখা।

শুষ্ক ডালপালার নিচে যেন রূপার কণিকা
আর হীরকের মতো তুষারের বিলাপ;
কঙ্কালের ছায়া—স্তব্ধতা—
শীতল মাটির গন্ধ—কাশফুলের তাপ।

কয়েকটি কৃষক যেন দেবতার মতো;
মাঠের সন্তান তারা: জীর্ণ অবিরত;
চোখের কোটরে তার: অনাহারের ছায়া,
পায়ের নিচেতে মাটি: বরফের মতো শক্ত।

সেখানে নিঃসঙ্গ বায়ু শীত হয়ে বৃষ্টি হয় ফের,
পাতাদের কম্পনেতে কোন স্বর নাই;
তবু তারা টের পায় বসন্তের মৃদু আগমনে
মরণের শেষে জীবন আসিবে ভাই।

সেইখানে একাকিনী কয়েকটি প্রজাপতি
শীতল আলোর নিচে ডানা আর রঙের সংকেতে
নিঃসঙ্গ; প্রকৃতির বুকে তারা উড়ে যায়
জীবনের আর মৃত্যুর সীমানা ছুঁয়ে আর উঠিবে না মেতে

গভীর বিষাদ ক্রমে টানিতেছে তাদের
তুষারের শয্যায় শুয়ে আর নিরুদ্ধ ঘুমে
স্বপ্ন নেই; এই শীত পৃথিবীর মাঠের হিমে দিয়ে
ওই শূন্য আকাশের নীলিমায়—তমসে

ক্লান্ত পথ নিয়ে যায় বিজন বনে—অন্ধকারে।
বসন্তের প্রতীক্ষার সোনালি আলোর দিন
শেষ হ'য়ে গেছে সব; পাখনায় মৃত্যুর কালো মেঘ,
পায়ের নিচেতে শুধু বরফ—কুয়াশা—শীত—লীন।

পুনর্মিলনের শূন্যতা

নীলাভ সন্ধ্যায় তুমি এসেছিলে আবার
ক্ষয়িষ্ণু কলেজের সিঁড়িতে —
দশ বছর পরে; তোমার চোখে ছিল
অস্তগামী বেগুনি আলোর ছায়াচ্ছন্ন স্মৃতি।
আমি দেখেছিলাম তোমার হাতের আঙুলে
কালচক্রের দাগ — সময়ের ধূসর আঁচড়;
তুমি দেখেছিলে আমার চুলে পাকা রুপোর শিকড়।

কত অচেনা চেনা মুখের ভিড়ে
আমরা দুজন হারিয়ে গেছি নিজেদের খুঁজে;
তোমার আঁকা ছবির রঙে আমার আইনের বই
মিশে গেছে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায়।
চাঁদের আলোয় বাগানে দাঁড়িয়ে
আমাদের ছায়া মিলেছে অনন্ত নীরবতায়,
যেখানে কিশোর প্রেমের স্বপ্ন ছিল একদা।

তোমার ঠোঁটের স্পর্শে জেগে উঠল
মৃত বসন্তের পাখি;
কিন্তু সেই পাখি জানে
এই চুম্বন শেষ হবে শীতের কুয়াশায়।
পুরোনো ফ্ল্যাটে ফিরে
দেখলাম — আমাদের প্রেমের দেয়ালে
এখন শুধু ময়লা আর ফাটল ছড়ানো।

আমরা দুজন জড়িয়ে ধরলাম
একটি মরীচিকার ছায়া;
ভোরের আলোয় দেখি —
তোমার চোখে জমে আছে অশ্রুর শিশির,
আমার বুকে শুধু খালি খালি।
দশ বছরের বিচ্ছেদ
এক রাতেই মুছে দেয়নি আমাদের দূরত্ব।

বোধের কিনারে আমি একাকী

আলো-অন্ধকারে পথ চলি একা,
মাথার ভিতরে বোধ দেয় দেখা।
প্রেম নয়, শান্তি নয়,
শুধু বোধ জন্ম লয়,
বরবাদ আমি, এ কেমন ধাঁধা!

পেঁচা ডাকে, ইঁদুর ঘোরে মর্গ-দ্বারে,
আমি খুঁজি সেই মৃত্তিকার ঘ্রাণ তারে।
হাড়হাভাতের মতো,
ঘুরি একা অবিরত,
বরবাদ আমি, প্রেমের পাথারে।

মেয়েমানুষ, ঘৃণা, উপেক্ষা, ভালোবাসা,
নক্ষত্রের দোষে শুধু প্রেমেরই দুরাশা।
ধুলো আর কাদা,
সবই আজ ধাঁধা,
বরবাদ আমি, এ কেমন তামাশা!

লাঙল ধরি নি, জলও টানি নি আমি,
তবুও কেন এ একাকিত্বের গামী?
পানা আর শ্যাওলার গন্ধে,
জীবন কাটে নিরানন্দে,
বরবাদ আমি, এ কেমন পাগলামি!

সব দেবতার ছেড়ে আমি আসি প্রাণে,
হৃদয় কেন শুধু একা কথা বলে বনে?
ঘুম নেই, শান্তিও নেই,
শুধু বোধ জেগে রয় সেই,
বরবাদ আমি, এই বোধের টানে।

নিস্পন্দ দর্শকের পাপ

শুনেছি এক আজব খবর, বিশ্ব হবে লয়,
খারাপ লোকের কর্মে নয়, এ তো নিশ্চয়।
যারা দেখেও দেখে না,
যেন কুম্ভকর্ণের সেনা,
তাদের নিস্পন্দতায় ধ্বংসের অভিনয়।

বেড়াল হাঁটে পিঁপড়ে'র পিঠে, চোখ বুজে সব,
সিংহের গলায় বেঁধেছে যেন শিয়াল-রব।
কানকাটা ব্যাঙের দল,
করে শুধু টলমল,
তাদের মৌন মিছিলে ডুববে ভুবন অব।

কুমড়ো চালায় মোটরগাড়ি, শসা বসে পাশে,
বাঁধাকপি বাজায় বাঁশি, যেন স্বর্গ আসে।
মানুষগুলো নির্বিকার,
যেন কাঠের পুতুল আকার,
তাদের নিথর দৃষ্টিতে কালের স্রোত ভাসে।

হাতি নাচে ইঁদুরের সুরে, গাধা গায় গান,
মশা ওড়ে আকাশে, যেন সে প্লেন মহান।
মানুষ শুধু চেয়ে থাকে,
পাথর-চোখের ফাঁকে,
তাদের উদাসীনতায় বন্ধ সকল ত্রাণ।

তাই বলি ও ভাই সকল, চোখ মেলিয়া পেখো,
অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াও, ভয় পেয়ো নাকো।
নইলে এই পৃথিবী,
হারাবে তার গীতি,
নিস্পন্দ দর্শকের পাপেই ধ্বংস হবে দেখো।

সৈন্য-ছায়ায় শস্যের কান্না

আজকে আমি দেখিনু মাঠে, কী এক ঘোর!
সৈন্যদলের ছায়া, যেন মৃত্যুর ভোর।
ফসলগুলি স্তব্ধ,
বিক্রি হবে অবরুদ্ধ,
স্বাধীনতার শ্বাসরুদ্ধ, কান্না কঠোর।

হায়, আদিবাসী কৃষক, কী তাদের বেশ!
হাতে তাদের শস্য, মুখে নীরব ক্লেশ।
সৈন্যের ইঙ্গিতে,
বেচা-কেনা নিভৃতে,
যেন জীবনের মানে শুধু অবশেষ।

হলুদ ধানের শিষ, বাতাসে কাঁপে না আজ,
সৈন্যের বুটের তলে, ম্রিয়মাণ সাজ।
বিক্রির প্রহসন,
যেন এক বিমর্ষ মন,
কোথাও নেই কোনো গান, শুধু বিষাদ-কাজ।

আমি দেখিলাম, এক নীলচে মায়াবী পাখি,
উড়ে যেতে চেয়েও যেন পেল না মুক্তি ডাকি।
শস্যের গন্ধের মাঝে,
হৃদয়ের ক্রন্দন বাজে,
সৈন্য-ছায়ায় ঢাকা, জীবনের বাকি।

মাঠের পরে মাঠ, শুধু শূন্যতা হাহাকার,
সৈন্যের পদভারে, কম্পিত ধরণির পার।
বিক্রির এই খেলা,
যেন এক অন্তহীন ভেলা,
কোথাও নেই আশা, শুধু আঁধার অপার।

পুরস্কার-লোভী পুতুল

মাতা বলিতেন হেসে, "যদি হও সুবোধ,
পাইবে রসগোল্লা, জামরুল, কদলী অবিরোধ।"
করিলে যদি দুরন্তপনা,
পিঠে পড়িত বেত, যেন বজ্রাঘাত হানা,
মিষ্টান্নের স্রোতে যেন বাঁধা ছিল স্বর্গসুখ বোধ।

সেই থেকে মন জুড়ে এক অঙ্ক – লাভ-ক্ষতি,
পুণ্য করি, যদি মেলে সোনার পরিধি।
নরক-ভয় তুচ্ছ হলো,
স্বর্গ যেন বাঁধা র’ল,
কেবলমাত্র প্রাপ্তির মাপে বাঁধা ছিল গতি।

বিশ্ব যখন খুলল দ্বার, দেখি একি ভ্রান্তি!
সদাচারীর কপালে জোটে শুধু দুর্গতি।
পাপীরা হাসে উচ্চস্বরে,
রত্ন তাদের ভাণ্ডারে,
নীতি-কথা যেন এক পুরাতন কান্তি।

তখন বুঝলাম, শুধু ‘পেলে’ই জীবনের সার,
‘দেওয়া’টা নিতান্তই এক অর্থহীন ভার।
যেথায় শুধু সুবিধা পাই,
সে পথেই আমি চলি তাই,
ধর্ম-অধর্ম যেন দুই বিপরীত পার।

লোভের সূত্রে বাঁধা আমি পুতুল এক জন,
স্বার্থের ঘূর্ণিতে সতত ভ্রমি, নাহি দিশা যখন।
নীতি গেছে রসাতলে,
হিসাব শুধু চলে,
পুরস্কার-লোভী আমি, আত্ম-বিক্রীত ক্রীতদাস এখন।

শূন্যতার বসন্তযাত্রা

পদ্মার তীরে যখন বসন্তের নীলিমা জলে ফোটে,
আমার পদচারণায় তন্দ্রার মতো ঘন সবুজ পল্লবের ছায়া
বিস্তৃত হয় পথজুড়ে।

পলাশ গাছের রক্তিম মুকুল
বাতাসের মৃদু সুরে দুলছে, যেন মনে করায়—
সেই আলো, যা কাঁপছে আম গাছের কাঁচা পাতায়।
কৃষ্ণচূড়ার শিখা জ্বলজ্বল করে,
তবুও আমি একা।

কুঞ্জগুলির ফাঁক থেকে উঁকি দেয়
ঝুমকো লতার নীলাভ ফুল,
ধলেশ্বরীর ঢেউয়ে মিশে যাওয়া রঙের মতন।
বকুলতলার ঘাসে পায়ের স্পর্শে
বসন্তের সুর বাজে, মেহগনির পাতার সোহাগে
জমে থাকা শিশির মুক্তার মতো ঝিলমিল।

আমি এগোই—যমুনার স্রোতে
খেলে বেড়ায় বুনো হাঁসের পাল,
কদম্ব ফুলের কোমল ঝিলিক যেন
আমার শূন্য হৃদয়ে সোনালি মোহ বুনে।
মাগো, বসন্তের সন্ধ্যায়
কিশোর-কিশোরীদের কান্না শুনি,
তাদের মনের গভীর আশা
আমার নিঃসঙ্গতাকে তীব্র করে তোলে।

লিচুর ডালে ছোট ছোট ফলের হাসি,
কাঁঠালিচাঁপার ছায়ায় শিউলির অলঙ্কার,
ফুলের বনে মৌমাছির গুঞ্জন
সবকিছু যেন কোনো ছায়ালোকের গল্প।
শীতলক্ষ্যার তীরে ঢেউয়ের মাতাল সুরে
আমি যেন নিজেকে হারাই।

তরুণ তৃণভূমির ঘাসফড়িং
লাফিয়ে বেড়ায়, ফড়িংদের খেলা
পুকুরপাড়ে রঙের মেলা সাজায়।
তবুও আমার পথ থামে না।

তালগাছের সোনালি মুকুলে মৌমাছির গান
আমার শূন্য হৃদয়ে স্মৃতির প্রতিধ্বনি তোলে।
জোনাকি পোকা রাতের আঁধার ফুঁড়ে
মুক্তোছড়ার আলো জ্বালে,
তবুও আমি অন্ধকারে।

গ্রামের পথে কৃষকের স্মৃতির চোখ,
তরুণ-তরুণীর প্রেমের নীরব আলাপ
আমার পাশ কাটিয়ে যায়।
বসন্ত আসে, বসন্ত যায়—
তবুও আমার যাত্রা শূন্য,
আমার বসন্ত নির্জন।

শীতের পথে

একটি মৃত শাখায় থেমে আছে সময়—
অথবা আমি, তোমার সঙ্গে, শীতালু গাছের পাশে দাঁড়িয়ে।
তুষারে ঢাকা সারা পৃথিবী,
আর আমি হাঁটছি, একা, তৃষ্ণার্ত,
কবিতার পুরনো কষ্টের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া,
যেখানে গাছের শাখাগুলির নিথর পাঁজরের মতো
সামান্য বাতাসেও হিমের গান শুনতে পাওয়া যায়।
চোখে যেন একরাশ চুপচাপ গীত বুনে যায়,
গাছের সাদা তুষারের স্তূপে ভাসে নিঃসঙ্গতার মুখ,
আর ঝরা পাতাগুলির স্তূপে দাঁড়িয়ে,
তুমি নেই, আমি আছি, অথচ পৃথিবীটা একতরফা,
শুধু হিমের প্রথম সূর্যরশ্মি
গাছের শাখায় গড়িয়ে যায়,
একটি গাঢ় তন্দ্রায় ঢলে, যেই তন্দ্রা
সবকিছু মুছে দেয়, কেবল শীত।

এমন কোনো ফুল নেই, যেখানে গলে গিয়ে জমে না প্রেমের শুকনো অশ্রু,
প্যানসি ফুলের কাঁপতে থাকা ঠান্ডা দেহ,
পৃথিবী কাঁপে, হারিয়ে যায় গভীরে,
তুষারে ঢাকা ফুলগুলোর মতো,
অথবা হিমেল রাতে তোমার চোখে হারানো ভালবাসার স্মৃতি।
ফুলের সুগন্ধ যেমন একে একে গায়েব হয়ে যায়,
এভাবেই পৃথিবী, এই শীতের শহর,
আমাদের ইতিহাসের মতো মুছে যেতে থাকে।

হিমাঙ্গ নদী যেন মুছে যাওয়া জীবনের গতি,
তারা চলে, থেমে থেমে,
যেন কখনো ছিল না কোনও আশা,
তুষারের মধ্যে নদী চুপচাপ চলে যায়,
আর তার ভেতর বয়ে যায় এক শূন্যতা,
যার প্রতিধ্বনি হিমালয়ের ঠান্ডা বাতাসে মিলিয়ে যায়।
একটা দুঃখ, এক অসমাপ্ত গান,
এবং হিমাঙ্গ নদীর জল,
যতটা দূরে চলে যায়, ততটা আমাদের অতীতের মূর্তি হয়ে ফিরে আসে।

তুমি, আমার প্রেম,
যেখানে তোমার হাতের সান্নিধ্য হারিয়ে গেছে,
হিমেল রাতে আমার হৃদয় জমে যাওয়া বরফের মতো,
এবং আমাদের কথা তুষারে হারিয়ে যায়,
শীতের মধ্যে আমরা,
একাকী,
হয়তো একমুঠো কষ্টের খোঁজে,
যেখানে কেবল শীত,
আর কিছু নয়।

তুমি নেই, কিন্তু হিমেল রাতের ভেতর
এটি যেন এক গভীর রহস্য হয়ে যায়।
একটি বাঘের মুদ্রা,
একটি অসমাপ্ত কবিতা—
বিষণ্ণতার কোনো শেষে নেই,
শুধু গাছের শাখায় বসা পাখিদের
ভাসমান অস্তিত্ব,
যাদের ডানা ক্ষতবিক্ষত,
যাদের স্বপ্ন
আমাদের মতো—
অদৃশ্য, শীতের মধ্যে ডুবে থাকা।

শীতের শূন্যতায়,
আমি আমার পথ চলি,
ধীর পায়ে,
আমার কাছে কিছু নেই,
শুধু শীত।
এবং তোমার মুখ,
যেখান থেকে সবকিছু হারিয়ে গেছে,
মুছে গেছে একসময়,
এমনই পৃথিবী,
এমনই আমাদের ভবিষ্যৎ।

ফাঁকা রাস্তার নিচে শিশিরের আড়াল

কোথায় যায় রাতের বেলুন?
গ্যাসবাতির মতো ফাঁপা, তেলের শিশিতে জমা শীতের শ্বাস
এ শহরের শিশুরা—তাদের ঘুম আসে না।
একটি গর্তমুখী রোদচশমা টানে,
ময়লার পাহাড়ে নক্ষত্র খোঁজা তাদের খেলা।

দিনের বুকে, জেগে ওঠে এক ভাঙা খেলনাঘর
জীবনের ভিতর খুঁজে পায় না সন্তর্পণে চুরি করা জোনাকি।
হাতে লেগে থাকা সস্তা রঙের ঘ্রাণ ভাসিয়ে নেয় নদীর পারে।
তাদের কোনো নদী নেই, আছে মরা ধুলোয় জমে থাকা কালো জ্বর।

তাদের কান্না জমে থাকে কাচভাঙা চাঁদে,
একটি পলিথিনের বৃষ্টিতে ভিজে থাকা সূর্য
যেন জাগিয়ে তোলে সহস্র প্রশ্ন—
“আমাদের আকাশ কোথায়? আমাদের মাটি কই?”
কোনো উত্তর নেই, শুধু পাতাহীন গাছের নিচে ছায়াহীন চিহ্ন।

তারা ছুটে চলে—ভাঙা জুতোর ভিতর বৃষ্টির শব্দ
তাদের সাথে থাকে খাদের কিনারায় দুলতে থাকা বাতাস।
তারা চোখ মেলে চায়, পোড়া শালপাতার মতো ধূসর স্বপ্ন
তাদের ত্বকের ভাঁজে জমে থাকে জানালার বাইরে ঝুলে থাকা ধোঁয়ার গন্ধ।

তবু, জীবনের ভিতর একটি রাস্তায় রেখে আসা পায়ের ছাপ
তাদের স্বপ্নে জাগায় আলুর খোসায় আঁকা দূরন্ত কবিতা।
তারা খুঁজে ফেরে ভাতের ফাঁকা থালায় জেগে থাকা পূর্ণিমা।
তাদের জীবন এক অন্ধকারে বাঁধা আলোকরেখা,
যেখানে চিমনির ভাঁজে শুয়ে থাকে সূর্যের হিম শ্বাস।

শেষ রাতে, ফুটপাথের নিচে জমা রুপোর জল
তাদের ডাকে, ঝুলন্ত কুয়াশার কাঁপন বলে,
“তোমাদের জীবন ছুঁতে পারে না কেউ,
তোমরা জলজ মেঘের সন্তান।
তোমাদের ক্ষত থেকে জন্ম নেয় নতুন সকাল।”

নীরব কলমের যন্ত্রণা

বলো, কতটুকু চুপ থেকে মরে যেতে হবে?
খামোশিতে ভরা নদীর তলায় এক জীবন,
গলানো কাঁপানো পাহাড়ের নিচে,
হায়, আমার কথা শুনবে না তুমি।

জীবন এক পাথরের ঠাণ্ডা ছায়া,
প্রশ্ন ছেড়ে আসে অশ্রু;
অলস শরীর যেন সিংহের মতো
ফাঁকা মেঘের নিচে হাঁটে,
তবু মনে মনে সজাগ, পুড়ছে আগুন।

বলো, তুমি কি জানো?
এতকাল যে দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম,
তার সামনে ঝড়ের আওয়াজ কাঁপে
সেই সব শব্দ, মুখে লুকিয়ে, লুকিয়ে,
তবু বাঁচতে হয়।

আমাদের চুপ থাকাও মৃত্যুর মতো
তবুও, তবুও নিরবতা মনে জ্বলে!
প্রতিটি শব্দ আজ মুখের ভিতরে অবরুদ্ধ,
জীবন ভয় পায় না, আর থামে না,
কিন্তু মুছে ফেলো সব চিন্তা,
আমাদের হাতে কিছুই রইলো না।

বলো, এখন কি কিছু বোঝা যায়?
এই কষ্টের পেছনে লুকিয়ে এক দাঙ্গা,
প্রচণ্ড নির্লজ্জে উঠে আসে দুঃস্বপ্ন,
এবং তখনই, পৃথিবী বেঁচে থাকে আমাদের কথায়।

বৃষ্টির পরে গ্রামে ফিরেছি

এই চিঠি কেমন করে শুরু করব জানি না,
তোমার নাম লিখতে লিখতেই কাগজের কোণে শালিক বসে পড়ে।
হয়তো তারও কিছু বলার ছিল—
আমাদের স্বপ্নগুলো ধানখেতে পড়ে থাকা নীল পলিথিনের মতো,
পায়ে লাগে, কেউ কুড়োয় না।
রোদ পড়ছে, গঙ্গাজল শুকিয়ে যায় ঠোঁটের কোণে।
তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
পানসে হয়ে আসে মুড়ির বাটি,
পাশের বাড়ির শীর্ণ নারকেল গাছ
আমাদের জীবনের মতোই নিঃস্ব,
তবুও দাঁড়িয়ে আছে, পাতাগুলো শুকনো চিঠির মতো নেমে আসে।

শুনেছ কি, মন্দিরের ঘণ্টার শব্দটা কমে এসেছে
আর ইমাম সাহেবের মাইকের আওয়াজ
কতটা নিশ্বাস চুরি করেছে আমাদের?
তুমি কি জানো, আমাদের রাস্তাগুলোও পাল্টেছে—
তোমার পায়ের ছাপগুলো ঝাপসা,
আজকাল পিচ ঢালা।
যে কুলুঙ্গিতে লুকিয়ে আমরা চুমু খেয়েছিলাম
সেখানে আজ দেয়াল লিখন,
"ধর্মের নামে বিজয় আনো।"
তোমার যাওয়ার পর থেকে এখানে বাতাসে গন্ধ—
পোড়া গাঁদা ফুল আর ভাঙা কঙ্কালের।

তোমার পাঠানো শেষ পূজোর কার্ডটা
আজও রাখা আছে চেয়ারের তলে।
কতবার তুলতে গেছি—
ভাবি, সেটা হয়তো তুমিই।
পূজো আসছে, আর কি কেউ বাজিয়ে দেখবে
ঢাকের তালের ভেতর গোপন চুম্বন?
আমাদের আসরের থালাগুলো এখন পড়ে থাকে,
শুধু মাংসের ঝোলের পিঁপড়ের লাইন।

তুমি কি ফিরে আসবে কোনোদিন?
যদিও জানি, ঘুড়ির মাঞ্জাটা কেটে গেলে
আর আকাশে ভাসে না।
তোমার ছায়া আজ আর বটগাছের নিচে পড়ে না।
বৃষ্টির পরে গ্রামে ফিরেছি,
তোমার ছায়া নেই আর বটগাছের নিচে।
শুধুই পড়ে থাকা পূজোর কার্ড,
হিন্দুদের শেষ হয়ে যাওয়ার গল্প,
এই পৃথিবীতে আর কারো কিছু যায় আসে না।

সুবলের বিদায়

স্বপ্নাতীত চৈত্রের এই দেশে সুবলেরে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
ধর্মের কশাঘাতে শেষ হল সেই দিন — গিয়েছে যে শূন্য — বিষাদ ঘরে,
অথবা মুক্তির স্বাদ পেতে দেরি হবে কিছু কাল — বিশ্বাসের এই মাঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ দেশের কয়েকটি স্মৃতির তরে
নিঃশব্দ আর নিরাশায় সুবল চেয়ে রবে কিছু কাল অতীতের কোলে,
আর সে সোনালি স্বাধীনতা পাখা মেলে দূর থেকে আজো কি দেশের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই অচেনা ভারতের পানে আজো চলে যায় প্রাণ সীমান্তের মতো হলে
ধর্মের কঠিন শিলায় মানবতার চোখ বিশ্বজনীনতার দিকে আজো চায়?
বিদায় হলে? বিবেক কি আজো বাঁধে না কি মনের নিবিড় ঘন ডালে,
আশা ভঙ্গ হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় স্বপ্নের অতীত বাতাসে –
কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ ইতিহাসের ঝরাপাতা জ্বালে
মানবতার চিতায় — স্বপ্নগুলো উড়ে যায়… ঝরে পড়ে… মরে থাকে ত্রাসে –

নাটকের মঞ্চে কাদম্বিনী

জানালার ধারে রাখা কাচের জগে জল ঢেলে দিই,
পড়ন্ত বিকেলের আলোতে ঝলমল করে সে—
একটা দেশ, যেন সেই কাচের জগ, ভরপুর জল,
তবু কেউ দেখে না তার ভিতরে জমে থাকা
ধুলোমাখা ইতিহাসের দাগ।

ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ড মুছে দিয়ে
নতুন কথার খোঁজ চলে।
মুছে যাওয়া চকছাপের মাঝখানে
কেউ কি দেখে,
নির্ভুল প্রশ্নটা ছিল কি না?
দেশের শুদ্ধ "ইমেজ" তো পবিত্র বোর্ডের মতো—
মুছে দিলেই সব ঠিকঠাক!

বিকেলের বাজারের মাংসের দোকানে
রক্তের গন্ধে মিশে যায়
মুদি দোকানের ধোঁয়া-ধুলো।
মাংস তাজা কি পুরোনো—
সেই প্রশ্ন যেন এক অমীমাংসিত তর্ক;
জানতেই কি হবে?
দেশের আস্তিনে "সম্প্রীতির" রুমাল,
রক্তের দাগ মুছে রাখাই শিল্প!

রেডিওর পুরোনো গান বদলে গিয়ে
নতুন ভাষায় ঘোষণা দেয়,
"এ দেশ অসাম্প্রদায়িক"—
কিন্তু মেঝেতে পড়ে থাকা সেই পুরোনো রেডিও,
তার শরীরেও কি কেউ শুনতে পায়
চিরচেনা ক্র্যাকলিং আওয়াজ?
"রেডিও বেঁচে আছে,"
এই কথাটাই তবু আমরা বলি, আর বিশ্বাস করি।

ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে
একাকী বস্তাবন্দি কুকুরটা জানে,
রাতটা ঠান্ডা হতে চলেছে।
বস্তার ভেতরে সেঁধিয়ে যায় সে,
যেন দেশের অন্তর্লোকে লুকিয়ে থাকা
সব কষ্ট, সব অত্যাচার।
কুকুর কি আর কিছু বলে?
বলা মানে তো বিপদ, বলা মানে
হাওয়ায় ছড়ানো গন্ধের দোষারোপ।

টেবিলে রাখা পুরোনো কাগজের স্তূপ থেকে
কোনো এক নোটিশ বেরোয়:
"তোমাদের সত্য বলবার অধিকার আছে,
কিন্তু দেশপ্রেমের দায়ে— চুপ থেকো!"
কাগজটা গুটিয়ে পকেটে রেখে দিই;
দেশপ্রেমের মূল্য জানি—
এ তো এক মঞ্চে বাজানো দৃশ্য।

আহা, কী সরল যুক্তি!
দেশ যেন নাটকের মঞ্চ,
সম্প্রীতি তার ঝালর—
নির্যাতন? সে তো নেপথ্যের কাহিনি,
ফাঁস হলে পাছে নষ্ট হয় "ইমেজ"!
কাদম্বিনীও তাই—
মরেও প্রমাণ করে, "আমি বেঁচে আছি, বেশ আছি!"

শহরের বিপন্ন বাউল

বুকের ভিতরে পুষি নক্ষত্রের মতো ক্ষত,
কান্না আমার—হলুদ পাখির গান,
শহরের রাস্তায় আমি—এক
বিপন্ন বাউল,
মৃত্যুর ওপারে আমি—
অপেক্ষা
করে আছি,
তবুও—
মানুষ এখনও—
পাথর ছুঁয়ে দেখে,
ঈশ্বর—
ঘুমিয়ে আছেন—
ক্লান্ত দুপুরে,
প্রিয়, এখন ভালোবাসার সময় নেই, এখন সময় আবার যুদ্ধে যাবার।

ডিসেম্বর উৎসব

তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—
বিজয় কি রক্তের ছাপ মুছে যায়?
মনের ভেতর এক ঝকঝকে চশমা—তাকে দিয়েছিলাম,
সে বলল, বিজয় নয়, ডিসেম্বর—
ডিজি জামিলের উৎসব যেন শীতের ভাঙা কাঁথা,
যার নিচে গা ঢাকা দেয় নতুন ইতিহাসের লজ্জা।

আয়নায় মুখ দেখলেই কি মানুষ নিজেরে চেনে?
পুরোনো দেয়ালের রং চটে গিয়ে,
সেখানে নতুন প্ল্যাকার্ড টাঙানো হয়েছে:
"ডিজি জামিল, আমাদের আলোকিত পথপ্রদর্শক।"
সকালে চা খেতে খেতে সেই প্ল্যাকার্ড দেখি,
কোনও এক দারিদ্র্যসীমার মতো যেন কফির দাগ লেগে থাকে,
আর মনে হয়, ১৬ ডিসেম্বর কি আমাদের শীতকাল?

পথে বেরোতেই দেখি—
ডিজি জামিল, মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসছে,
তার হাসি যেন ভাঙা ভাতের হাঁড়িতে পড়া জলের রোদ।
শহরের অলিগলিতে নাচের ধুন বাজে,
ডুগডুগি হাতে কেউ একজন ডাকছে,
তুমি কি এসেছো দেখার জন্য, কীভাবে স্বাধীনতা বিক্রি হয়?

একটি পত্রিকা, পড়া শেষ করলেই দেখি,
কাগজের কোণে লেখা,
“ডিজি জামিল আজ রাইফেল হাতে বিজয় গায়ক।”
তাকে বলি, নাচরে ডিজি জামিল, তুই পয়সা পাবি রে!
জীবনের চেয়েও বড়ো কি টাকার দাম?
জামিল হেসে বলে, "মঞ্চে গন্ধ আছে টাকার,
বিজয় তো আর দরিদ্রদের জন্য নয়।"

শেষ বিকেলে দেখি—
একটি ধূসর কবুতর, শহরের পুরোনো রেল স্টেশনে বসে,
আমাকে বলছে, "স্বাধীনতা কীভাবে দেখো তুমি?"
আমি তাকে উত্তর দিতে পারি না,
পাশ থেকে ডিজি জামিল বলে ওঠে,
"ডিসেম্বর উৎসব, আর কিছু নয়।"

টাকার গন্ধে ম ম করছে মঞ্চ,
পুরোনো শহরের গলিতে আজ বিজয়ের বাদ্যি বাজে না,
ডিজি জামিলের হাসি - আমি মমতা থেকে তুলে এনেছিলাম পরিহাস,
ডিসেম্বর উৎসব - যেন দারিদ্র্য রেখা আরও গভীর হলো।
আমার ডুগডুগি আজ নীরব, প্রশ্ন একটাই,
এই কি সেই মুক্তি, যার স্বপ্নে দিন আনি, দিন খাই?
নর্তকী নাচে, ডিজি হাসে,
কথা তোমাকে জানাব ভেবেছিলাম—সবই মিথ্যে।

বিভ্রান্তির ঘূর্ণি

আমার খুব মনে আছে একবার
দরজার পাশে রাখা গামছাটা হাতে নিলাম,
ভাবলাম—এটা আমার, কিন্তু আবার মনে হলো—
এটা হয়তো কারো বৃষ্টিজল মুছতে রেখে যাওয়া স্মৃতি।
গন্ধমাখা পুরোনো একটা সাদা পাঞ্জাবি দেখলাম আলমারিতে,
এটা কি বাবার, নাকি আমার কোনো হারানো দিনের?
বারবার দেখেও আমি ঠিক করতে পারি না,
আমার হাত কাঁপে—চোখে যেন আবছা হয়ে আসে সব।

বারান্দার মেঝেতে শুকোতে রাখা ধোয়া জামাকাপড়ের ভাঁজে
আমি খুঁজে পাই রোদ্দুরের কাঁচা গন্ধ,
কিন্তু আলাদা করতে পারি না—
ওটা রোদ্দুর, নাকি শালগমের মিষ্টি স্বাদ মেখে থাকা
বৃষ্টির দিনের কোনো পুরোনো দুপুর।
ওলকপির পাতার নিচে আমি দেখেছি একবার
ছোট্ট একটা মাকড়সা জাল বুনছে—
তাও মনে হলো, ওটা কি সত্যি মাকড়সা,
নাকি একাকিত্বে বোনা মানুষের অভিমানী দীর্ঘশ্বাস?

মাঝেমাঝে ভাঙা মাটির হাঁড়ির পাশে দেখি
বাতাসে দুলছে শুকনো তুলসীপাতা—
মনে হয়, এটাই কি জীবন?
নাকি এই জীবন মিশে থাকে পুরোনো মোমবাতির কুঁচকে যাওয়া অবশিষ্টে?
অন্ধকারে দুলতে থাকা জোনাকির আলোয়
আমার ছেলেবেলা ফিরে আসে,
তবুও আমি আলাদা করতে পারি না—
কোথায় ছেলেবেলা, কোথায় বার্ধক্যের ছায়া।

আমার পায়ের নিচে মচমচে শুকনো পাতা ভাঙে—
তার শব্দে মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ আমায় ডাকছে, হয়তো খুব কাছে থেকেও দূরে।
এটা কি মানুষের ডাক, নাকি বাতাসের দীর্ঘশ্বাস,
আমি ভেদ করতে পারি না।
বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে ধুলো জমা লাইনগুলোতে
মনে হয় যেন আমার হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো ফেরত পেয়েছি,
তবুও আমি বুঝি না—
কোথায় আমার কবিতা, আর কোথায় শুধুই লেখা।

একবার দার্জিলিং যাওয়ার টিকিট কিনেছিলাম,
শেষমেশ আমি জানালার ধারে বসে থাকলাম রাতভর।
বাইরে কুয়াশায় জোনাকির মিটমিট আলো—
ভাবলাম, জীবনটা কি কখনোই জানা যাবে না?
পুরোনো চিঠির ভাঁজে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসে
আমি খুঁজে পাই এক বেদনাময় ছবি,
যার রং নীল ছায়া মেশানো কষ্টের শিহরণ।

মৃত্যুর আগে একবার বেড়াতে যাব ঠিক করেছিলাম,
তবুও পথের বাঁকে জোনাকিরা হেসে ওঠে,
পুরোনো চিঠির ভাঁজে লুকানো থাকে দীর্ঘশ্বাস যেন,
যেন বেদনার রং নীল কষ্টের প্রগাঢ় ছায়া মেশানো এক ছবি—
কোথাও সময়ের স্রোতে ভেসে যায় কত স্মৃতি,
আমি শুধু নিঃশব্দ রাতে একা জেগে থাকি,
ভেদ করতে পারি না—কোনটা মায়া, কোনটা সত্যি।

হ্যালো, কেমন আছ?

হ্যালো, মাটির কলসিতে রাখা ভোরের জল,
খাঁজ-কাটা রোদের সুরভি মেখে ঘরে ফেরা কাক;
হ্যালো, শাঁখ বাজিয়ে ওঠা আলুনি হাতের পূজোর ঘণ্টা,
হ্যালো, রেললাইনের পাশের গাছেরা, যা জানে শুধু বাতাসের ভাষা;

হ্যালো, তোমাদের চুলার ধোঁয়া,
যা এখনও উড়ে যায় আকাশের নীল কুটিরে;
হ্যালো, পিঠার ভাঁড়ে জমা চাঁদের আলো,
বসে থাকে সোনালি বৃত্তের কোণে—এক টুকরো ইতিহাস;

হ্যালো, সন্ধ্যার আকাশে উড়ে যাওয়া গঙ্গাপাখি;
হ্যালো, ভাঙা রিকশার হুইল, যার গল্প জানে কেবল চাকা আর পথ;
হ্যালো, প্রতিমার গায়ের রঙ, যা খসে পড়ে যায়
ধুলো মেখে থাকা থামের গায়ে;

হ্যালো, তোমাদের প্রতিদিনের লড়াই,
মাটির মূর্তি ভেঙে গড়ার স্বপ্ন,
চুলায় বসা হাঁড়ি থেকে উঠে আসা ধোঁয়ায়
জমা বেঁচে থাকার অশ্রু;

হ্যালো, এই অপমানিত চিলেকোঠা,
যেখানে গল্পেরা থাকে একলা, নিঃসঙ্গ;
হ্যালো, কাশবনের মধ্যে লুকানো নদীর গান,
যা শুনতে পায় না শহরের হট্টগোল;

হ্যালো, রিকশাওয়ালার পূজো, ফুটপাতের দোকানদারের শ্রাদ্ধ;
হ্যালো, সড়কের ধারে বসে থাকা ভিখিরির আরাধনা;
হ্যালো, গলির মুখে থাকা মন্দিরের কাঁদন;
হ্যালো, নদীর তীরে ভাসমান শ্মশানের শান্তি;
হ্যালো, এই অসহায়, অবহেলিত, অপমানিত বাংলার হিন্দু, - কেমন আছ?

বিক্রির কাঠগড়া

ঘুম ভাঙে ঘড়ির কাঁটার শব্দে,
বালিশের নিচে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার
আলো খুঁজে বেরোয় এক চিমটি শীতলতায়।
রান্নাঘরে ফেলে রাখা পুরোনো হাঁড়ি,
তার গায়ে জমে থাকা তেলের প্যাচ
বছরের পর বছর ধরে গোপন কথা শোনে।

নগরীর রাস্তায় জমা জল,
পানিতে ভেসে ওঠা প্লাস্টিকের বৃত্তে—
একটি ছেঁড়া চুল বাঁধা থাকে,
যা বৃষ্টির মতো শীতল ছিল একদিন,
আর আজ এক নারীর দুঃস্বপ্নের দলিল।

ঘরের কোণে রাখা সাইকেলের চাকা,
যা একসময় ভোরবেলার হাওয়ায় ঘুরতো,
আজ তাতে জমেছে মরিচা।
বঙ্গ জননী সেই সাইকেলের মতো—
প্রতিদিন কারও পায়ের চাপে
ঘুরতে বাধ্য হয়,
কখনো সেতু পেরোয়, কখনো নদীর নিচে ডুবে যায়।

পাঠশালার বেঞ্চে ধুলো জমেছে,
বইয়ের পাতাগুলি ধীরে ধীরে পোকা কেটেছে।
বঙ্গ জননীর শরীরেও তেমনি পোকা কাটে,
প্রত্যেক রাতে
কোনো নব্য ধনী তার আঁচল চুরি করে।
বালিশের নিচে চাপা দেয় তার কান্না,
আর সে রাতে শহর লজ্জায় মাটিতে মুখ লুকায়।

বঙ্গ জননী আজ নগ্ন শহরের মতো,
প্রত্যেক রাতে ধর্ষিত হয় বারবার।
নীল আকাশ, রক্তাক্ত সূর্যের নিচে,
নারীদেহের মতো কাঁদে বঙ্গদেশ।
চুরি করা হয় তার স্বপ্ন, তার আশা,
বিক্রি করা হয় তার সৌন্দর্য, তার গৌরব।
বাজারে বিক্রি হয় তার অশ্রু, তার ক্ষত,
দামি দামে, সস্তায়, সব দামেই।

শব্দের শবযাত্রা

পাটখড়ির খাটিয়ার নিচে শুকোতে দেয়া নদী,
যার গায়ে দাগ শুকনো কচুরিপানার—
অমলিন জলশৈবালের ছায়া কি এখনও পড়ে?
চালাঘরের দরজা খুলে কে যেন তিরিশ বছর পরে
বেরিয়ে এলো; হাতে বাঁকা বাঁশের কঞ্চি,
কঞ্চির আগায় উড়ছে ছেঁড়া এক টুকরো আকাশ।

চায়ের ভাঁড় পড়ে আছে পুকুরপাড়ের শ্যাওলা-লাগা বালিতে,
মাটির তলায় লুকানো শিকড়ের মতো গোপন কথারা
মাটির ভাঁড়ের ফাটল দিয়ে ফুটে উঠতে চায়;
কে যেন ডাকে—
পাড়ার বাঁশঝাড়ে চুপচাপ বসে থাকা শালিকটি
এখনও কি শিখেছে কথা বলার ঝুঁকি?

ঝুলঝাড়ুর মাথায় জমে থাকা ধুলোর গন্ধে
তাকিয়ার নিচে রেখে আসা স্বপ্নের চাবিগুলো
চোরের মতন চেঁপে আছে—
প্রতিবেশীর দাওয়ায় রাতের বেলা আলো জ্বালানো নিষেধ।
মোমবাতির জ্বলন্ত সলতেয়
অন্ধকারে পুড়ে যায় ভবিষ্যৎ রাত্রিগুলো।

কলার মোচার ভেতরে লুকোনো কীটের মতো
স্বপ্নরা গুনগুনিয়ে বলে—
এই ঘরে কথা বলা বন্ধ।
শব্দের বদলে শ্বাস ফেলে যায়
ঘুণে ধরা বাঁশের বেড়া;
বাঁশঝাড় থেকে বাতাসে ভেসে আসে
একটি মূক স্বরের চিৎকার।

কতবার ঝরে পড়ে নতুন পাতা
সড়কের ধুলোমাখা ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলোয়;
সেদিন দেখেছিলাম কেউ একজন হেঁটে যায়—
তার মুখের ওপরে নোংরা খবরের কাগজ,
হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিল ঘরের জানালাগুলো,
কথারা পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে গিয়েছিল শূন্যে।

শেষ পর্যন্ত—
বাঁশঝাড়ের শালিক আর কখনো ফিরে আসেনি।
ঘরের ভেতর যারা ছিল,
তারা শিখে গিয়েছিল—
মুক্তবাক্যের দাম বাংলাদেশে প্রাণ।

গরিবগুরবোদের মতন ভালোবাসা

বৃষ্টির দিনে শহরের এক কোণে ছাতার ঝিলমিল,
ফুটপাতে দগ্ধ কাগজের পাঁজা,
আকাশের গায়ে দুঃখের সাদা চাদর মেলে কেউ
পৃথিবী বেচে ফেরে।
তোমাকে মনে হলো বালিশের নিচে হারিয়ে যাওয়া
পাঁচ টাকার নোটের মতো;
মনে হলো রেললাইনের পাশে পড়ে থাকা
কাটা তারের জীবনের গান।

তুমি বুঝবে না—
বস্তার ভেতর কাটা আলু আর পিঁয়াজের প্রেম,
বাইসাইকেলের টায়ারের ঘূর্ণি থেকে ওঠা ধুলোয়
খুঁজে পাওয়া নীরবতার ভাষা।
তোমাকে নিয়ে ভাবলে মনে হয় মাটির গন্ধে ভেজা
সস্তা গরম মশলার দোকান,
তুমি পেন্সিলের শেষ প্রান্তের মতো—
আলগা, ছোট, অথচ এত দরকারি।

আমাদের সংসার মানে শুধু মলিন বিছানা নয়,
এখানে ভাঙা কাপে চা ঢালার সময়
জলে ধুয়ে যাওয়া স্বপ্নও জমা হয়।
আমি দেখেছি বস্তার ছেঁড়া কোণায়
কোনো এক বাচ্চা মাটির খেলনা হাতে
আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় জোড়া দিচ্ছে ডানা।
তোমার চোখে সেই আকাশ,
তোমার হাতে সেই খেলনা,
আমার ভাঙাচোরা মন নিয়ে তুমি
পৃথিবীর একলা গাছ।

তুমি জানো?
ঘুঘুর ডাকের ভেতর লুকিয়ে থাকে
আত্মসমর্পণের শব্দ।
তোমাকে দেখে মনে হয়
ছেঁড়া জামায় জুড়ে দেওয়া সেলাইয়ের গান,
অন্ধকারে এক কাপ চা হাতে বসে থাকা
ভিক্ষুকের অপেক্ষা।

তোমাকে আমি এর বেশি কিছুতে ব্যাখ্যা করতে পারি না।
শেষমেশ বলতে চাই,
তুমি আমার কাছে সেই গরিবগুরবোদের স্বপ্ন,
আমি তোমাকে গরিবগুরবোদের মতন ভালোবাসি।

ভাবনার আলো

মাঠের ওপারে লাল টুকটুকে মেঘ—
হাঁটুজলে নামলে যেমন মাছের খেলা,
তেমনি মনে আসে কিশোর শৈশব।
বাতাসে ডালের দুলুনি,
পুকুরের পাশে বউকথাকও পাখি—
এতদিন কিছুই বদলায়নি,
তবু, চোখে লাগে ভিন্নরকম!

হাঁটতে হাঁটতে শালবনের পথ
একসময় খোঁপা বাঁধা স্মৃতির মতো এলোমেলো;
জলতৃষ্ণা মেটাতে বাঁধাঘাটে থামি,
দেখি, সাপের মতো পাক খেয়ে পড়ে আছে
পুরোনো বাঁশের ছিপ।
এক ফোঁটা জল মুখে তুলে
ভাবি— কেন যেন অন্য স্বাদ!

রাত্রি নামলে বেহায়া বাতাস
গাছের পাতায় ছড়ায় ঘ্রাণ,
মনে হয় যেন কিছু খুলে গেছে—
একটি পর্দা, এক মায়া, এক চোখ বেঁধে রাখা জাল।
মোমবাতির জ্বলন্ত শিখা
আলতো আলো ছড়ায় ঘরের কোণে,
এবং ধোঁয়া— তা যেন শূন্যতার সিঁড়ি।

তুমি বলেছিলে, "ভাবনা বদলাও,
বদলে যাবে সবকিছু।"
এখন তা বুঝি—
জল, পাতার নাচ, পাখির ডাক,
সবই এক, অথচ এক নয়।

আলোর কণার মতো ভাবনা,
অন্ধকারের পর্দায় ছড়িয়ে পড়ে,
নতুন জগৎ গড়ে ওঠে,
অপরূপ, অদ্ভুত, অপার।

শীতের আগে প্রেমের পরে

হেমন্তের শেষপ্রহর।
আকাশের গায়ে মাটির ভাঁড়ের দাগ—
কেউ বোঝেনি, মাটি পুড়ে গেছে সূর্যের দাঁতে।
হাওয়ার ভেতর ঠান্ডা গুঁড়ো চিনি—
সহ্য হয়, কিন্তু জিভে লাগে।
আমি চেয়েছিলাম তোমাকে লিখতে—
কিন্তু কলমের মাথায় রক্ত জমে আছে।

বাংলাদেশ এখন কী চলছে,
তোমাকে কীভাবে বলি?
এখানে ভালোবাসার ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে।
সাদা পুলিশের চোখে শীতল মশার তেল,
তারা প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরে, যেন শাকসবজি।
ঘুষ নেয় গোপনে,
হয়ে যায় বস্তার গন্ধে মোড়া গরম পিঠা।

পার্কে বসে প্রেমের দিন—
গাছের পাতাগুলো তারিখ ভুলে গেছে।
বেঞ্চগুলো হাঁপাচ্ছে, তাদের পায়ে ব্যথা।
নিঃশব্দ প্রেমের বেলুন ফুটো করে দিচ্ছে কেউ,
ধোঁয়া উঠছে, অথচ আগুন নেই।
আমাদের শহরের আলো
এখন ঘুমায় না,
অন্ধকারের ঝুল বারান্দায় ঝুলে থাকে,
আর আমি তোমাকে লিখতে পারি না।

প্রেম একসময় মানুষ ছিল,
এখন কাগজের সিগারেট।
তবু আমরা হাওয়ার দড়িতে তাকে শুকিয়ে
কোনো একদিন ধূমায়িত হব।

জঙ্গির আয়না

ভোরের মায়া-আলোয় পাখিরা কাকুতি করে,
বেলিফুলের গন্ধে ভিজে উঠছে বাতাস—
অথচ বারান্দায় পড়ে আছে একটা ছেঁড়া জুতো,
যার দড়িটা নেই,
জীবনের মতো অর্ধেক ছেঁড়া।

রান্নাঘরের চুলার ধোঁয়া
কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে,
মনে হয় কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে
একটা গল্পের শেষ লাইন।
তেলের শিশির মুখ খুলে পড়ে যায়,
মেঝেতে ছিটকে পড়ে
একটা নীরবতা, শূন্য ঘরের প্রতিধ্বনি।

তিন নম্বর চেয়ারটা অর্ধেক ভাঙা,
যার কাঠের রং হারিয়ে গেছে
প্রতিবাদের মতো একদা প্রবল
কিন্তু এখন বিবর্ণ।
তার পাশে রাখা লোহার কুঁজো ঘড়িটা
টিক টিক শব্দে সময়ের পাশে
একটা আগ্নেয়গিরির মতো নিঃশব্দ।

রাস্তার ধারে বালির স্তূপে বসে
দু’জন কিশোর খেলছে,
বালি দিয়ে বানাচ্ছে একটা শহর,
তার ওপর গাড়ি চলে গেলে
সবকিছু মিলিয়ে যাবে ধুলোয়।
মিলিয়ে যাবে ভোর, পাখি, গল্প, বেঁচে থাকা।

তবু মানুষ হাঁটে,
হাঁটে বাজারে, হাঁটে মসজিদে, হাঁটে মন্দিরে,
পকেটে একটা ছোট কাঁচি নিয়ে
সত্যকে কাটতে চায় খণ্ডে খণ্ডে।
চায় ছেঁড়া জুতোর দড়ি লাগাতে—
কিন্তু হাত কাঁপে।

তুমি বলো,
কে জঙ্গি?
কীসে লুকিয়ে আছে এই অন্ধকার?

জঙ্গি কে?
আয়নায় তাকাও, নিজেকেই দেখবে।

অধরা তুমি, অমর আমি

তোমার নামের পাশে মেঘ জমে,
জোৎস্নার গলিতে থমকে দাঁড়ায় রাত।
তোমার চুলের ঘ্রাণে মেশা বর্ষা,
কখনো ঝড়ো বাতাস, কখনো বৃষ্টির নীরবতা।

চুপচাপ কাঁপে আমার ধূসর আঙুল,
তোমার ছোঁয়া কি কল্পনা?
নাকি এ বাস্তবের মায়াবী ছলনা—
পৃথিবী যেন ঠকায় আমায় বারেবারে।

তোমার মুখের প্রতিচ্ছবি,
স্রোতের টানে ভাসে পাথুরে নদীতে।
কোনো এক জাগ্রত স্বপ্নের মতো,
তুমি এলেই জীবন বাঁধা পড়ে গোপন ছন্দে।

এ শহর জানে না, তার সব আলো নিবে গেছে।
তোমার চোখের গভীরতা ছুঁয়ে আমি
পেয়েছি অনন্ততার স্বাদ।
তোমার নামে বাঁধা পড়ে, জীবন যেন এক চেনা অচেনা ছায়া।

আঁধারের গভীরে তোমার নাম ধ্বনিত হয়,
এক অনন্ত রাতের আকাশে আছ তুমি তারা হয়ে।
স্মৃতির স্পর্শধারা বেঁধে রেখেছে আমায়,
এক অসমাপ্ত গানের সুরে তোমার নামে।
নীলাভ অন্ধকারে তোমার চোখের আলো,
এক অগ্নিকণা জ্বালিয়ে দেয় আমার হৃদয়।
তোমার স্পর্শের ছায়া আমার প্রাণে বাজে,
আমি কি তোমায় খুঁজি, নাকি তুমি আমায়?

জন্মপাপ

পাড়ার মাঝখানে এক পুরনো পুকুর,
পাড়ের কোল থেকে ঝরে পড়া শেওলা—
আমার গায়ে লেগে থাকে সেই শেওলা,
যেন জন্ম থেকে পরিয়ে দেওয়া এক অদৃশ্য চিহ্ন।
বাবা বলতেন, "ওটা মুছে ফেলো,"
কিন্তু চিহ্ন তো মুছতে পারি না,
ওটা রয়ে যায় পুকুরের পানির মতো,
প্রতিদিন কাঁপে, প্রতিদিন স্থির হয়।

গলি থেকে ফেরে লাল-হলুদ শালপাতার থালা,
যা পূজোর পর ফেলে দেওয়া হয়।
আমার মধ্যেও জমা হয় ফেলে দেওয়া কথা,
যা কেউ শুনতে চায় না,
পুকুরের তলায় পড়ে থাকা কাদা যেমন,
যেমন ঝুলে থাকা ধানের আঁটি থেকে ঝরে পড়া শুকনো মাটি।

বইয়ের পাতায় লেখা "আমরা সবাই এক,"
কিন্তু প্রতিদিন শুনি ভিন্ন এক ভাষা।
আমার কণ্ঠের শব্দ ভেঙে যায়,
ঠাকুরঘরে প্রদীপ যেমন নিভে যায় বাতাসে।
ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডারে
বছরের পর বছর দেখি শুধু তারিখের মৃত্যু।

মাঠের শেষে পুরনো বটগাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে,
যার নিচে বসেছিলাম একবার,
বন্ধুদের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম,
কিন্তু হঠাৎই কেউ বলে উঠল—
"তুই তো হিন্দু!"
বটগাছটা যেন আরো গভীর হয়ে যায়,
তার শিকড় মাটির নিচে টেনে নেয় আমার শ্বাস।

প্রতিদিন সকালে মায়ের শঙ্খধ্বনি শুনি,
তাতে কোনো বিভেদ নেই, কোনো ঘৃণা নেই।
তবু বাইরে বেরোলে পায়ের তলায় পড়ে থাকে
ভাঙা কাঁচের টুকরো, যা কেটে দেয় পায়ের তলা।
আমার শরীরে রক্তের চিহ্ন পড়ে,
ঠিক যেমন দেশজুড়ে রয়ে গেছে চিহ্ন,
যা কেউ মোছেনি, কেউ মুছবে না।

হিন্দু হওয়ার দাগ
আমার অস্তিত্বের কালো ছাপ,
সর্বদা মনে করি,
আমি বাংলার এক অপরাধী।
জন্মের সাথে জন্মেছে এই পাপবোঝা,
এই দেশের অভিশপ্ত সন্তান, আমি।

নামহীন এক নাম

রোজ ভোরে শিউলি ফুল ঝরে—প্রতিটি ফুলে লেখা কোনো এক নাম,
আমি জানি না তার অর্থ, জানি না তার গল্প।
চায়ের কাপে লেগে থাকে ঠোঁটের ছাপ—
ঠিক যেন কারো একলা সময়ের নিঃশব্দ আলাপ।

সকালবেলার রোদ জানালার কাচে
আলপথে ফেলে যায় নরম ছায়ার দাগ।
রান্নাঘরের ভাঁড়ে চায়ের শেষ চুমুক
হঠাৎ মনে করিয়ে দেয়,
শহরের অজস্র স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা
অজানা ট্রেনের ভেতরেও
কেউ না কেউ ডাকছে এক নাম।

সন্ধ্যাবেলায় ভেজা পোশাকের গন্ধে
মিশে থাকে দূরের মেঘলা পাহাড়ের স্মৃতি।
ল্যাম্পপোস্টের তলায় ভাঙা পথ
তুলে আনে আকাশের নক্ষত্রের প্রতিফলন।
সেই আলোর ভেতর খুঁজে পাই
অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া কোনো স্পর্শের স্মরণ।

এভাবেই শব্দহীন এক অভ্যাসে
বইয়ের পাতায় লিখি এক নাম,
তারপর আবার মুছে ফেলি—
এ যেন দুধ আর জল মেশানোর এক চিরন্তন খেলা।
এ যেন রাত্রির নীরবতার ভেতর
গল্পের সূচনা আর শেষের অনন্ত মিলন।

প্রেম হলো নিঃশব্দে কাগজের পাতায়
এক নামের বারবার লেখা ও মোছা।

শাসকের মুখোশের নিচে

আলোটা ঢেকে দিলে মাটি হয়ে যায় ঢাল,
ঝরা পাতাদের গোপন কথারা ফুটে ওঠে সন্ধ্যার রঙে।
পথে পথে শূন্য চোখ, ক্লান্তি মাখা চোরাবালি জমে —
এখনো দেখো, প্রতিটা পা-চিহ্ন কাঁদে চুপিসারে।

যুদ্ধ শেষে গুঞ্জনগুলো নামল ঝাঁপিয়ে,
ফাঁকা শহরের জানলায় পর্দা টেনে দেয়া হয়।
যাদের হাত তুলে নিয়েছিল হাসিমুখে ফুল হাতে,
তারা আজ বীর্যহীন আতঙ্কে হাঁটে,
স্বপ্নের গায়ে হাত পড়তেই দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়।

খোলা আকাশের নিচে ছায়া জড়িয়ে নিয়ে
কিছু আত্মা এসে দাঁড়িয়েছে রাতের পাশে —
বুকের মধ্যে দেশটাকে চুরি হয়ে যাওয়া স্মৃতির মতো লুকিয়ে রাখে।
হাওয়া ভারী হয়ে উঠেছে, ছাইয়ে মিশে যাওয়া অঙ্গার কাঁপে,
সেখানেই ছায়ায় ছায়ায় গড়ে উঠছে সরকারের সভা।

বালির বুকে খোদাই করা প্রতিশ্রুতির মতো
শাসকের পদক্ষেপ — অস্পষ্ট, অপূর্ণ, অনিচ্ছায় দগ্ধ।
আলোর আড়ালে দাঁড়িয়ে যে মুখগুলো কেবল হেসে যায়,
তারা জানে না, জানে না সেই আলোও শেষ পর্যন্ত কবরের অন্ধকারে নেমে যায়।

সব নিখুঁতভাবে বোনা জালে,
জনগণকে মশার মতো উড়িয়ে রেখে,
অন্ধকারের কোণে ষড়যন্ত্রের রান্না চলে।

হ্যালো, শাসক, তোমার মুখোশ খুলে গেছে, এবার কোথায় পালাবে?

অন্ধকারে শান্তির বীজ

অন্ধকারে বাজে লৌহঘণ্টা,
আকাশে চিতার শিখা ওঠে কুন্ডলী পাকিয়ে।
ধূসর মেঘের ভাঁজে লুকিয়ে থাকে নীলচে রক্ত,
যেন ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে কেউ বের করছে গোপন যন্ত্রণার কথা।

শস্যক্ষেত্রে বুনেছে কেউ বিষের বীজ,
ধানগাছের শিরায় শিরায় জমেছে দ্বেষের মলিনতা।
নদীর জলে মিশেছে অশ্রুর নোনা স্বাদ,
পাহাড়ের কোলেও শুনি মাটির দীর্ঘশ্বাস।

এ শহর, এ মাঠ, এ পথ - সব যেন রুদ্ধ শ্বাসে অপেক্ষমাণ।
অহঙ্কারের মন্ত্রে জ্বলে ওঠা মুখগুলো
দপ করে নিভে যায় আবার;
তারা জানে না, ধ্বংসের পরে যে জন্ম,
তার নাম প্রতিশ্রুতির আলো।

তাই আমি ছুরি চালাই কল্পনার মেঘে,
ঝড়ের গভীরে খুঁজি সত্যের শেকড়।
তোমরা যারা পরাজয় ভেবে থেমে গেছ,
শোনো,
অন্ধকারেই তো জন্ম নেয় নক্ষত্রের আলো।

যদি বাড়ে বেড়ে ওঠে বীজের মতো,
ছিন্ন করি মূল, শিরচ্ছেদ করি সব।
অহঙ্কারের বৃক্ষ ছাঁটব কাঁচি দিয়ে,
না হবে আর শাখা-প্রশাখার কোনো ঠাঁই।
রক্তাক্ত হবে মাটি, কিন্তু শান্ত হবে,
কণ্ঠহীন হবে যারা করেছিল কোলাহল।

অন্ধকারের রংধনু

শহরের বাতাসে ধোঁয়া, যেন পুরনো কালের গোপন অভিশাপ,
দম বন্ধ করা শব্দগুলো কেবল উড়ে বেড়ায় নিঃশব্দে।
সেইসব ভাঙাচোরা রাস্তা—যেখানে আমাদের স্বপ্নগুলো
বৃষ্টির পানিতে ভেসে গিয়েছিল একদিন—
এখন সেখানে গড়ে উঠেছে নীরব ইটের পাহাড়।

আমাদের চোখে জ্বলে থাকা প্রতিশ্রুতির অগ্নি
এখন নিভু নিভু প্রদীপ,
তবু, আমরা পথ চলি, পিঠে বোঝা নিয়ে,
যেন ভুলে গেছি কোথায় যাবার কথা।
শালিকের গান ছিল যা একদিন মুক্তির ডাক,
আজ তা যেন কারাগারের সাইরেনের মতো কর্কশ।

একটা সময় ছিল, যখন দুঃখ ছিল জ্বলন্ত উনুন,
সোজা পথে পুড়তো, পোড়াতো।
এখন দুঃখের কাহিনি বহুস্তরে বিভক্ত—
একটা রংধনু যেন,
যার প্রতিটি রং এক নতুন মিথ্যা।

মাটির গন্ধে এখন আগুনের ছাপ,
আকাশ যেন হাতছানি দিয়ে বলে, "এসো,
আমার কাছে মুক্তি নেই,
তবু তোমার চোখে স্বপ্ন দেখি।"
আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, শূন্যতার দিকে তাকিয়ে—
একবারও ভাবি না, এই শূন্যতায় আমরা নিজেরাই লুকিয়ে আছি।

পাকিস্তানের দিনে যেন ছিল মেঘলা আকাশ,
বৃষ্টির আশায় কৃষকের মতো অপেক্ষায় ছিলাম।
আজ, এই অন্ধকারে, তারকাও যেন নেই,
কেবল মিথ্যা আলোর জালে আবদ্ধ।
তখন দুঃখ ছিল সরল, যেমন সাদা কাগজে কালি,
এখন দুঃখের রং বদলে যায়, যেমন রংধনুর বর্ণ।

অগ্নিসংগম

তোমার চোখের পাতায় জ্বলে উঠছে বুনো জঙ্গল,
বাতাসে লাফিয়ে ওঠে অদৃশ্য বাঘের পায়ের শব্দ।
নদীর জলে ডুব দিয়ে ফিরে আসে
নির্জনতা, সিঁড়ির ধাপে বসে থাকা সময়ের মতো।
তুমি গন্ধহীন সুরভির মতো ছড়িয়ে পড়ো
আকাশের ভিতর।

শালগাছের তলায় শুয়ে থাকে পিঁপড়ের স্বপ্ন,
আর মাটির ভিতর হঠাৎ টের পাওয়া যায়
সাপের নকশা।
তোমার ছোঁয়ায় শরীরের ভিতর খুলে যায়
পৃথিবীর প্রতিটি ভুলে যাওয়া দরজা।

মেঘের গায়ে ভর দিয়ে ঝরে পড়ছে
তোমার শ্বাসের মতো কুয়াশা,
তুমি যেন এক অদৃশ্য হরিণ,
যার পদচিহ্ন খুঁজতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে মরুভূমি।
প্রেমকে তুমি হাতের মুঠোয় ধরে চিরকাল
কবিতা বানাও।

কেউ নেই তোমার মতো, নখের চিহ্ন বসাতে আসে,
গোপন জখমে রক্তের ঝর্ণা ফোটাতে।
তুমি অন্ধকারের মতো আমার ভিতরে ঢুকে বসেছ,
আলোর খোঁজে ছটফট করি, তবু তোমাকেই চাই।
হৃদয়ের দরজা খুলে দিলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে
খণ্ড খণ্ড করে ফেলবে, কিন্তু তাতে কী?
তোমার প্রেমের অগ্নিশিখায় পুড়ে ছারখার হওয়ার চেয়ে
জীবন কী আর?

অন্ধকারে গোপন কোণ

সকালে এক কাপ চা, রক্তমাখা চামচ হাতে
তোমার ঠোঁটে এক চিমটি বিষাদ—
আমি তাকাই, তাকাই না;
শিল্পের নামে ছিঁড়ে ফেলি শব্দের পাতা।
বইয়ের মলাট ছিঁড়ে উড়াই হাওয়া দোলায়,
হাওয়ার কাগজগুলো যেন বিষণ্ণ কবুতর—
কী করে বোঝাই, শিল্পের আকাশে কুয়াশার ঝালর।

রাত্রি নামে, শূন্য থালার মতো
চাঁদ ভরে থাকে মেঘের ময়দানে।
আমার কল্পনায় জমে থাকা জল
ধীরে ধীরে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়—
তোমার মনের গোপন কোণে আমি যেন
একটা মাকড়সা, জাল বুনছি দিনের পর দিন।

প্রেম, একদিন রান্নাঘরের আলনায় ঝুলে ছিল,
ভাতের হাঁড়ি থেকে ধোঁয়ার মতো উড়ে গেছিল কোথাও।
তুমি কি দেখোনি, বারান্দার পায়রাগুলো
আজ আর গান গায় না?
তোমার নাম ডেকে ডেকে ঠোঁটের চামড়া উঠে গেছে,
তবু শব্দ তৈরি হয়নি, কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে।

একদিন পেন্সিলে আঁকা স্কেচপ্যাডে
তোমার মুখের রেখা এঁকেছিলাম,
পেন্সিল ভেঙে গেলে শিল্প থেমে যায় না;
তবু কেন থেমে গেলে তুমি,
এটা কি প্রেম ছিল? শিল্প ছিল?
নাকি সেই সাদা পাতায় আঁকা ক্ষত,
যা রক্তপাতে রঙিন হয়ে উঠেছিল?

আজ রঙ নেই, শব্দ নেই,
তোমার ছায়া নেই এই অন্ধকারে।
শুধু একটা কেঁচোর মতো কেঁদে বেড়াই, মুখে কালি মাখি।
কেউ কি আসবে, এই অন্ধকারের আঁধারে?
জানি, কামড়াব, চিবাব, হাড়গোড় সব খেয়ে ফেলব।
আঁধারের রাজা আমি, মৃত্যুর ভিখারি।
একবার চেয়েছিলাম তোমার দিকে, নিস্তেজ চোখে—
শিল্পের নামে দেহটা কেন এতো ক্ষতবিক্ষত?

অপরিচিত আমি

হয়তো আমি মানুষ নই, নই মানুষের বংশধর।
মানুষগুলো সকালে উঠে, চা খায়, কাগজ পড়ে,
আমি উঠি না, চা খাই না, কাগজ পড়ি না।
মানুষগুলো বাসে উঠে, অফিসে যায়, কাজ করে,
আমি বাসে উঠি না, অফিসে যাই না, কাজ করি না।
মানুষগুলো সন্ধ্যায় ফেরে, খায়, ঘুমায়, স্বপ্ন দেখে,
আমি ফিরি না, খাই না, ঘুমাই না, স্বপ্ন দেখি না।
মানুষগুলো ভালোবাসে, হাসে, কাঁদে, মরে,
আমি ভালোবাসি না, হাসি না, কাঁদি না, মরি না।
মানুষগুলো অন্যরকম, অপরিচিত, দূর, অসম্ভব।

তবু আমার ঘরে একটি জানালা আছে, যেখানে
সূর্যের আলো এসে থামে,
পাখিরা বসে গল্প বলে গোধূলির রঙে।
মানুষের পায়ের শব্দ,
আলোর চাবুক, ট্রামের ধাতব আর্তি,
সবাই মিলে আমার ছায়ার কাছে এসে দাঁড়ায়।

হয়তো আমি গাছ,
অযথা দাঁড়িয়ে থাকা কোনো শিমুল কিংবা কাঁঠাল।
শরৎকালের বৃষ্টিতে ভিজি,
পানকৌড়ির ডানায় দেখি কাদামাখা মেঘ।
মানুষেরা পথে নামে, আমিও নামি না-রাস্তায়,
পৃথিবীর ধূলিকণা আমার শিকড়ে এসে জমে।

হয়তো আমি নদী,
বালির পিঠ চিরে চলা জেদি ধারা।
মানুষেরা সাঁতার কাটে, ভাটার সময় হাঁটে,
আমি কেবল বই, উপচে যাই চাঁদহীন রাতে।

হয়তো আমি অরণ্য,
যেখানে কেওড়া গাছের ছায়া নামে নির্জনে।
মানুষেরা আসে, সরে যায়, নামে প্রজাপতি,
আমি শুধু শুনি, আমার পাতায় মেঘের সুর।

মানুষেরা হাসে, দৌড়ে যায়, হাত ধরে কাঁদে।
আমার কোনো মুখ নেই, কোনো হাত নেই,
তবু আমি আকাশ ছুঁই, মাটির ভেতরে লুকাই।
আমি মানুষ নই, তবু আমি আছি,
তোমাদের জাগরণে, নিদ্রায়, একাকিত্বে।

মানুষেরা অচেনা, অসম্ভব,
আমি তার চেয়ে ঢের সহজ,
যেন এক বিন্দু ঘাম, কোনো মুখের কোণে,
যাকে কেউ দেখেও দেখে না।

তোমার জীবনের আকাশে

বিকেলের হলুদ আলোয় তোমার হাত ধরে,
জমাট দুপুরের এক টুকরো চায়ের দোকানে বসেছিলাম।
সেখানে গাছের ছায়ায় জড়ো হয়ে ছিল
জোড়া চশমা, ভাঙা টেবিল,
আর কিছু অকারণ গল্প।

তোমার খোলা চুলে বাতাসের নৌকা চলত,
চায়ের ধোঁয়ার মাঝে হারিয়ে যেত তোমার হাসি।
আমি এক হাতে ধরে রেখেছিলাম
এক পুরোনো কবিতার পাতা,
যেখানে লেখা ছিল
"পৃথিবী ঘুরে তাকায়—তোমাকে দেখে!"
তুমি বলেছিলে,
"এই শহরের একাকিত্ব এক বোকা ভ্রাম্যমাণ খেয়াল,
তুমি কি আমার একা থাকার গল্প বোঝো?"

কাগজে লিখে রাখা অর্ধেক স্বপ্ন,
চায়ের পিপাসায় ভেজা রুমালের কোণে
তোমার চোখে এক অনন্ত জিজ্ঞাসা দেখেছিলাম।
আমার নীরবতা তোমাকে পিছু টেনেছিল,
আর আমি ভেবেছিলাম,
"কিছু শব্দের ভেতরে শ্বাস নিতে হয়,
যেন তাতে গল্পের রং ফুরিয়ে না যায়।"

তোমার হঠাৎ প্রশ্ন এল সেই সন্ধ্যায়—
"আমার জীবন নাকি তোমার,
কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?"
কিছু সময়ের জন্য আকাশে চাঁদ থেমে গিয়েছিল।
আমি বলেছিলাম, "আমার জীবন।"
তুমি উঠে চলে গেলে—
পথের ধারে পাখির পালক পড়ার মতো নিঃশব্দে।

কিন্তু তুমি জানলে না,
পৃথিবী আমায় বারবার তোমার গল্প বলে।
তুমি জানলে না,
তুমিই আমার জীবন।

অন্তর্বর্তী মুখোশ

প্রথম আলো ফুঁড়ে আসে শিরীষ পাতার ছায়া,
ঘুম ভেঙে দেখে কেউ টেবিলের উপর
একটা ফুটো কাপ, তাতে আধা ঠান্ডা চা,
আর পিঁপড়ের লাইন, সরল, নির্বাক, চলেছে।
শহরের গলিতে ধুলো আর ঝরা পাতা
অবিরত ঘূর্ণি খায়—দুপুরের রোদে যেন
অদৃশ্য ঝাড়ুদারের শূন্যতায় খেলা।
গলির বাগানে ঘাসের নিচে চাপা
প্রথম-আলো-বোনা নতুন এক রূপকথা,
যা কেউ কখনো শুনবে না।

পাশের দোকানে শীতল পানীয়ের বোতল খুলে
যে ভাঙা আওয়াজ উঠে, তা যেন কারো
ভূগর্ভে হারিয়ে যাওয়া একমাত্র গান।
দেয়ালে গোঁজানো পোস্টারের চোখগুলো বলে,
"শুধু দেখো, বিশ্বাস করো, প্রশ্ন নয়।”
সরু রাস্তাগুলো, রাত্রির অন্ধকারে,
অপেক্ষা করে, কারা যেন একদিন আসবে।

সেই রাতে কেউ শুনলো না
দূরের কারখানায় পাখির কণ্ঠে
নকল শব্দে ভরা অন্ধ ভবিষ্যৎ।
কারা যেন নিঃশব্দে লোহার বাক্সে
তৈরি করছে সূক্ষ্ম বিষ, আর শব্দহীন দংশন।
এই শহর, তার ঝুল বারান্দা আর
ময়লা জানালার ফাঁক গলে
বাইরে আসা গন্ধে ভরে আছে ছায়া।

দেশবাসী চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখে।
একটি বুনো গাছের ঝরা পাতার মতো,
তারা ভাবে পতন মানেই অগ্রগতি।
কিন্তু এই সরকার, মুখোশ পরে,
গোপন কারখানায় মরণের বিষ তৈরি করছে,
দেশবাসীকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর ঘুমে পাঠাতে।

শেষ হেমন্ত, প্রথম শীত

হেমন্তের শেষ বিকেলে সূর্য লাল পানের দাগ রেখে গেল,
ছাদের কোণে ভাঙা শিকে ঝুলে থাকা সাদা শার্টে।
পোড়া পাতা ওড়ে বাতাসে—
এখানে কীসব কথা ছিল একদিন,
ভাঙা কাঁচে জমে থাকা দাগের মতো,
যা আলোয় ঝলকায়, কিন্তু মুছে যায় না সহজে।

চায়ের কাপ ধরে থাকা আঙুল কাঁপে,
শীত নয়, হয়তো কোনো স্মৃতি।
গলির মোড়ে জুতোর দোকানে
তালাচাবির ঝনঝন, বুটের নিচে চটজলদি পালানোর শব্দ।
জুতো কিনতে আসা মানুষেরা
শীতকালকে দেখে একজোড়া উষ্ণতার মতো—
অথবা নতুন শুরু।

তুমি ছিলে কোথাও—
ভাঙা হেমন্তের রাতের মতো,
যেখানে বাতাসে বাঁশির সুর মেশে
আর দূরে কুয়াশা ঢেকে দেয় সব।
তুমি কি তখন শীতের কথা ভেবেছিলে?
কাপড়ে মুড়ে রাখা পুরনো কমলালেবুর গন্ধ
আমাকে ভাবায়:
আমরা কি শীতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম,
না কি হেমন্তে হারানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম?

মনে নেই,
আমি কী করে মুছেছিলাম তোমার ছবি,
অথবা তুমি মুছেছিলে আমার,
এখন
শুধু মনে পড়ে শীতের কালো জামা,
যখন বৃষ্টির বুলেট ছুটে আসে,
যখন শীতের হাওয়া কাঁচের পাতে আঁকা ছবি মুছে ফেলে,
পাতার জাহাজগুলি তখন ভাসে আমার মনের সাগরে,
আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি একলা ঘাটে,
যখন ভোরের সাদা স্ক্রিনে তুমি ফিরে আসো,
‘এবার কোথা যাবে?’ বলে ডাক দাও।

এখন আর কোথাও যাওয়া নেই,
শুধু এই শহর, এই বৃষ্টি, এই শীত,
আর এই মনের খালি কামরা,
তোমার জন্য কান্না করে,
আমার জন্য কান্না করে,
আমি যখন তোমাকে হারিয়েছিলাম,
তখনই শুরু হয়েছিল এই শীত।

প্রেমের ছাই

নীল ঘুমের মায়াজালে আটকে থাকে নদীর শরীর,
জোছনার ভাঙা নৌকায় শব্দহীন ঢেউ ওঠে—
সেখানে আমার চোখ জল হয়ে গড়ায়,
অথবা ছায়া হয়ে মিশে যায় চাঁদের সাদা হাড়ে।

তোমার মুখের কথা যেন পাতাঝরার শব্দ,
হাওয়ায় মিশে যাওয়া এক অদ্ভুত রাগিনী।
তোমার চুলের গন্ধ রাত্রির কালো রক্ত,
যা ছড়িয়ে পড়ে আমার চেতনার সবুজ জমিতে।

আমার শরীর এক বালির মন্দির—
তোমার ছোঁয়ায় প্রতিমা ভেঙে ভেঙে
সেখানে কেবল লাল ধুলো জেগে থাকে।
তোমার চোখের নক্ষত্র আমাকে টেনে নেয়
অচেনা আকাশের গর্ভে,
যেখানে রাতেরা মরে, ভোরেরা কাঁদে।

আমার চিৎকার তুমি শোন না—
সে যেন পুরোনো কুয়োর গোপন সুর,
অন্ধকারে বুদবুদ হয়ে ফেটে যায়।
তবুও আমি জ্বলি,
তোমার স্পর্শের আগুনে আমার হৃদয়
পুড়ে যায় হরিনামা চাদরের মতো।

তোমার প্রেমের আগুনে পুড়ে যাই,
আমি হয়ে যাই ছাই, তবুও তোমাকে চাই।

মৃত্যুর মেঘেরা বাংলাদেশে

আমরা চিহ্নিত করিনি কোনো খুনির নাম,
শুধু শুনেছি রক্তের শিহরণ, রাস্তায় ছড়ানো সবুজ রঙ।
গোলাপের গন্ধ আর জ্বলন্ত ধোঁয়ার বিষাক্ত মিশ্রণে,
গর্ভে-গর্ভে ফুটে ওঠে নির্লজ্জ দুর্নীতির হাসি।

গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল চেয়ে দেখি,
রক্তবৃষ্টি পড়ছে ভেজা অন্ধকারে।
এখন তেলের দামে নিভে যায় প্রদীপের আলো,
আর প্রতিটি মোড়ের নীরব কান্নায় জেগে ওঠে আতঙ্কের সকাল।

তাদের রাজ্যে শুধু বন্দুকের ভাষা বোঝা যায়,
কাগজের ওপর লেখে মৃত্যুর সংখ্যা,
আর আমাদের বুকের ভেতর জমা হয় স্তূপাকার ভয়।
এ শহরে প্রার্থনার কন্ঠরাও আজ থেমে গেছে—
কারা যেন আসে মুখোশ পরে, হাত বাড়িয়ে টানে ভয়কে।

শোনো,
আজ সবুজের ওপরে লাল দাগ,
লাল রঙে ঢেকে গেছে বাংলার ভোর।
নিখুঁত শিকারের মতন নিঃশেষে
ধুলো হয়ে হারায় শিশুদের স্বপ্ন।

তবু আকাশে আকাশে ভাসে মৃত্যু,
এমন অন্ধকার নামেনি আগে,
চুরি, হত্যা, শোষণ সবই যেন এক নিয়মের চক্রে,
একে একে জ্বলে ওঠে ধ্বংসের গীত।

সীমান্তের কাছে দাঁড়িয়ে দেখি, কাঁদছে নদী—
এ কোন দুঃখের দেশ হল আমাদের?
তাদের শাসন শুধু বিষাদের ভাষা,
আর লাল ছাপা মৃত্যু।

বাংলাদেশের আকাশে মৃত্যু নামছে।

নির্বাসিত স্বপ্নের অশ্রুবিন্দু

অস্তিত্বের কাঁটাতারে ঝুলে থাকে বিশ্বাসের ছায়া,
মালাউন শব্দের বিষাক্ত তীরে ভেসে যায় অস্তিত্বের মায়া।
চাঁদনির আঁচলে লুকানো কান্না শুনি,
ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ত হয় জীবনের খুনি।
বাংলার মাটিতে জন্মেছে যে ফুল,
তার পাপড়িতে লেখা অশ্রুর সমুদ্র অকূল।
দেবালয়ের ভগ্নস্তূপে বসে কাঁদে দেবতা,
মানুষের হৃদয়ে জাগে অমানুষের ক্ষুধাতুর ক্ষমতা।
প্রজাপতির ডানায় আঁকা স্বাধীনতার স্বপন,
ধর্মের নামে ছিন্নভিন্ন হয় জীবনের রূপন।
নোয়াখালির মাঠে ঘুরে বেড়ায় মৃত্যুর ছায়া,
পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে ওড়ে রক্তের মায়া।
বাস্তুহারা মানুষের চোখে জমে থাকে জল,
দেশান্তরের পথে হারিয়ে যায় জীবনের দল।
একাত্তরের স্মৃতি আজও কাঁপায় হৃদয়,
মানবতার কবরে ফোটে ঘৃণার প্রদীপ নির্দয়।
শূন্য মন্দিরের প্রাঙ্গণে বাজে বিষাদের বাঁশি,
অন্ধকারের গর্ভে জন্ম নেয় আলোর প্রত্যাশী।
বিবেকের দংশনে জর্জরিত মানবতা,
ধর্মের নামে চলে অমানবিক ক্ষমতা।
জমির দখল নিয়ে যায় অন্যায়ের হাত,
ন্যায়ের বাণী হারিয়ে যায় অতলান্ত রাত।
শান্তির প্রতিশ্রুতি মিথ্যার আবরণে ঢাকা,
সত্যের মুখোশ পরে মিথ্যার কুহক জাগা।
বাঙালি হিন্দুর জীবন যেন শূন্যতার অভিশাপ,
প্রতিটি শ্বাসে অনুভব করে অস্তিত্বের তাপ।
জন্মভূমির মাটিতে আজ পরবাসী হয়ে,
বেঁচে থাকার লড়াই করে প্রতিনিয়ত ভয়ে।
অতীতের গৌরব আজ স্মৃতির পাতায়,
বর্তমানের যন্ত্রণা নিয়ে ভবিষ্যৎ চায়।
মানবতার স্বপ্ন আজ চূর্ণবিচূর্ণ ধুলায়,
নিঃশব্দ কান্নায় বাংলার কূল ভেসে যায়।

পাগল মেয়েটি

ও সে যে চলে আসে রক্তাক্ত রাত্রির তেহরানে,
গভীর চোখে আগুন নিয়ে,
হিজাবের ছিন্ন তারা হাতের মুঠোয়।
পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে,
দূরের আকাশে— যেন সেখানেই আছে
তার জন্য এক অন্য পৃথিবী, এক নতুন সূর্যোদয়।

এখানে সে খোলা পায়ে হেঁটে চলে,
তপ্ত পাথরে চিহ্ন রেখে যায়,
তার পদচিহ্নের পেছনে রক্তের এক দীর্ঘ পথ—
একটি ইরানের স্পন্দন।
একে একে খুলে ফেলে তার শরীরের আবরণ,
হৃদয়ের গভীর সত্য তার অনাবৃত চোখে।

যেন সে মৃদু গুনগুনিয়ে গান গায়,
যেন ভাঙা কণ্ঠে বলে যায়—
"এ আমার শরীর, আমার পতাকা;
এ আমার প্রতিবাদ, আমার ইচ্ছা।"

পুলিশ আসে, কঠোর হাতের স্পর্শে সে কেঁপে ওঠে,
মাথায় আঘাত, রক্তের বন্যা বয়ে যায়—
তবু মাটির ওপর নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,
তার চোখের গভীরে স্বপ্নের নীল ছায়া।

মাসা আমিনির নামে উঠে আসা বিদ্রোহের ঢেউয়ে,
এ শহরে এক সাহসী আগুন জ্বলে—
পুড়ে যাওয়া হিজাব, ছিন্ন তারার প্রজাপতি—
সে এক নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে।

তাকে যদি কুঠুরির অন্ধকারে পাঠানো হয়,
যদি ‘পাগল’ বলে তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়,
তবু তার নাম ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায়,
তার গল্পে রাত্রির আকাশে জ্বলে উঠবে তারারা—
তারাও তো পাগল, তারাও তো মুক্তি খোঁজে।

তাহলে বলো, কে তাকে থামাবে?
তেহরান জানে, পৃথিবী জানে—
সেই মেয়েটি, যাকে চেনো না তবু জানো,
সে সাহসের এক অন্য ইতিহাস।

পাগল? আহা, এমন পাগল যদি হতে পারত সব মেয়ে!

অন্ধকারের বুনো শ্বাপদ

কুয়াশা মাখা রাতের পথে
যেখানে চাঁদের স্নান সরে গেছে, যেখানে কালো ছায়ার শেকল পড়ে থাকে,
হাজারি গলির কান্না শুনি আমি,
নিশ্বাসহীন রাত্রির ভেতর দাঁড়ায় অসংখ্য নেকড়ে—
বৃথা অপেক্ষার পাঁজরে রক্তের ছবি আঁকে।

এই ক্ষুধার্ত জন্তুদের দেহে জেগে ওঠে
এক বিকৃত উল্লাস— ভ্রষ্ট মায়ার ছায়া আর মৃত নগরের প্রতিচ্ছবি।
অগণন শাঁখের মতো ছুঁড়ে ফেলে
মানুষের হাড় আর রক্তের বীজমন্ত্র।

শ্বাপদের রক্তাক্ত নখরের নিচে
ভুলে যাওয়া শেকড়ে হারায় পবিত্র আত্মার সংহার।
দিকভ্রান্ত সূর্য্যাবর্তে আলোর কথা নেই আর—
কেবল নিঃস্ব বন্ধ্যা মাঠের মতন
তৃণহীন দেশ, যেন অনন্ত শূন্যের প্রহেলিকা।

চোখের ওপর গলিয়ে রাখা বিষধোঁয়ায়
প্রতিটি মানব আত্মা ঢলে পড়ে;
এই অন্ধকারে আমরা তো আর কেউ নই—
শুধু অতৃপ্ত অতলান্ত পিশাচের মিছিলের অঙ্গুলীহারা মৃত ফুল।

আলো নেই, রোদ নেই—
মধ্যরাতের আকাশে চাঁদ নেই, নক্ষত্র নেই,
এই দেশে শুধু কালো কালো রাত।

আপনার নাম মাধুরী

আপনি যেন দূর নক্ষত্রের মাধুরীর আলো,
অসীম রাতের কৃষ্ণ তলায় ছড়িয়ে পড়া
শত রহস্যে মোড়ানো এক নিঃশব্দ কাব্য।

আপনার চোখে অন্ধকারের বিষন্নতা,
অথচ এক সুবর্ণ স্রোত বয়ে যায়
ভালোবাসার প্রতিটি নিশ্বাসে,
যেন গাঢ় নদীর তীরে পরিণয়ের বালুকা।

আপনার হাসির মধ্যে সূর্যোদয়ের লাজুক শীতলতা,
দুঃখেরও নিজস্ব আলোর আভাস,
যে আলো প্রণয়ের নিবিড় ফাঁদ হয়ে
ঘিরে রাখে আমাকে নিষ্পলক নির্জনতার মাঝে।

আপনি সেই সঙ্গীত, যা কখনো শোনা যায় না,
কেবল অনুভূতিতে বাঁধা পড়ে যায়।
আপনার দিকে তাকালে দূরত্ব ধুয়ে যায়,
আপনি মাটিরও বাইরে, অথচ হৃদয়ের অনেক কাছে।

আপনার প্রতিটি শব্দ—সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো,
ধুয়ে যায় আমার সত্তার ভাঙ্গনগুলো,
আপনার স্পর্শে অনুরণিত হয়
অন্তহীন কাব্যের নীল নীড়।

বন্ধন স্বপ্নের, স্বপ্ন সত্যের, সত্য হৃদয়ের,
হৃদয় আপনার, আপনি আমার... প্রেম।

নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের পথিক

তুমি এলে যেন বর্ষার প্রথম গন্ধে ভেজা মাঠের নির্জনতার মতো,
যেন আকাশের কোলে শুয়ে থাকা নক্ষত্রের মতো নির্লিপ্ত,
তোমার চোখে জ্বলে প্রাচীন পূর্ণিমার আলো,
মৃদু হাসিতে মিশে থাকে গোপন নদীর স্রোতের নীল রহস্য।

তুমি আমার ভ্রমণ; অলৌকিক পথে হারিয়ে যাওয়া এক নিষিদ্ধ পূণ্যভূমি,
তোমার পথে হেঁটে চলেছি গাছের পাতার কান্না আর শিশিরের হাসি মাড়িয়ে,
তোমার রূপ যেন ধূপের সুগন্ধে ভরা এক অনন্ত রজনী,
যেখানে প্রেম গড়ে ওঠে স্বপ্নের অতল দহে।

তোমার ছোঁয়া, যেন বেদনার নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর,
আমার হৃদয়ের রিক্ত প্রান্তরে বিলিয়ে দেয় রহস্যময় সুখের কুহক,
তোমার দিকে তাকিয়ে আছি নির্জন পাখির বিষন্নতা নিয়ে,
তোমার নামে লিখে চলেছি নিজস্ব অক্ষরের অবিনশ্বর কবিতা।

বৃক্ষের মতো তোমায় জড়িয়ে থাকি,
অক্ষরের মতো তোমায় লিখি,
হৃদয়ের গ্রন্থে তোমায় বন্দি করি,
প্রেমের পথে চিরকাল ভ্রমণ করি।

তোমার নামে শহরের সমস্ত বাতাস

তোমার নামে শহরের সমস্ত বাতাস
পাথর হয়ে নামে মাটিতে,
অন্ধকারের গায়ে জমে, রাস্তার ঘামে ঝরে,
পোড়া কালির ছোঁয়ায় মাখা এই শহর,
যেখানে আমরা জীবনের ভান করি,
হাসি আর হাত ধরার স্মৃতিগুলো ফেলে আসি
শহরের কোন অচেনা অন্ধকারে।

তুমি এসো এক সন্ধ্যায়,
এই নির্জন নির্জীব ইমারতের রক্তিম ইটের মাঝে
যেখানে আমরা মৃত্যু দেখে প্রেম খুঁজি,
আমাদের চোখে পুরনো মেঘের দাগ,
তুমি এসো মেঘের ভারে ঠেসে ধরা এক শূন্যতার দিকে,
যে শূন্যতার মাঝেই তোমার ঠোঁটের আঁচড়,
শব্দগুলো ফুটে ওঠে তোমার নিশ্বাসের পরতে পরতে।

আমাদের মধ্যে কি এক লুকানো মৃত্যুর গল্প
প্রতিটি মোড়ে ফেলে আসা
প্রেমের পাণ্ডুলিপিতে লেখা রয়েছে।
বর্ণমালার ঘ্রাণে শুকনো রাত্রির থোকা থোকা শব্দ,
আমাদের বুকে ছড়িয়ে পড়ে যেন প্রেমের শেষ গান।

তুমি আমায় ধরো, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া
নির্জনতার রেললাইন ছুঁয়ে,
আমাদের জীবনের সমস্ত স্পর্শ রেখে এসেছি
এই নীরব শহরে;
প্রেমের স্মৃতির ঘোরপ্যাঁচে লেপ্টে থাকা নীরব আকাশে।

বর্ণমালায় মৃত্যুর স্মৃতি, প্রেমের স্মৃতি
স্মৃতির মৃত্যুতে প্রেমের জন্ম, প্রেমের মৃত্যুতে স্মৃতির জন্ম
স্মৃতির স্মৃতির মৃত্যুতে প্রেমের অনন্ত জন্ম
প্রেমের প্রেমের প্রেমের মৃত্যুতে স্মৃতির অনন্ত জন্ম
বর্ণমালায় মৃত্যুর স্মৃতি, প্রেমের স্মৃতি।

রাত্রি ডাকে রীনার নাম

[প্রিয় কবি রীনা বিশ্বাস-হাসি (মৈত্রেয়ী কবি) স্মরণে]

জ্যোৎস্নার আলপথ ধরে রীনা চলে গেছে—
মেঘের শোকলিপি যেন আকাশের চাদরে
লেখা হয়েছে আজ রাতের অন্ধকারে।
তবুও মরা ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে বাতাস,
মনে হয়, শীতের কুয়াশায় লুকানো কোন নিশ্বাস
তার কবিতার পাতা থেকে ঝরে পড়ছে ধীরে ধীরে।

দূরের মাঠে ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে কুয়োঘর,
তবুও পাখিরা জানে না, রীনা ফিরে আসবে না আর।
ঘাসের ওপর রক্তজবা ফুলগুলো হঠাৎ থেমে গেছে,
তাদের পাতায় ঝরে পড়া শিশির কি কান্না নয়?
নীরবতায় শব্দের বীজ রেখে গেছে সে,
চোখ বন্ধ করে যেই দেখলে, মনে হয়
একটা উদাস বাউলের একাকী সুর যেন ভেসে আসে।

তারা উজ্জ্বল— তবু আলোর গোপনে লুকিয়ে থাকা
অগুনতি দুঃখের দলা মাটির ভেতরে—
সে যেন রীনার ছায়া, ভাঙা ছন্দের টুকরো।
যতই লিখি, তবু কলম থামে,
কারণ সে নেই, অথচ এক মহাকাব্য হয়ে বেঁচে থাকে
তার ছোট্ট কবিতার পাঁজরে।

শেষে রাত্রির একান্তে মনে হয়—
এই শহরের সাঁই সাঁই বাতাস
রীনার শ্বাসের মতো বয়ে চলেছে।
হৃদয়ের কালো পোকামাকড়,
কাগজের পাতায় মৃত্যু ঘুমায়।
কলমের স্বপ্ন শব্দহীন কান্না,
রীনার কবিতা অন্ধকারে জ্বলে।

শহর আর মৃত্যুর নেশা

নীলাভ ধোঁয়ার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে,
আমার বুকে নেমে আসে ব্যস্ততম ফ্লাইওভারের ছায়া—
আকাশে গাঁথা ইঁট-কাঠ, রাস্তায় সাদা-কালো তারের ফাঁদ,
তুমি চলে যাও, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাও,
অন্ধকার ল্যাম্পপোস্টের তলায়,
আমার হৃদয়ের মত শূন্যতার শহরে।

দেখো, কংক্রিটের ঢেকে থাকা গাছেরা এখনও কান্না চেপে
অন্ধকারে মাথা নোয়ায়—
রাতের শেষে, ভাঙা ঘুমের কোলাহল জেগে থাকে আমার
জানলার পাশে;
আমি তোমার জন্যই জেগে থাকি,
জেগে থাকি শীতের পার্কের চাঁদের আলোয়,
যেন একান্ত বসে আছি নীরব গলির শেষ প্রান্তে,
আমার হৃদয় অবশেষে তোমার ঠোঁটে।

তুমি বলেছিলে, মৃত্যুর রং ধূসর নয়, নীল নয়,
সে রং মিশে থাকে শহরের ভিড়ে,
তার গন্ধে মোড়া থাকে আমাদের আলিঙ্গন—
তুমি আর আমি, নগরী আর রাত,
যেমন তুমি হাসতে হাসতে ফুরিয়ে যাও,
অমর এক আকাঙ্ক্ষা হয়ে।

বন হয়ে মরে যাব, বর্ণ হয়ে মরে যাব,
তোমায় ভালোবাসতে ভালোবাসতেই মরে যাব।

আকাশের দিকে মুখ তুলে

ঝড়ের মতো লাল সিগারেট জ্বলে—
রক্তপাতের স্মৃতি আমার ঠোঁটে ঝুলে থাকে,
পোড়া আঁচলের গন্ধ নিয়ে রাত আসে ঘুমের ভেতরে,
সেইখানে আমাদের ঘর,
চালে পুঁতে রাখা ছিল এককালে তামা-রুপার জলে নেমে আসা ঘুড়ি,
তখন তো আমরা কল্পনার শহরে
পিছনে পাথরের মতো স্মৃতি বয়ে বেড়াই।

ঘাসের মধ্যে জোনাকি পুড়ে পুড়ে বেড়ে ওঠে—
হলুদ বাতাসে আমার শ্বাস আটকে যায়
ফাঁকা ঘরে চাবির মতো একা হয়ে
বুকের গহীনে অন্ধকারের শব্দেরা বসবাস করে,
তাদের মুখে আজও কাঁচা হলুদের গন্ধ।

কতবার মনে হয়েছে সব ছেড়ে চলি,
আলোর পথের কাছে নতজানু হয়ে বসে
এক বিন্দু আলো হাতের মুঠোয় ধরতে পারি না,
হাতের রেখাগুলোর সাথে লেগে আছে শোকের চিহ্ন।

জলজঙলার মাটিতে ডুবে ছিল পা,
খোলা আকাশের নিচে কাঁটাগাছের বাঁকা শিকড়ের ভেতর
নিজের রক্তের রঙ দেখেছি ধূসর মাটিতে মিশে যেতে।

এখনো জানি, সেই ফিকে দাগ মুছে যাবে না কোনোদিন,
শুধু আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে চাই—
ভেজা পাতা যেমন ফেলে আসে বৃষ্টির কান্না,
অবশেষে দাঁড়াব ঐ উদাসীন আকাশের দিকে মুখ তুলে।

কোনো একদিন বৃক্ষের মতো নত হয়েছিলাম বোধ হয়,
এবার উঠে দাঁড়াব আকাশের দিকে মুখ করে।

জুলাই-আগস্টের নক্ষত্রবিদ্ধ শবেরা

রাত্রির শিকারের কাছে
ফেটে যায় স্নায়ুর ছায়া-গল্প,
তারা জানত না
ক্ষুধার্ত নক্ষত্রেরা তাদের শরীরে মন্ত্রণা লিখছে,
মাটির গভীর থেকে উঠে আসে রক্ত-মেঘের স্পন্দন,
অবাধ্য শব্দেরা বন্দুক হয়ে ফেটে পড়ে —
মৃত্যুর উৎসব রচনা করে অন্ধকারের করিডোরে।

৭.৬২ ব্যারেলের ভেতরে জন্ম নেয়
ক্লান্তির ভাষা, রাষ্ট্রের পচন,
সমাজের তির্যক চোখ।
তোমরা কে? কে লিখলে এ মহা বধ্যভূমির কাব্য?
সেখানে অস্তিত্ব ঝরে পড়ে
তোমার আদিম পাপের মদিরায়,
আর আমরা খুঁজি এক বর্ণহীন নিশ্বাস,
যে জেগে উঠবে মৃত ছাত্রদের শিরায় শিরায়।
তোমার ছায়ায় জ্বলে ওঠে ইতিহাসের বুলেট —
কার হাতে লেখা হলো এই মহাযুদ্ধের পরিহাস?
মৃত্যু কার পিপাসা মেটাতে লুকাল তার নাম?

যুদ্ধের ইশতেহারে ঈশ্বরের কবর

বৃষ্টির শরীরে জেগে ওঠে ছাইয়ের গন্ধ,
জ্বলন্ত শোলার আগুনে দগ্ধ প্রতিমা,
বিসর্জনের রক্তিম ঢেউয়ে ডুবেছে প্রার্থনা,
মিথ্যের ভাঁজে বাঁকানো প্রতিজ্ঞা- মন্দিরের ফাটলে ফাটলে নীরব শ্লোক।

পৃথিবীর বুকে কেবল যুদ্ধের ইশতেহার —
জিহাদের চৌকাঠে শেকড়হীন মানুষেরা পুঁতে দেয় ঈশ্বরের কবর।
ধুলোর পায়ে পায়ের ছাপ রেখে হাঁটে প্রেতাত্মারা,
যাদের গলায় বীভৎস ধ্বনির মতো বেজে ওঠে পূজার শেকল।

কোথায় সেই স্লোগান, যেখানে ইদের আকাশ ছিল পূজার রাত্রির নক্ষত্র?
ধর্মের মৌলবাদী কাঁটাতারে বাঁধা পড়ে গেছে মানবতার মুখোশ,
যারা বলেছিল একসঙ্গে থাকবে মন্দির-মসজিদ,
তারা এখন ইতিহাসের উপহাসের জগন্নাথ রথে গড়িয়ে পড়ে ধুলোয়।

এখানে শুধুই পুড়ে যাচ্ছে প্রতিমা আর ঈশ্বরের মুখ,
আকাশের কান্না জমা হচ্ছে নিষিদ্ধ প্রার্থনায়,
শুধু ছাই উড়ে যায় চিরকাল,
যুদ্ধের লজ্জায় জাগে মাটির অন্তিম কবর।

নিষিদ্ধ পুষ্পের প্রহেলিকা

যে বালুকণাগুলি এখনো চূর্ণিত হয়নি,
তারা জানে না কোথা থেকে আসে ভ্রান্তি—
কোন নিষিদ্ধ পৃথিবীর ধুলো, অন্ধকারের সাথে মিশে
মুক্তি চায় লাশের শ্বাসবায়ুতে!
তাদের স্বপ্নে হাঁটে এক মৃত রাজা,
যে তৈরি করে মসৃণ খড়মের আঘাতে রক্তের নকশা,
নিঃশব্দে কাটে বালুকাবেলা,
পৃথিবীর মানচিত্রে অঙ্কিত এক মহাজাগতিক ব্যাধি।

আকাশ জানে না যে তারা মিশেছে ভ্রান্তির ধোঁয়ায়,
তাদের জন্মই যেন মৃত কবিতার পঙ্ক্তি,
অথচ এখানে, কেউ একজন ঢুকে পড়ে মৃত সভ্যতার গোপন দরজায়,
নতুন এক ধর্মের নামে রচনা করে যুদ্ধের মহাকাব্য,
রাত্রির বুকে ছুরি বিঁধিয়ে,
মৃত্যুর দোহাই তুলে পৃথিবীকে সাজাতে চায় অদ্ভুত বিভ্রমে।

জীবনের মেঘলা ছায়ায় কেউ কেউ বসিয়ে দিয়েছে এক মঞ্চ,
যেখানে মৃত্যু দাঁড়িয়ে বলে—"এবার যুদ্ধ শুরু হোক!"
আর সমুদ্রের ওপার থেকে তালি দেয় সেই মানুষ,
যার অঙ্গুলি একবার তুললেই ভেঙে যাবে সভ্যতা,
জন্ম নেবে নতুন এক ছায়া—
কেউ জানে না, সে কি মানুষের মুখোশে লুকানো আরেক নিঃসঙ্গ পিশাচ!

কিন্তু অন্ধকারের মাঝে খেলা করে সূর্যের এক বিন্দু,
যে চায়, সব মুছে ফেলতে,
কিন্তু জানে না সে, কিভাবে ইতিহাসের মৃত্যু হয়,
কোনো এক ভুল ছায়ার পিছনে দাঁড়িয়ে
মিথ্যার হাত ধরে চলে অদৃশ্য চক্রান্তের পথে।

এভাবে জন্ম নেয় এক নিষিদ্ধ পুষ্প,
যার গন্ধে ম্লান হয়ে যায় সমস্ত মানুষের মুখ,
আর তখনই শুরু হয় এক নতুন খেলা—
নোবেল! কিন্তু এই পুরস্কার কি সত্যিই,
নাকি শুধু আরও একটি প্রহসন?
একটি কৌতুকময় প্রহেলিকা—সমস্ত পৃথিবীকে বোকা বানাবার শেষ চেষ্টা!

শিকলবদ্ধ বিবেকের রক্তাক্ত সূর্যাস্ত

চাঁদের নরম আলোতে নেমে আসে রক্তের ছায়া
শস্যের মাঠে আজ ঘুমিয়ে থাকে ন্যায়ের মৃতদেহ,
আকাশের নীল থেকে ঝরে পড়ে আইনহীন ঘামের কণা
শিক্ষার্থীর চোখে বিচারকের মুখোশ— কিন্তু আঙুলে কাঁটা,
যেখানে চোর সন্দেহে নীরবতা ফেটে যায় সূর্যাস্তের চিৎকারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছেরা আজ দেহহীন ইতিহাসের সাথি,
অপরাধের পলাশে ফোটে অন্ধকারের ফুল—
সেই অন্ধকার, যেখানে হাতুড়ির আঘাতে
পৃথিবীর নাভি থেকে উঠে আসে বিচারবিহীন রক্তস্রোত।

রাজশাহীর বাতাসে ভাসে দেহহীন আত্মার বেদনা,
প্রতিবন্ধী যুবকের কণ্ঠস্বর আজ মিশে গেছে ধূলিকণার সাথে,
খুনের শিক্ষা কি এখন আমাদের বইয়ের পাতায় লেখা?
না, বর্বরতার যুগ ফিরেছে— এই সভ্যতা কেবল মুখোশের রূপে ভ্রান্তি।

আমরা এখন বাঁচি শিকলবদ্ধ বিবেকের ছায়ায়,
যেখানে মানুষের হাতেই মানুষের মৃত্যু,
আর আমরা নিঃশব্দে বসে থাকি—
আমাদের সভ্যতার অবশিষ্ট রক্তাক্ত সূর্যাস্ত দেখতে।

অদৃশ্য দহনের মন্ত্র

মেঘমালা আর পিঙ্গল মরুভূমির মাঝে জমাট বাঁধছে রক্তের অরণ্য।
রংপুরের দিগন্তে হঠাৎ হিম শীতল বাতাসে এক ঝলক অদেখা আগুন,
যেখানে প্রতিটি দাসপাড়ার ছাদের নিচে রাত জাগে—সাপের বিষে নেশাগ্রস্ত সময়ের মতো।
মোসলেম উদ্দিনের গর্বিত নাম মিশে যায় শূন্যতার ধারালো শ্বাসে—
কিন্তু চাঁদের পাশে জমা হচ্ছে সাদা কালো হিজাবের ধূসর আঁচল—
হঠাৎ একদল প্রাচীন কন্যা নেমে আসে রৌদ্রতপ্ত মাটির ছায়ায়,
তাদের হাতের মুঠোয় নীল আকাশের ভাঙা তিলোত্তমা।

তারা কি কেবল হিন্দু?
তারা কি কেবল নারী?
না—তাদের চোখের পাতায় জমা পড়ছে বিশাল পাহাড়ের সূর্যাস্ত;
তাদের রক্তে মিশে থাকা বাঘের গর্জন আর অলীক তারার কণ্ঠস্বর।
এ এক যন্ত্রণা নয়, এ এক অন্তহীন বিদ্রোহের মন্ত্র—
যেখানে প্রতিটি হিজাব ভেঙে দেয় মহাকালের নিরাকার কাঠামো,
আর প্রতিটি মেয়ে হয়ে ওঠে সমুদ্রের অদৃশ্য দহন।

শিকড়হীন পিতলের চাঁদের নীলাভ প্রান্তরে

মেঘের গর্ভে বীজ বুনে দেয়ার কথা ছিল—
সেখানে ছিল উন্মাদিত পদ্মের হাসি,
তবু তুমি দেখো, নীরব মৃত্যুঘুম ফুঁড়ে
বৈষম্যের কর্কশ ছায়া উড়ে আসে শহরের বুকে।
স্বপ্নের ঘুমগাছ গুল্মে পরিণত হয়
যেখানে মানুষ তারাই মৃত, মগজের উজ্জ্বল চাঁদে।

ঢাকার বাতাসে যাদের আঙুলে আঁকা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী আখর,
তারাই একদিন গাছের শেকড় কেটে দিয়ে চায়
সবাইকে এক রঙে রাঙিয়ে দিতে;
সবাইকে বলে—
নেই আর পৃথক ভাষা,
নেই আর পৃথক মাটি।
সবাইকে হতে হবে একই ছায়ায়,
তালেবান মেঘের খোলসের মতো।
কোনও নক্ষত্র নেই যারা ছুঁয়ে যেতে চায় স্বাধীনতার নীলতা।
তারা শুধু বলে,
সবাইকে হতে হবে ঘাসের মতো নতমুখ,
সবাইকে হতে হবে একরঙা মৃত্তিকার খন্ড।

বাতাসে ছড়িয়ে আছে বীজ,
যুদ্ধের আহ্বান,
যেখানে চাঁদের আলোয় লেখা ছিল
মানুষের মহত্ত্ব আর স্বপ্নের নবান্ন—
তবুও মানুষেরা যেন
ফিরে যেতে চায় সেই শিকড়হীন কুসুমিত মেঘের ছায়ায়,
নির্বাক হয়ে;
তারা ভুলে গেছে কবে শুরু হয়েছিল প্রথম আলো।
যখন বৃষ্টি ঝরে, তখন আর কেউ জাগে না—
যৌবনের যুদ্ধবিগ্রহের প্রান্তর নিথর হয়ে থাকে
জেগে থাকে কেবল শূন্য পাখিদের শোকাবহ উড়ান।

শিশুরা ও স্বপ্নের স্রোত

প্রতিটি শিশুর চোখে জ্বলছে রুপোলি হরিণের দৃষ্টি,
স্কুলের চার দেয়াল যেন ধূসর গুহার মুখ
আর ভর্তি-কোচিংয়ের শিক্ষকরা পাথরের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে।
তাদের হাতের তেল মাখা গোঁফ যেন মরুভূমির মরীচিকা—
স্বপ্নের চাকা ঘুরছে, টাকা যেন ঝরে পড়ছে মরুভূমিতে বৃষ্টির মতো।
অজান্তেই, প্রতিটি শিশু মুঠোয় ধরে রেখেছে পৃথিবীর আলো,
তবু স্কুলের গেটগুলো দাঁতাল বাঘের মতো হাঁ করে আছে—
লটারি? পরীক্ষা? নাকি মায়া ভেদ করা প্রাচীন কোনো যাদু?
শিশুরা জানে না, তারা সবসময় মুক্ত আকাশের অধিকারী,
কিন্তু দেয়ালের শেকল যেন পাখির পালক ছিঁড়ে নেয়।
তবু প্রতিটি শিশুই সাদা নৌকা, তারা স্রোতের প্রতীক্ষায়—
তাদের কোনো পাহাড় নেই, শুধুই নদীর গান।

মহামায়ার মহাকাব্য

মহালয়ার মৃত্তিকায় মগ্ন,
কালের কুন্ডলী কুয়াশায় ঢাকা।
অশরীরী আলোকে অভিষিক্ত,
দেবীর দৃষ্টি দিগন্তে জাগা।

ষড়ঋতুর সিঁড়িতে সময়ের পায়ে,
আশ্বিনের আঙিনায় অপেক্ষমান।
চণ্ডীপাঠের চক্রব্যূহে চৈতন্য,
মহিষাসুরের মৃত্যুঘণ্টা বাজে প্রাণ।

কাশফুলের কম্পনে কাঁপে বাতাস,
শিউলির সুবাসে সৃষ্টির স্পন্দন।
নবপত্রিকার নব জীবনের আশ্বাস,
ঘটে ঘটে ঘূর্ণিত হয় বিশ্বভুবন।

ধূসর ধূলিতে ধ্যানমগ্ন ধরা,
শক্তির শঙ্খধ্বনি শোনে কান।
অমাবস্যার অন্ধকারে আলোর ধারা,
মা'র মুখে মৃত্যুঞ্জয়ী হাসির টান।

বোধনের বীজমন্ত্রে বসুধা কাঁপে,
ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় সজল সাজে সৃষ্টি।
সপ্তমীর সূর্যোদয়ে সোনার স্বপ্ন,
অষ্টমীর অর্ঘ্যে অমৃতের বৃষ্টি।

নবমীর নিশীথে নক্ষত্রের নৃত্য,
দশমীর দিগন্তে দুঃখের ছায়া।
বিসর্জনের বেদনায় বিধুর বিশ্ব,
প্রতীক্ষার পাথরে পড়ে মায়ার মায়া।

জঙ্গির নক্ষত্রপথে

চাঁদ আর পিঁপড়ের স্বপ্নে সূর্যাস্ত ভাঙে—
এই শহরের রাতজাগা রাস্তায় রক্তের ফেনা,
পুড়ে যাওয়া বাঁশির সুরে জেগে ওঠে শাপলা ফুলের
নির্জন আর্তনাদ, বিষণ্ণ কুয়াশা ঘিরে ধরে ঘুমন্ত ভোর।
কেউ জানে না কোন নীল সাপের ছোবলে নীল হয়ে যায়
মেঘের শরীর, কিংবা গাছেরা কেন হঠাৎ
অন্ধের মত ঢেকে ফেলে তাদের সবুজ চোখ।

বাতাসে ভেসে আসে পতাকার ছেঁড়া শব্দ—
ধন ধান্য পুষ্প ভরা এক জীর্ণ স্বপ্নের
জাল বুনে গেছে কেউ, মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা
কিছু অন্ধকারের গানের ভাষা।
যে ছাত্র একদিন পতাকা হাতে তুলেছিল,
সেই হাত আজ অন্য রঙের ছায়ায় ঢাকা,
শীতল আগুনের গোলা ছুড়ে দেয় আকাশের দিকে।
এই তো সেই অজগরের মিছিল,
যারা রক্ত চেনে, অথচ রক্তের রঙ চিনতে পারে না।
তাদের পতাকা এখন আর দেশ নয়,
নিঃসীম অন্ধকারের ভিতর তারা গানে বাঁধে
পৃথিবীর পতন।

তারা জানে না—
গানটা কখনোই তাদের ছিল না।
যে মাটি একদিন স্বাধীনতার আলোয় ফুল ফুটিয়েছিল,
সেই মাটির নিচে জেগে ওঠে এক মৃত নদী,
জলের গা থেকে উঠে আসে নীরব অশ্রুরা,
আর ইতিহাসের দণ্ডহীন প্রহরীরা
প্রশ্নহীন চোখ নিয়ে দেখছে গুমোট আকাশের ভিতর
এক অদৃশ্য মহাকাশের কারাগার।

তারা জানে না—
জীবনের পাতা ঝরছে, রাতের ধুলোয় মিশে যাচ্ছে
সবুজ বিপ্লবের গল্পগুলো।
পৃথিবীর এই ছেঁড়া ছেঁড়া মানচিত্রে আজও
কেউ বুনছে সাপের নীল নকশা,
শব্দহীনতায় ছোবলের কান্না মিশিয়ে
তারা জন্ম দেয় নতুন পতাকার মিথ্যে বুদ্ধিজীবী।

তবু এই পথের শেষে,
যখন রাত্রি আর আলো দুই-ই হারায়,
মাটির নিচে কোনো বিস্মৃত ফুলের মন্ত্রে
কেউ হয়তো আবার গান বাঁধবে—
নীরবতা ভাঙবে সেই মহাকালের খসে পড়া পাতা,
যেখানে লেখা থাকবে
এক দেশ, এক রাত্রি, এক শেষ পতন।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সন্ধিক্ষণে

অলীক সন্ধ্যার আলোয়, যখন পৃথিবীর সবুজ-নীল ব্যঞ্জনা যেন শূন্যতায় মিশে যায়
আকাশের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি খুলে যায় ধীর ছন্দে—
দীপ্ত তিতিরের ডানায় ঝুলে থাকে অযুত নামহীন ভাষার পাঠ
যেখানে জ্ঞানের ঝরনা ঝরে বুনো অরণ্যের গোপন ঝিলের কাছে।

অবিনশ্বর অধ্যায়গুলি ভাসে কালের তরঙ্গে—
মনে হয় যেন প্রতিটি শিক্ষকের হৃদয়ে জেগে ওঠে
অসংখ্য অভিসার, স্রোতের মতো গাঢ় হয়ে বয়
অমৃতের মতো কথা, যা সময়কে বাঁধে শেকলে।

তারা যেন পৃথিবীর হারানো দিকগুলিকে মেলে ধরে
দ্রোহের মতো, স্বপ্নের মতো, মুক্তির মতো—
প্রাচীন নিঃশব্দে নিত্য নতুন শব্দের সঙ্গীত,
প্রাচীর ভেঙে পড়া রৌদ্রের প্রান্তিক আলোয় ফুটে ওঠে চিরন্তন চিত্রপট।

শিক্ষকেরা যেন ওই দিকভ্রান্ত আলোকবর্তিকা
যাদের আলোর ছোঁয়া হিমালয়ের চূড়ায়, আর সমুদ্রের অন্ধকার গহ্বরে
তাদের হাতে জন্ম নেয় নতুন দিনের সূর্য—
নির্মিত হয় ভবিষ্যতের সেতু, চেতনার অপরূপ নদী বয়ে যায় দিগন্ত ছাড়িয়ে।

তারা রচনা করে প্রতিদিনের প্রার্থনা—
যে প্রার্থনায় কাঁপে মহাকালের অলিখিত নিয়ম,
যেখানে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে জ্বলে ওঠে চিরন্তন বিদ্যুতের শিখা
আর সে শিখায় জীবনের সমস্ত রাত—সব প্রশ্নের জবাব মেলে
অজানার পথে তারা চলে এক নির্লিপ্ত ধ্যানমগ্ন সাধকের মতো
অদৃশ্য নক্ষত্রের দূরত্ব ধরে রেখে—
মুখ তুলে তাকায় আকাশের ছায়া, আর জাগায় পৃথিবীর সত্তার অন্তর্নিহিত আলোর।

কালো নিশানার সওয়ারি

কালিমার অন্ধকারের হাত ধরে মলিন পূর্ণিমা জেগে ওঠে—
বনমালার ডালে অজানা শিকারির ফাঁদে ঝুলে থাকে দুঃস্বপ্নের হরিণ;
নির্বিকার শূন্যতায় আকাশের চোখে ভাসে থমকে যাওয়া নক্ষত্রের দল—
বৃথা পাখির পাখনায় আজ শস্যখেতের সোনালি স্বপ্ন পুড়ে ছাই।

বিষণ্ণতার শঙ্খধ্বনি নিয়ে, কেউ যেন হাঁটে অদ্ভুত মিছিলে—
কৃষ্ণপক্ষের বুকে দাঁড়িয়ে এক পলাতক ভোরের মেঘ শিখিয়ে দেয় বিষণ্ণতার ভাষা।
মেঘমালা ছেয়ে দেয় শস্যের মাঠ, নদীর কূলে লুকিয়ে থাকে সত্তার গভীর গুহা—
ধুলো জমা দেয়ালে ছায়ার মতো হাঁটে একাকী এক মৃত্যুময় আলো।

নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো সবুজ খেতের বুক চিরে যায় শূন্যতায়—
সেই পথ ধরে ক্লান্তি আর নৈঃশব্দের মাঝেই কেউ তুলে নেয় নিস্তব্ধতার নিশানা।
ধূসর ভুবনে ছায়া ফেলে বিষাদমাখা দিন—
যেনো দেশ আজ স্বপ্নহীন, আলোর অভাবে কালিমার সিন্দুর মেখেছে কপালে।

এখন আর বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই

এখন আর বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই—
আমার দৃষ্টি নদীর মতো প্রান্তিক, যেখানে শূন্যতার ঢেউ খেলে যায় নীলাভ দিগন্তে।
মেঘেরা দাম হাঁকে; অদ্ভুত সাদা ফুলের গন্ধে মৃদু ঝাপটায় বাতাস—
আমার পকেট শূন্য, অন্ধকারে ভরে গেছে; তবুও কালো রুপালি রোদ ভেসে আসে নীল আকাশে।
রূপকথার সেই বাজার এখন ধূসর হয়ে গেছে;
মেঘেরা ঘুরে ঘুরে নক্ষত্রের টুকরো বিক্রি করে—
একদিন হয়তো আমি নক্ষত্র কিনতে যেতাম; আজ ভিখারির মতন উষ্ণতা খুঁজি মহাশূন্যে।

কেনা-বেচার গল্পগুলো সব এক হয়ে গেছে, মিশে গেছে শূন্যতায়—
আমার সংসারের ভাঁড়ার আর কিচ্ছু নেই;
কেবল এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা জেগে আছে,
নিম্ন মধ্যবিত্ত স্বপ্নেরা আজ হারিয়েছে তাদের শেষ সূর্যরশ্মি—
দারিদ্র্যের ছায়ায় ভেসে চলে ম্লান মুখের হাসি।

আজ রাত্রি আসে দেরি করে,
তারাও যেমন আসে না রাতের আকাশে;
বাজারের সেই গল্প—
আর আমাদের নেই, শুধু বেঁচে থাকা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আঁধারে।

একুশের নতুন অধ্যায়

বাংলাদেশের বিবেকের বাতায়নে
অন্ধকারের অচিন পাখি,
মুক্তচিন্তার মৃত্যুঘণ্টা বাজে
নীরবতার সাক্ষী।

যুক্তির আলো নিভে যায় ধীরে
ধর্মের ধ্বজা ওড়ে,
বাকস্বাধীনতা বন্দি হয়েছে
কালো মেঘের কোরে।

হিন্দু মন্দির ভগ্নস্তূপে আজ
বিষাদ গাঁথে মালা,
পাহাড়িদের রক্তে রাঙা
প্রকৃতির সবুজ শালা।

সমকামীর স্বপ্নগুলো আজ
নিঃশব্দ কান্নায় ভেসে,
হিজাবের অন্তরালে লুকায়
স্বাধীনতার শেষ রেশে।

ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে
মুক্তিযুদ্ধের গান,
নতুন কথা লিখে যাচ্ছে
কালের নির্মম বয়ান।

বাউলের একতারা স্তব্ধ
সুফির দরগায় তালা,
একুশের ফুল আজ শুকিয়ে
বৈশাখের রঙ পালা।

প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
কোথায় তোমার ডাক?
বাংলার প্রাণ জেগে ওঠে না
শুধু অশ্রুর ঝাঁক।

আত্মার সংলাপ

– কহো মোরে, কত দূরে নীল আকাশ?
   রজনী কি গাঢ় কালো অন্ধকার?
   তারকারা কত একা নিঃসঙ্গ নিশ্বাস?
   ধরণি কি মৌন এই নিরাকার?

– যত দূর আকাশ, তত নিকটে তাহার,
   যত কালো রাত্রি, তত উজ্জ্বল প্রভা।
   যত একা তারা, তত প্রিয় অনিবার,
   যত নীরব মৃত্তিকা, তত সঙ্গ-দাতা।

– কবে হবে অরুণোদয়, কহো মোরে?
   কবে ভাঙ্গিবে তিমির এই অন্ধকার?
   কুসুম প্রস্ফুটিত হবে কোন্ ভোরে?
   পাখিরা গাহিবে কবে সুর অপার?

– হৃদয়ে তোমার উদিবে সূর্য প্রভাত,
   চিন্তায় তোমার লুকায়িত অন্ধকার।
   স্বপনে তোমার ফুটিবে কুসুম সাক্ষাৎ,
   কণ্ঠে তব বাজিবে পাখির গান আবার।

– কে তুমি, হে তিমির রাতের গায়ক?
   কে বাজায় এই একাকী মর্মর?
   কে জ্বালিল দীপশিখা ম্লান কতক?
   কে ছড়ায় শীতল স্পর্শ নিরন্তর?

– আমি সেই অন্ধকার তব অন্তরের,
   তোমারি নিঃসঙ্গতা, স্বপ্ন অপরূপ।
   আমি সেই কণ্ঠস্বর তব প্রাণের,
   তোমারি প্রতিবিম্ব, তোমারি স্বরূপ।

– তবে কেন এত কষ্ট, এত ব্যথা?
   কেন এত হতাশা, দীর্ঘশ্বাস?
   উত্তর দাও মোরে, কহো এ কথা,
   কেন এত যন্ত্রণা, কেন এ ত্রাস?

– কষ্টে তব অন্বেষণ, ব্যথায় বোধন,
   হতাশায় প্রয়াস তব অবিরাম।
   নিশ্বাসে তোমার জীবন-স্পন্দন,
   এই সব মিলে তব পূর্ণ পরিণাম।

– তবে কি নাহিক আশা, ভালোবাসা?
   সুখ কি অলভ্য, শান্তি কি দুর্লভ?
   উত্তর দাও মোরে, মিটাও পিপাসা,
   কোথা পাব জীবনের পরম বৈভব?

– আশা তব পথ চলা, প্রেম তব লক্ষ্য,
   সুখ তব অর্জন, শান্তি নিজ প্রাণ।
   এ সকল তোমাতেই রয়েছে নিক্ষিপ্ত,
   খুঁজে নাও নিজ মাঝে জীবন-সন্ধান।

– তবে মোরে দেখাও পথ, নাও হে লইয়া,
   পূর্ণ করো আত্মা মম অর্জনে।
   দাও মোরে সেই জ্ঞান, যাই যে জানিয়া,
   কোথা আছে পরম শান্তি এ জীবনে।

– অন্তরে তোমার পথ, হৃদয়ে লক্ষ্য,
   কর্মে তব অর্জন, সত্তায় আত্মা।
   তুমিই তোমার গুরু, তুমিই তো শিষ্য,
   নিজেরে চিনিলে পাবে পরম সত্তা।

নিঃশব্দ নক্ষত্রের আর্তনাদ

নিষিদ্ধ মৈত্রীর আকাশে জ্বলে অসহায় তারকা,
হিংস্র আইনের জালে বন্দি স্বপ্নের শারিকা।
কাবুলের রাতে শুনি কান পেতে অশ্রুর মর্মর,
বিধর্মী বন্ধুর হাহাকারে কাঁপে পর্বতশিখর।
হিন্দুকুশের বরফে লেখা অদৃশ্য ইতিহাস,
বামিয়ানের ধ্বংসস্তূপে ঘুমায় উদাস আকাশ।
নীরব প্রার্থনার স্বর
মিশে যায় ধূসর ধোঁয়ায়, বিলীন হয় অন্তর।

কে বলে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ? প্রেম কি আইনের দাস?
মানবতার সেতু ভেঙে দেয় কোন্ অমানুষ শ্বাস?
পাষাণ হৃদয়ে জমাট বাঁধা বিভেদের কালো ছায়া,
সহানুভূতির বীজ মরে, ঘেরা শুকনো মরুর মায়া।
গান্ধারের প্রাচীন মাটিতে নতুন যুগের ত্রাস,
বুদ্ধের হাসি মুছে যায় আজ, বাড়ে যারা হতাশ।
অসহিষ্ণুতার জ্বালা
দগ্ধ করে মানবতার শেষ সবুজ পাতার ডালা।

হিন্দু, শিখ, ইহুদি, খ্রিষ্টান- সবাই এক প্রাণ!
তবু কেন এ বৈরিতা? কেন এ মিথ্যা অভিমান?
যে দেশে একদা ফুটেছিল জ্ঞানের কুসুম দল,
সেথায় আজ শুধু বিষাদের নীল আঁধার অতল।
সভ্যতার দোলনায় দুলছে অন্ধকার ছায়া,
মানবিকতার শেষ আলোটুকু নিভে যায়, হায় হায়া!
হে বিবেক! জাগো আজ!
ভেঙে দাও এ বন্ধন, ঘুচাও এ লজ্জার লাজ!

আফগান মাটির বুকে আজও বয় করুণার হাওয়া,
প্রেমের বীণায় বাজে ধীরে সুরের নীরব দাওয়া।
মাজার শরীফের গম্বুজে ঘুমায় পবিত্র স্বপন,
হেরাতের মসজিদে আজও জাগে শান্তির অর্পণ।
বাঁধন ছেঁড়ার দিন আসবে, ফুটবে নতুন ফুল,
মানুষে মানুষে মিলনের পথে সরবে কাঁটার শূল।
জাগবে নতুন প্রভাত,
মৈত্রীর আলোয় ধুয়ে যাবে সব পুরনো আঘাত।

রক্তাক্ত বাংলার বিলাপ

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেশকে দেখি।
ক্ষত ঢাকি, রক্ত মুছি,
কখনও স্বপ্নের ছবি আঁকি,
ফিসফিস করে বাংলাকে জিজ্ঞাসা করি,
'কেমন আছ, স্বাধীনতা?'
কখনও কখনও নিজেকে বলি,
'পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল,
যদি আর একটু টিকে থাকো,
শতবর্ষী হবে।'
নিজের ব্যঙ্গে নিজেই কাঁদি
দেশ অর্থাৎ আমি নিজে এবং আয়নার বাংলাদেশ।
এইরকম ভাবে একদিন,
হুঙ্কার নেই, গর্জন নেই আয়নার বাংলা
কি ছলনায় কালো আইনের জালে জড়িয়ে পড়ে।
আমি তাকে বোঝাই,'এ হবে না, এ হতে পারে না।'
সে আমাকে বোঝায়,'এ হবে না, এ হতে পারে না।'
আয়নার সামনে এইরকম তর্কাতর্কি হতে হতে
হঠাৎ সে আমাকে এক ধাক্কায়
মধ্যযুগের অন্ধকারে ফেলে দেয়।
তারপর থেকে আমি মৌলবাদের কারাগারে।
আর যে দেশ নিয়ে আপনাদের গর্ব, আশা,
সে বাংলাদেশ আর নেই,
এটা তার ছায়া।

রক্তাক্ত জামার বিলাপ

রক্তের নদীতে ভাসে বাংলাদেশ, ছিন্নভিন্ন তার বসন,
প্রতিদিন সন্ধ্যা নামে যেন মৃত্যুর কালো আবরণ।
মৌলবাদীরা হাসে অন্ধকারে, আনন্দে করে নৃত্য,
দেশ ফিরে যায় মধ্যযুগেতে, কালো আইনের কৃত্য।
আফগানের চেয়ে নিকৃষ্ট দিন আসছে আমাদের তরে,
আমরা যে এই পৃথিবীর বুকে, কর্কটের মতো ঝরে।
হিযবুত তাহরীর -
ধ্বংসের মাস্টারমাইন্ড এরা, নিষিদ্ধ সন্ত্রাস-বীর।

কে বলে জামাটা রক্তে ভেজা? তা যে আত্মার পরিধান,
স্বপ্নের সুতায় বোনা ছিল যা, এখন শুধুই অভিমান।
বাঙালি জাতির হৃদয়-বীণায় বাজে মৃত্যুর সুর,
স্বাধীনতার সূর্য ডোবে যেন কালো মেঘের পুর।
ইতিহাসের চাকা ঘুরে যায়, পিছনে ফেরে দেশ,
অন্ধকারের গর্ভে হারায় আলোকিত স্বদেশ।
নবীন কালের ত্রাস -
আকাশে বাতাসে ছড়ায় যেন বিষাক্ত নিশ্বাস।

গণতন্ত্রের মৃতদেহ নাচে পুতুলের মতো আজ,
স্বাধীনতার স্তম্ভ ভেঙে পড়ে, ধ্বংসস্তূপে সাজ।
হেথায় তোমার স্বপ্ন ভেঙেছে, হেথায় তোমার ত্রাস;
যুগ যুগ ধরি এই মাটিতে বুনেছিলে তুমি আশ,
গড়েছিলে দেশ রক্তের দামে, স্বাধীনতার গানে,
চোখে তোমার বাংলার আলো - বাংলার প্রাণ জানে,
হে প্রিয় বাংলাদেশ
তোমার তরে কাঁদছে আজ কোটি কোটি শেষ।

এ বাংলাভূমি নয়কো তোমার, নয়কো আমার একা,
হেথায় পড়েছে শহিদের রক্ত - স্বাধীনতার রেখা,
বাঙালি মনীষা জেগেছে এখানে সবুজ ঘাসের ঘ্রাণে,
পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে সোনার বাংলার প্রাণে!
ঢাকা চট্টগ্রাম খুলনা বরিশাল রাজশাহী রংপুর,
কক্সবাজার সুন্দরবন তার গাঁথে অমর পুর!
বাংলার কবি গাহে -
কালের বুকেতে লেখে ইতিহাস রক্তাক্ত এই দাহে!

এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার পাল
স্বপ্নের বীজ বুনেছিল যারা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকাল!
গিয়েছে তাদের আত্মবলিদান মুক্তির লক্ষ্যে ছুটে
পরশে তাদের জেগেছিল দেশ শৃঙ্খল যত টুটে!
জেগেছিল নব গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন,
যমুনা পদ্মার জলে জলে যেন ফুটেছিল নব প্রশ্ন
অমলিন প্রেমের রাগে
স্বাধীন দেশের সবুজ পতাকা উষার আলোয় জাগে!

জেগেছে হেথায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি - কালের বুকে
বারবার যার উজ্জ্বল আলোর পরশ উঠিল ফুটে।
বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযোদ্ধা - রক্তের বন্যায় ভেসে
গড়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ এক নতুন দেশের বেশে!
ছড়িয়ে রয়েছে অমর কীর্তি - অক্ষয়, অনুপম!
মেঘের ছায়ায় খুঁজে পাই আমি চিরন্তন সঙ্গম
যেন কবিতার ছন্দে
স্বপনের ঘোরে মুগ্ধ করিয়া রেখেছে সোনার বন্দে!

বাংলাদেশের অযুত প্রহর, লক্ষ শহিদের স্মৃতি
আজও বুকের গভীরে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি -
আজও অযুত মা-বোনেদের আর্তনাদ ঘিরে
অতীত যুদ্ধের রক্তাক্ত চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!
দিকে দিকে আজও বেজে ওঠে কোন্ মুক্তির গান!
পথহারা কোন্ দেশপ্রেমিকের স্বরে কাঁদে সারা প্রাণ!
নিখিল বাংলাময়
স্বাধীনতার স্বপ্ন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!

এসেছিল যারা রক্তের বন্যা সীমান্তপথ বেয়ে,
একদা যাদের আত্মত্যাগে বাংলাদেশ গেছিল ছেয়ে,
আজিকে তাহারা স্মৃতির পাতায়, ইতিহাসের পাতায়;
তাদের ত্যাগের ফসল আমরা, তাদের কীর্তি গাঁথায়
জাতি ধর্ম ভেদ টুটিয়া গিয়াছে ছুটিয়া গিয়াছে দ্বন্দ্ব,
স্বাধীন দেশ বিনা অসম্পূর্ণ, বিফল মুক্তির ছন্দ,
মহামিলনের তান
বাজিছে আকাশে নব বাংলার গরিমায় গরীয়ান!

অস্তিত্বের অরণ্যরাগ

শূন্যতার শাখায় শাস্ত্রের শিকল বাজে;
বিধির বিধানে বিশ্বাসের বীজ বিলীন।
কোথাও ধর্মের ধ্বজা ধ্বংসের দিকে ধাবিত - তবু।
সহস্র সংস্কৃতির সমাধি সাজে - অন্ধকারে অসহিষ্ণু অণুর আর্তনাদ
বিষণ্ণতার বোঝা বয়ে চলে;
এ কোন মরুর মর্মর:
সহিষ্ণুতার - সংকীর্ণতার?
এ কি সভ্যতা?
অনাগত অবনতির অঙ্কুর ফোটে যেন।
একটি মতের মোহ মেনে -
সময় কি অবশেষে এমন শাসনতন্ত্রে
আগামী প্রজন্মের প্রাণপুরুষের স্বপ্ন চুরমার করে জাগে?
কোথাও মন্দিরের মৃদঙ্গ বাজে;
কোন দিকে শরিয়তি সুর -
পূর্বের পথে,
পশ্চিমের প্রান্তে,
দক্ষিণের দেশে?
বৈচিত্র্যের বিলুপ্তির ত্রাসে;
তবু মানবতার মহীরুহের মতো মহিমায়
সহাবস্থানের সকল সুরেলা স্বর শুনি;
শান্তির বদলে তবু সেখানে আতঙ্ক অরুণোদয়
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী - তুমি?
ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মনিরপেক্ষ, ওইদিকে নীল
আকাশের পরিবর্তে শরিয়তি শাসন নিখিল বিভীষিকা!
মিলায় না মৌলিকতা - নিত্য দিগন্তহীন;
যা ছিল - যা হারাবে -
সেই মহাবিপর্যয়ের গর্ভে ধ্বংসের মতো জ্বলে
জাগে না কি হে স্বাধীনতা - হে সংবিধান -
বিবেকহীন বিধির বিলাপে।

অস্তিত্বের অন্তরালে

মানচিত্রের রক্তাক্ত পৃষ্ঠা থেকে উঠেছে আমার চেতনার বীজ -
ইতিহাসের কণ্টকিত মাটি থেকে; তাই স্বপ্ন লাগে বিষ — তাই স্মৃতির আকাশ
কুয়াশাচ্ছন্ন, বিদ্রোহী বেদনায় ভরা; — পথে পথে এই ত্যাগ
প্রতারণার মতো তীক্ষ্ণ মনে হয়, — ভণ্ডামির যেন নিঃসীম নীড়
এই দেশ; — যত গভীরে যাই আমি আরো যত গহীন অন্ধকার
কঠিন পায়ের তলে যেন কত শহিদের রক্তের নিঃশ্বাস
চিৎকার করে — তাদের আত্মা কাঁপে — তাদের স্বপ্নে এলো ধ্বংস
ছড়িয়ে যায় — ক্ষমতার গন্ধে আসে তারা — অনেক নির্মম
বিকৃত আদর্শের কথা কয়ে যায় — মুক্তির প্রতারণার কথা –
অপব্যাখ্যার কুটিল নগ্ন কথা — ধর্মের ছদ্মবেশী গল্প করে –
স্বার্থের নক্ষত্রের কথা কয়; — বিবেকের শীর্ণ সরলতা
তাদের ভয় পায়, — অন্যায়েরে ভালো লাগে হৃদয়ের উপরে;
কুৎসিত লোভের ফাঁদ ভালো লাগে; অন্ধ রাতে — ন্যায়ের নম্রতা;
ভালো লাগে এই যে মানবতা আজ চিরতরে নীরবে ঝরে।

নিঃশব্দ প্রহরের অশ্রুবিন্দু

ক্ষতচিহ্নে জন্মগ্রহণের মুহূর্তে ফুটে ওঠে অস্তিত্বের বীজ।
অবিরাম নির্যাতনের ঘূর্ণিপাকে ভেসে যায় আত্মার প্রদীপ।
প্রশ্ন করে অন্তরাত্মা, "কেন এই অবিচার?
কেন জন্মের সাথে সই করতে হয় মৃত্যুর দলিল?"
অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায় আকাশের দিকে, জিজ্ঞাসা করে:
"আমরা কি অপরাধী ছিলাম আমাদের বিশ্বাসে?
আমরা কি অসত্য ছিলাম আমাদের প্রার্থনায়?
আমরা কি অবৈধ ছিলাম আমাদের জন্মভূমিতে?
তবে কেন, কেন আমাদের এই—"

নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেন তিনি ইতিহাসের দরজায়। বললেন, "শোনো
স্বাধীনতার মিথ্যা আশ্বাসে মোহগ্রস্ত
তোমরা সকলেই ছিলে নিজের অস্তিত্বে বিস্মৃত।"
সবার দিকে একে একে তাকিয়ে তিনি বললেন, "তুমি ভেবেছিলে
তোমার ধর্মের নামে তোমাকে কেউ স্পর্শ করবে না
তুমিই নিরাপদ আর সমস্ত বিপদ তোমাকে এড়িয়ে যাবে ভেবেছিলে
ভেবেছিলে মুহূর্তেই পাবে স্বাধীনতার স্বাদ এই মাটিতে
কখনও-বা ভুলে গেছ মেনেছ পরাধীনতার সীমা
আর তুমি
যদিও তোমাকে আমরা আমাদের সকলেরই জানি
পুষেছ তবু গভীর গভীর অতিগভীর তত-গভীর-ও-না ক্ষতবিক্ষত স্মৃতি
আর আমি, তোমাকে রক্ষা করব বলে হঠাৎ মিথ্যাবাদী, বুঝি
তোমরা কেউ জানোনি যে বহুদিন আগে তোমরা নির্বাসিত!"

নীরবতায় মিলিয়ে যায় কণ্ঠ। স্তব্ধ প্রাণ। তার পর
তিনি ফিরে তাকালেন আমাদের দিকে। বললেন, "এবার
আসুন এক যুগ আমরা নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাই।"

বিলুপ্তির বিলাপ

মৃত্যুঘণ্টা বাজে রাতে, শ্মশানের ছাই-এ দাঁড়ি—
তোমারই অস্থিমালা আমার বিষণ্ণ স্বপ্নচারী।

তুমি সেই দেশ তুমি আমার ক্ষতবিক্ষত প্রাণ
নির্বাক যাকে আমি অনায়াসে ভুলতে পারতাম
তবু তুমি জাগিয়ে রাখো মৃত্যুর অন্ধকার গর্তে
ধ্বংসের ধ্বজা তুলে আকাশছায়া করো অবিরাম
যে-কোনো বিপ্লবঝড়ে উৎসবে মিলিয়ে যেতে যেতে
তোমার বেদনা যে কখনো বুঝিনি এক কণা
সেকথা জেনেও তবু রয়েছ আমারই রক্তে রক্তে
কী-বা হবে লাভ যদি কেউ কারো হৃদয় না-চেনা!
শিয়রে অমানিশার কুহেলিকা করেছে আচ্ছন্ন
লক্ষ লক্ষ মৃতাত্মার চোখের জলেতে সাঁতার
দুধারে নীরব ক্রন্দন, তার মাঝখানে তুমি শূন্য
দাঁড়াও, দাঁড়িয়ে থাকো। মরুক, যে মরতে চায় আর।

আবারও জ্বলেছে আগুন, ভস্মের উপরে ওঠো তুমি
তোমাকেই দেখি আজ আমার বিনষ্টজন্মভূমি।

অস্তিত্বের অন্ধকারে

এই তো ছিল স্বপ্ন, এই তো ছিল আশার আলো
এই তো গণতন্ত্রের বীজ বুনেছি মাটিতে কালো
এই তো ন্যায়ের ফসল ফলবে বলে করেছি আশা
এই তো স্বাধীনতার পাখি গেয়েছিল সকাল-সন্ধ্যা
এই তো মুক্তির নদী বয়ে গেল দেশের বুকে
এই তো অন্ধকার নেমে এল হঠাৎ চোখের সুখে
এই তো বিবেকের কণ্ঠ হল রুদ্ধ কালের গ্রাসে
এই তো ন্যায়ের দণ্ড ভেঙে পড়ল অন্যায়ের ত্রাসে
এই তো সত্যের সূর্য ডুবে গেল মিথ্যার জলে ।
কোথায় সে স্বপ্নগুলো? সব কি মিলায় অতলে?

আধুনিক স্বাধীনতার বিভ্রম

কালচক্রের কাঁটা কাটে কুসংস্কারের কুহেলি,
স্বপ্নের স্বাধীনতা স্খলিত হয়, সভ্যতার সেঁতসেঁতে গলি।
প্রগতির পাখা ভেঙে পড়ে পশ্চাৎপদতার পাঁকে,
চৌদ্দশ' বছরের অন্ধকার আসে ফিরে ডাকে।
হিংস্র হায়েনার হাঁক শোনা যায় হৃদয়ের দ্বারে,
সংখ্যালঘুর স্বপ্ন ডুবে যায় অসহিষ্ণুতার ধারে।
মরীচিকার মরুভূমিতে মানবতা মৃতপ্রায়,
অন্তর্বর্তী অরাজকতা অশনির মতো ঝলকায়।
স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা স্তব্ধ হয়ে চায়,
বিবেকের বীজ বিনষ্ট হয় বিষাক্ত বাতাসে হায়।

উদাস চাঁদের হাঁড়ি

ক্ষুধার্ত আকাশে জ্বলে ওঠে চাঁদের হাঁড়ি—ধীরে ধীরে স্বপ্ন ক্ষয় হয়
ভাঙা দেয়ালে নোনতা কান্নার ফোঁটা—শব্দহীন প্রতিবাদ জমে থাকে অসময়
রুটির গন্ধে এসে, শূন্য হাতের কাছে
অভুক্ত বাতাস বহুক্ষণ নীরবে কাঁদে তায়
এইসব বেদনা লাগে: এইসব তীব্র জ্বালা মৃত্যু স্বাদ পায়
বাংলাদেশের পথে ঘুরে আমার হৃদয়
নোনতা কান্নার ফোঁটা ভাঙা দেয়ালে—ধীরে ধীরে স্বপ্ন ক্ষয় হয়
ছিন্নবস্ত্রের দাম মুঠোয় নিয়ে দারিদ্র্য দাঁড়ায়।
এইসব ব্যথা পাই—জীবনের পথে ঘুরে
এইসব ব্যথা পায় আমার হৃদয়
দেশে অন্ধকার, স্বপ্ন ক্ষয় হলো  অসময়
ক্ষুধার্ত চাঁদ জ্বলে ওঠে, ধীরে ধীরে স্বপ্ন ক্ষয় হয়
ভাঙা দেয়ালে অশ্রুর বীজ ঝরে—নীরবতা বসে থাকে মুহূর্ত সময়
ছিন্নবস্ত্রের দাম মুঠোয় নিয়ে দারিদ্র্য দাঁড়ায়
ক্ষীণ আরো ক্ষীণ হয়ে অনাহারী আত্মায় হারায়।।

সুবলের স্বদেশ ত্যাগ

কত যুগে-মহাকালে স্বপ্নের তরণি ভেসে যায় নিঃশব্দ সাগরে,
সুবলের চোখে আজ বিষণ্ণতার কুয়াশা - মায়াবী অন্তরে
জাগে শূন্যতার বীজ; ধর্মের প্রাচীরে ফোটে রক্তাভ কেশর,
গ্রামের আঙিনায় তার অস্তিত্বের ছায়া হয় ক্ষীণতর।
বাঙালি হৃদয়ে তার জলছবি আঁকে কোন অদৃশ্য চিত্রকর,
স্মৃতির পাতায় লেখে ইতিহাসের কাহিনি - অমর অক্ষর।
বিশ্বাসের বাঁধন যেন চিরন্তন নদীর প্রবাহে ভাসমান,
সীমান্তের ওপারে যে দেশ, সেথা কি পাবে সে নতুন প্রাণ?

প্রতিবেশী কণ্ঠস্বরে শোনা যায় বিদায়ের করুণ আহ্বান,
সুবলের মনে জাগে প্রশ্ন: কোথায় তার দেশ, কোথায় নিবাস?
মাটির গন্ধে মেশা তার রক্তে বয় বঙ্গভূমির অভিমান,
তবু কেন ছেড়ে যেতে হবে তারে? কেন এ নির্মম পরিহাস?
ভারতের দিকে চেয়ে ভাবে সে: সেখানে কি মিলবে সম্মান?
অথবা সেখানেও কি অপেক্ষা করে শুধু নীরব নিশ্বাস?

সত্যের শিকলভাঙা অশ্রু

চিন্তাশূন্য মস্তিষ্কের শূন্যগর্ভে ঝুলন্ত সত্যের শবদেহ,
মিথ্যার মায়াজালে আবদ্ধ । বিষাক্ত বাতাসে ভেসে
হিযবুত হিংস্রতার হাহাকার শোনা যায়
স্বপ্নের স্বাধীনতা হারিয়ে গেছে অন্ধকারের অতলে
যেখানে মুক্তির আলো নিভে গেছে অনেক আগেই ।
বাংলার বুকে বেদনার বীজ বপন করে
প্রতারণার প্রাচীর তুলেছে যারা, তাদের উদ্দেশ্যে :
'হে অমানুষ,
তোমরা যে কবরখানা সাজিয়েছ জীবন্ত মানুষের জন্য
সেখানে আজ ফুটেছে বিষফুল, পাপড়িতে তার
জমে আছে অশ্রুর শিশির, রক্তের রঙ ।
তোমাদের মিথ্যার মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে
গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে দেশের কোণে কোণে ।
স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা চোখগুলো আজ নিষ্প্রভ
তবুও জেগে আছে অন্তরের অন্ধকারে ।
তোমরা যে ভাষা কেড়ে নিয়েছ, সেই ভাষায়
আজও গর্জে ওঠে প্রতিবাদের ঝড় ।
দেশের মাটি হয়েছে বিষাক্ত, বাতাস দূষিত
তবু এই মাটিতেই জন্ম নেবে নতুন প্রজন্ম ।
জানি না কবে ফিরবে স্বাভাবিকতা, কবে আসবে মুক্তির দিন
হয়তো আমি দেখতে পাব না সেই সকাল ।'
যখন গোটা দেশটা পড়ে আছে মিথ্যার জালে আটকে
তখন সত্যের কবিতা লেখা যায় শুধু রক্ত দিয়ে ।
মানচিত্রে আঁকা সীমানা পেরিয়ে উড়ে যায় পাখি
কিন্তু মানুষের মন আজ বন্দি নিজের দেশেই —
সেই বন্দি মনের কারাগারে শৃঙ্খলিত স্বাধীনতা
চুপচাপ কাঁদছে, কেউ শুনতে পায় না তার কান্না ।

মৃত্যুর দেশ

রক্তাক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
ধ্বংসের পথে কালের কোণে
ভাবি আমার দেশ খুঁজব
দেশ মিলায় অবক্ষয়ে।

একটা দুটো স্বপ্নের কথা
জাগে আমার চেতনা ধরে
স্বপ্ন সব মিথ্যে হয়ে
অস্তিত্বের অন্ধকারে

কে কারে আজ চিনতে পারে
বোঝা কঠিন অতি সত্যি
হা রে আমার ভ্রষ্ট দেশ
হা রে আমার জন্মভূমি!

হারিয়ে গেছে আত্মসত্তা
তোমার সাথে জড়িত যত
শ্মশানে এবে পরিণত
যা-কিছু ছিল সম অমৃত।

দেশের কথা একা বসে
শুনি কেবল কালের কোণে
ক্ষতবিক্ষত দেহ শুধু
পচে মরে বিস্মরণে।

জীবনানন্দের প্রতিচ্ছবি

তুমি কি নিঃসঙ্গ বনলতা সেন
জীবনানন্দ হে কবি।
এই বাংলাদেশে শস্যের চেতন
তোমার অন্তরে ছবি।
ধূসর আকাশে মেঘের নির্ঝর
ঢেকেছে তোমার মন;
কাব্যের নীহারে ভাসছে নিরন্তর
রূপসি বাংলার ধন।

ধানের শিষের মর্মর-মুখর
তোমার কবিতা-বীণা,
প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে অন্তর
গেয়েছ বিরহ-বীণা।
চিল উড়ে যায় সন্ধ্যার আকাশে
তোমার দর্শন-পথে,
হাঁসের পালক ভেসে যায় বাতাসে
নক্ষত্রখচিত রাতে।

তোমার কল্পনা অরণ্যময়ী
প্রকৃতির সাথে এক,
শব্দের মায়ায় রচেছ পৃথিবী
অপরূপ অভিষেক।
কামরূপের কুহেলি-আবরণে
খুঁজেছ জীবন-সত্য,
প্রেমের বেদনা নীল-নির্জনে
হয়েছে কবিতা-তত্ত্ব।

সূর্যাস্তরাগে রক্তিম আভায়
দেখেছ মৃত্যুর ছায়া,
তবুও লিখেছ জীবনের গাথায়
অমৃতলোকের মায়া।
সুরধুনী-তীরে নীলিমার স্রোতে
ভাসিয়ে দিয়েছ প্রাণ,
শরতের শিউলি ঝরেছে আলোতে
তোমার কবিতা-গান।

এখন তুমি যে অনন্ত নীরব
কালের গভীর তলে,
তোমার কবিতা অমর বৈভব
বাংলার বুকে জ্বলে।
ঘাসের দেশের কবি হয়ে তুমি
খুঁজেছ অস্তিত্ব-সার,
এখন তোমার চিরন্তন ভূমি
মৃত্যুর অন্ধকার।

নীরবশূন্যের ঝড়ো অচেতন

নীরবশূন্যের ঝড়ো অচেতন কালমুখো হানছে
স্বপ্নজালের ছিন্ন তন্তু অতীতের পানে হানছে
বিষণ্ণ আশার শেকড় আজ মৃত্তিকায় হানছে
ভেবেছিলাম স্বর্ণযুগ আসবে নবীন প্রভাতে
চৌদ্দশ' বছর পিছন দিকে ধাবমান অন্ধ রাতে
অসভ্যতার কুহেলিকায়, বিবেকহীন পথচলা...
কৃষ্ণচূড়ার ছায়াতলে বিশ্বাসগুলো ভাঙছে
নীলাকাশের তারাগুলি অশ্রুবিন্দু ঝরাচ্ছে
অন্তরীণ স্বাধীনতার স্বপ্ন এখন মরছে
অসহিষ্ণু হায়েনাদল গর্জে ওঠে নিঃশব্দে
সংখ্যালঘু জনতার স্বর কোথাও যেন হারাচ্ছে
বিষণ্ণ আশার শেকড় আজ মৃত্তিকায় হানছে

প্রেমের অভিশাপ

নীলাভ রাতে শূন্যতার কাছে বসি একা—
চিরন্তনী বলে, আমি তোমার অনন্ত দেখা!
—যে ভালোবাসা জেগেছিল শ্রাবণের জলে,
মিলিয়ে গেল কালবৈশাখীর ঝঞ্ঝা-কোলে,
স্বপ্নের মতো মিশেছিল প্রাণে প্রাণে তার;
কই সে আজ?—শূন্য বুকে শুধু হাহাকার!
কাঁদে যে মন নিঃসীম এক আকাঙ্ক্ষার তলে,
কাঁদে যে প্রাণ বিরহব্যথা-ভেজা চোখের জলে,
কাঁদে নিখিল নীরব প্রেমের শূন্য পাথার ছুঁয়ে,
তোমার হৃদয়-মরীচিকায় নিজেরে যায় ভুলে!
কোন্‌ সে দূর নক্ষত্রের পথ ধরে এলে,—
থামবে না তুমি চাঁদনি-ভেজা এ ভুবনতলে!
যাও তবে তুমি—উদাসীর এ পথ বেয়ে চলে
আমার হৃদয়-মন্দিরের দ্বার দিলাম খুলে
অজানা এক সুরের তালে—বেদনার মাঝে।
নিদ্রাহারা, দ্বারে আমার কার পদধ্বনি বাজে!
—কেন আবার ফিরে এলে তুমি স্বপ্নলোক থেকে!
অই বিরহের মহাশূন্যে চরণচিহ্ন রেখে
ছিলাম আমি নিঃসঙ্গতার মুখের পানে চেয়ে,
এলে কেন গো অশ্রুসিক্ত পথ খুঁজে বেয়ে!
থরথরিত প্রাণ, কেশে তব ছায়া নামে ঝরে,
বিষণ্ণ সুর বাজে যেন মৃত্যুর কণ্ঠস্বরে!
তোমার নয়নতারার সনে আমার চোখের তারা
মিশে গেল, তবু কেন এত দূরত্বের ধারা!
—হারিয়ে গেলাম চাঁদনি-ভেজা এ ভুবনতলে;
কাঁদে প্রেম—কে জানে—কবে মুক্তি পাবে বলে!

অস্তিত্বের অস্থিরতা

কথা ছিল স্বপ্ন-বৃক্ষে ফুটবে আশার কুঁড়ি-কলি,
চৌদ্দ যুগের প্রগতির পাখা মেলে উড়বে
স্বাধীনতার নীলাকাশে অবাধ।
কথা ছিল সময়-নদীর স্রোতে ভেসে যাবে কুসংস্কার,
চিন্তার চিতাভস্ম থেকে জন্ম নেবে না
অন্ধকারের অশুভ অঙ্কুর।

কথা ছিল, মানবতার মণিকোঠায় জ্বলবে আলোকবর্তিকা।
ন্যায়ের নীরব নৃত্যে মাতবে প্রতিটি প্রান্তর,
কথা ছিল, অসহিষ্ণুতার অগ্নি নেভাবো একদিন।

অথচ দেখি আজ ইতিহাসের চাকা উল্টো ঘুরছে,
সভ্যতার সোপান ভেঙে পড়ে অনাগত অতীতে,
প্রগতির পদধ্বনি মিলিয়ে যায় দূর দিগন্তে-

কথা ছিল, বৈচিত্র্যের বাগানে ফুটবে নানা রঙের ফুল।
একদিন সম্প্রীতির সুরভিতে ভরে উঠবে
সকল প্রান্তর,
তাদের মিলনের মধুর সুরে বাজবে জীবনের বীণা-
একদিন স্বপ্নদ্রষ্টা এসে বলবে: উত্থান ঘটেছে।

কথা ছিল, মুক্তির মন্ত্র জপে আমরা গড়ব নতুন
আমাদের স্বদেশ, চেতনা, অস্তিত্ব, আমাদের
আত্মার অমৃত উৎস-
চিরকাল এ-মাটি খুঁজে পাবে তার প্রকৃত পরিচয়।

কথা ছিল, কালের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হবে দেশ।
অথচ এখনো দেখি ঘৃণার হানাদার দল
অবিরাম
মানবতার শিকড়ে কুঠার হানে নিঃশব্দে।

স্বাধীনতা-বিধ্বস্ত দেহের ওপর নগ্ন নৃত্য করে
অসহিষ্ণুতার অশরীরী ভূত।

আর কী বিস্ময়! দেখি ইতিহাস
অন্যায়ের জয়গানে মুখর,
প্রলাপ, অমানবিক তান্ডবের নামে রক্তাক্ত পতাকা ওড়ে।

কথা ছিল 'আমাদের ধর্ম হবে মানবতার উন্নয়ন',
আমাদের মন্দির-মসজিদ হবে সমতার সুনীল আকাশ।
অথচ বিভেদের বিষাক্ত বাষ্প ছড়িয়ে পড়ে
অখণ্ড আকাশের দিকে, স্বপ্নের সীমানার দিকে।
অগ্রগতির আশা ডুবে যায় অন্ধকারের অতলে,
আমাদের অস্তিত্ব, ক্ষয়িষ্ণু আমাদের স্বপ্নময় কাল।

মৃত্তিকার স্মৃতি

শিশুটি বলে, "আমাদের ইতিহাস...", তার চোখে
জ্বলে ওঠে সাম্প্রদায়িক আগুনের শিখা, যেন
কালো মেঘের কোলে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সাপের
জিভের মতো দ্বিধাবিভক্ত। আমি দেখি তার মুখে
পুড়ে যাওয়া পাতার মতো ইতিহাসের ছাই, যেখানে
হাজার বছরের বাঙালি রক্তের ধারা শুকিয়ে গেছে
মরুভূমির বালিতে। সে জানে না তার শিরায় বয়
কত যুগের হিন্দু-মুসলিম মিশ্রিত রক্তপ্রবাহ,
কত শতাব্দীর ধর্মান্তরিত পূর্বপুরুষের কান্না।
সে শুধু দেখে সীমানার কাঁটাতার, রক্তাক্ত দাঙ্গা,
ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি, বিষধর রাজনীতির
কালো ছায়া। আজ তার চোখে জ্বলে অন্ধ বিশ্বাসের
আগুন, যা পুড়িয়ে দেয় সহস্র বছরের সম্পর্ক।
উপমহাদেশের বুকে আজও বয়ে যায় সেই বিষ,
মৌলবাদের কালো সাপ এখনও ছোবল মারে প্রতি
মুহূর্তে, আর ইতিহাস কাঁদে নীরবে অন্ধকারে।

ছদ্মযুগের শেষ প্রহর থেকে কথা বলি

আমি এই ছদ্মযুগের শেষ প্রহর থেকে কথা বলি
আমি এই স্বপ্নভঙ্গের মহাশূন্য থেকে কথা বলি
আমার দেশের বক্ষে ছুরি নিয়ে আমি কথা বলি
খেলা খেলেছিল যারা ভবিষ্যতের রক্ত নিয়ে।
মুখোশ পরিয়া যারা সত্যের কবরে নেচেছিল
এই শেষ বিভ্রমের অন্তরালে তাদের কথা বলি
আর যারা জেনেছিল যারা সবকিছু বুঝেছিল
আত্মার ভিতরে যারা সমন্বয়ের ছলনা নিয়ে
দলের মরীচিকায় বিবেকহীন হয়ে ছিল
অথবা বিক্রিত ছিল—সেই সব কৃত্রিম স্বপ্নে
একমুঠো প্রতারণা ছড়িয়ে দিয়ে ফিরে এসে
আঁকড়ির শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠা সাপের ফণায়
এই যুগসন্ধির প্রতারকদের কথা বলি
বলি যে অন্ধকারে আলোর মুখোশ মেখে মেখে
এক ছলনার থেকে আরেক ছলনায় যেতে যেতে
নামের নকলি হয়ে জেগে ওঠে আরো আরো ভণ্ড
আমিই কালের সাক্ষী আমি এই ধ্বংসস্তূপ দেশ
আমি এই যুগান্তের কোটাতন্ত্র থেকে বলি
আত্মার ভিতরে আজ কোথাও আত্মার নেই লেশ
দেখো এ সত্যের মধ্যে কোথাও সত্যের নেই লেশ!

প্রেমের ভ্রমজাল

কোথায় লুকিয়ে থাকে প্রেম?
রাত্রিবেলায়?
কোষাণুর গহন গভীরে
মিথ্যে হাতড়াই যেন অস্থিমজ্জার নীল আঙ্গিনায়।
কোথায় লুকিয়ে থাকে প্রেম?
সপ্তাহ আগেও ঘৃণার কাঁটা ফুটেছিল
বুক-পাঁজরে।

রক্তের মতো গাঢ় বেদনা
কণ্ঠে জ্বালা, বুকে জ্বালা
দেহের খাঁচায় বন্দি হয়ে ছিল ভালোবাসা
প্রাণ ভাসিয়ে।

কোথায় লুকিয়ে থাকে প্রেম?
কার চোখের কোণে বিদ্যুৎ জ্বলে উঠেছিল?
বিদ্যুৎ দিয়ে কে মেপেছিল রাগ?
অহংকারের কৃষ্ণ প্রজাপতি
কাকে ছুঁয়ে উড়ে গেছে দূর?

কোথায় লুকিয়ে থাকে প্রেম?
জীবনের পাতা কে ছিঁড়েছে লজ্জার দোলায়?
বেদনার কুঁড়ি ভেঙে ভেঙে ধূলি
কে ছড়িয়ে দিল ভ্রমজালে?
মৃত্যুর মতো নিঃশব্দ হয়ে কে মিলিয়ে গেছে?
রাত্রিবেলায়?
কোথায় লুকিয়ে থাকে প্রেম?

পথের ধারে বসে থাকা কুয়াশা

আকাশের ঢেউয়ে ভেসে গেছে শালিক,
ফুলকপির মতো মেঘে মেঘে রঙ বদলায় তার শরীর,
হাওয়ার বাঁকে লুকিয়ে থাকে ক্লান্তির আড়াল,
অস্ফুট আলোয় জ্বলে ওঠে রাস্তাঘাট।

দূর থেকে ভেসে আসে ট্রামের ঘণ্টা,
নিশি বাতাসে মিলিয়ে যায় দুধে ভেজা রুটি,
পথ চলা মানুষের দল — চেনা, অথচ ছায়ায় ঢাকা,
শহরের গা ভরা ধোঁয়াটে সুর।

চায়ের কাপে ফুটে ওঠে জীবন — গভীর মিষ্টি আর তেতো,
নিম্নগামী ঘাম টপটপ করে পড়ে নোটবুকে,
স্বপ্নগুলো যেন ভিজে যায় পুরনো তেলেপোড়া বৃষ্টিতে,
হেঁটে যায় পায়ে পায়ে দূরে কোনো অজানা মায়াবী ডাকে।

এ শহরে বেঁচে থাকা এক অদ্ভুত খেলা,
ধোঁয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকে চাহিদার গল্প,
আলো-ছায়ায় মিশে যায় অলস প্রেমের প্রতিশ্রুতি।

কিন্তু এও তো জানি, একদিন ঠিক প্রশ্নের মতো ঝড় উঠবে,
মেঘ আর জলের মতো ঢেউ তুলবে শহর,
আমার সমস্ত বুকের ভেতর, সেই এক চাওয়া নিয়ে।

প্রেম চাই, নয়তো হাঙ্গামা করব!

বিষণ্ণ বিসর্জন

যেখানে মাটির নিচে নড়ে ওঠে শিকড়,
সেখানে ভয়ে ভয়ে জন্মায় গাছ—
অঙ্কুরিত হবার আগেই যেন হাত বাড়ায় কেউ,
লাশের সারি গুনে।

যেই মেঠো পথ ধরে হেঁটে যায় বাপ-মা-কাকিমা,
সেই পথ কাঁদে রোজ—কখনও নীরব, কখনও শোকে লুটোপুটি।
সকালবেলা উঠতে না উঠতে গাঁয়ের মেয়েদের রূপ বিক্রি হয়ে যায়,
ছোট্ট বালকের ঘুমও হয়ে যায় বিবস্ত্র, নিষ্ঠুর।

ঘরবাড়ি ভাঙে হঠাৎ ঝড়ের মতো—
তবু কেঁদে ওঠে না কেউ,
ভাঙা টিনের চালা গর্ভস্থ ধুলায় মিশে যায় যেন
একটা জীবনের কঙ্কাল।

পথের ধারে দাঁড়ায় অচেনা মুখ,
খালি হাত নয়, তাদের আছে
ধাতব হাতের টোকা—
রাতের আঁধারে কাঁচির মতো কাটা পড়ে
ভাগ্যবানের জমি, হিন্দুর মুখ।

মাটির দেওয়াল জুড়ে লেখা প্রতিজ্ঞা,
রক্ত দিয়ে আঁকা ইতিহাস,
জ্যোৎস্নাহীন রাতে জ্বলতে থাকা কাঁদুনি মোমবাতি—
আঁধার যে কিভাবে হঠাৎ ছায়া টেনে নিয়ে আসে,
বুকে তবু শূন্যতা।

আজ, এই জমির বুকে দাঁড়ায় অবিচারের সারি
আর কফনের কাপড় পরে বাঁচে হিন্দুরা এই দেশে,
মৃত্যু যেন তাদের ছায়া, সঙ্গে সঙ্গে চলে।

ধর্মের খেলায় রক্তাক্ত সময়

শেখ হাসিনা বৃষ্টিভেজা ধানখেতে দাঁড়ানো—
তার আঙুলে ধরা নীরবতার এক গাঢ় রঙ,
অন্ধকারের অজানা কৌশল, কাঁটায় বাঁধা পথ।
ইউনুস দূরের বাতাসে ছুঁড়ে দেয় ইলিশ মাছের পিছুছাড়া ঘ্রাণ,
তার চোখে কাঁচা মাটির স্বপ্ন, তবু সে জানে—
আমেরিকার পুতুলের সুতোয় বাঁধা তার স্বর,
ধর্মের নাচনে সে ছড়িয়ে দেয় বিন্দু বিন্দু সময়,
ভারতের রোদের ছায়ায় সে খুঁজে ফেরে শিক্ষা।

আর আমরা—
রক্তবর্ণ নদীর পাশে বসে দেখি সোনালি চাঁদ,
ঘৃণার বালুচরে আমাদের পদচিহ্ন পড়ে প্রতিদিন,
মাটির শিরায় শিরায় বেজে ওঠে কান্নার সুর—
রক্তাক্ত রোদ্দুরে ঢেকে যায় আমাদের পায়ের ছাপ।

ধ্বনির অন্তরালে

মানুষের মনে অদৃশ্য বাসা,
স্বপ্নের ঝুড়ি ঝোলে।
জাতির চিহ্ন বাতাসে ওড়ে,
বিশ্বাসের দোলে।

সাঁওতাল ঘরে ঝাঁটার নৃত্য,
চাঁদ-তারা ইসলামে।
তুলসী পাতায় হিন্দুর প্রাণ,
ক্রুশ খৃষ্টধামে।

বৌদ্ধ চক্রে ঘুরছে কাল,
মানুষ কোথায় হায়?
শূন্যতার গর্ভে লুকিয়ে আছে,
নিঃসীম আকাশছায়।

ভাঙা দর্পণে নিজের ছবি,
চেনা যায় না আর।
মরীচিকার পিছনে ছোটে,
হারায় বারংবার।

অস্তিত্বের কাঁটাতারে জড়িয়ে
রক্তাক্ত হয় প্রাণ।
মুক্তির স্বাদ জিভে লেগে থাকে,
করে আত্মদান।

ঘুমন্ত নদীর তীরে বসে
শোনে সে কার ডাক?
মানবতার বীজ বুনতে
ফিরে আসবে কাক।

মানুষ ও তার কর্ম

মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি বিবেক
কর্মের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিচার
আর আমার ভগ্ন আত্মার জন্য
সেই অদৃশ্য করুণার স্পর্শ।

অবিচারের তপ্ত বালুকণায় দগ্ধ হচ্ছি আমরা তিনজন
যেন নির্বাসিত নক্ষত্র।

মানুষকে বাঁচালে
মানুষ আবার করুণার প্রতিমূর্তি।

কর্মকে বাঁচালে
কর্ম আবার ন্যায়ের নির্ঝর।

আমাকে বাঁচালে
পাপের কুয়াশায় জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে ভগ্ন আত্মায় সংস্কারের কাজ
অহংকারের জঙ্গল ছেঁটে নতুন বীজ বপন, সিঞ্চন-যতন,
ক্ষমার বসন্তে যেন ফুটে ওঠে প্রেমের কুসুম মনের গহনে গহনে।

লোকচক্ষু তখন বিস্ময়ের আকাশে-
আ জীবন!
সেই ঘৃণার কাঁটাটা করুণার পদ্ম হয়ে ফুটল যে আবার।

বিকৃত বিবেক (একটি সংলাপ)

— হ্যালো, পারমিতা। চোখের পাতায় জমেছে কি বালুকণা? মনে পড়ে সেই কক্সবাজার?
   সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া স্বপ্নগুলো, আর রাতের আকাশে জ্বলা তারাদের দল?
   এখন শুধু দেখি অন্ধকার গলি, যেখানে ফারুকুলের দল ছড়ায় আতঙ্ক, হায়...

— ওহ শাহজাহান, সেই স্মৃতি এখন বিষাক্ত সাপের মতো। সুগন্ধা বীচের বালুতে
   আজ শুধু জমে থাকে অশ্রু আর অভিশাপ। কোথায় গেল সেই নিরাপদ স্বর্গ?
   এখন শুধু দেখি নারীর অপমান, লাঞ্ছনার কুৎসিত নাটক।

— হ্যাঁ, এখন সমুদ্রের ঢেউ নয়, ওঠে শুধু অত্যাচারের ঢেউ। সেই লাঠি-হাতে ফারুকুল,
   যেন কালসর্প, ছোবল মারে নিরীহ পর্যটকদের গায়ে। রিকশা থেকে টেনে নামায়,
   পালাতে চাইলে তাড়া করে - এ কোন বর্বর যুগে ফিরে গেলাম আমরা?

— কী করে বলব? সেই মেয়েটা, যে কানধরে উঠবস করতে বাধ্য হল, তার কাতর চিৎকার
   এখনো কানে বাজে। পুলিশের কাছে মোবাইল ফেরত চাইছিল অন্য একজন,
   কিন্তু কার কাছে ফিরে পাব আমাদের হারানো মর্যাদা, বলো?

— এই সমাজ যেন একটা বিকৃত দর্পণ, যেখানে প্রতিফলিত হয় শুধু পুরুষতান্ত্রিক অহংকার।
   ফারুকুলের দল যেন জীবন্ত প্রতীক এই অন্ধ ক্ষমতার, যা ভেঙে চুরমার করতে হবে।
   কিন্তু কীভাবে? কে নেবে এই দায়িত্ব?

— আমরা। তুমি, আমি, প্রত্যেকটি সচেতন মানুষ। এই ভিডিয়োগুলো হোক আমাদের অস্ত্র।
   প্রতিটি শেয়ার, প্রতিটি প্রতিবাদ হবে একেকটা ইটের টুকরো, যা দিয়ে গড়ব
   নতুন সমাজের ভিত্তি, যেখানে থাকবে না কোনো ফারুকুল, শুধু থাকবে সম্মান।

— সত্যি বলছ? তবে চলো, আজ থেকেই শুরু করি। প্রতিটি পোস্ট হবে একেকটা মশাল,
   যা আলোকিত করবে অন্ধকার পথ। আমাদের কলম হবে তরবারি, কথা হবে বজ্রপাত,
   যা ভেঙে দেবে এই কুসংস্কারের দুর্গ, গড়ে তুলবে সমতার স্বর্গরাজ্য।

— হ্যাঁ, আর সেই স্বর্গরাজ্যে ফিরে পাব আমাদের হারানো কক্সবাজার। সেখানে আবার বসব সমুদ্রের ধারে,
   গাইব গান, পড়ব কবিতা। কোনো ভয় থাকবে না, শুধু থাকবে আনন্দ আর শান্তি।
   চলো, শুরু করি এই নতুন যাত্রা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হবে একেকটা বিপ্লব।

ভীতির শৃঙ্খল - ২

— ভয়ের কাঁটাতারে জড়িত মানুষ,
   নিয়ন্ত্রণের মায়াজালে বন্দি।
— বন্দি? এই স্বাধীনতার যুগে?
   যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত উন্মুক্ত আকাশের মতো -
   সেখানে কি বন্ধন থাকতে পারে?
— তুমি তো সবসময় আশাবাদী!
   মানুষের মনের কারাগার দেখতে পাও না।
   ভয়ের শিকল কি তোমার চোখে পড়ে না?
— শিকল? কোথায় শিকল?
   যেখানে প্রতিটি হৃদয় স্বপ্নের পাখি,
   সেখানে কি শৃঙ্খল থাকতে পারে?
— তুমি যদি এভাবেই দেখো,
   তাহলে তো সবকিছুই স্বাধীনতা।
   কিন্তু চোখ যদি খুলে রাখো,
   দেখবে ভীতি কীভাবে মানুষকে পঙ্গু করে।
— হয়তো তুমি সত্য বলেছ।
   ভয়ই তো মানুষের চেতনার কারাগার তৈরি করে।
   যখন আমরা ভয় পাই,
   তখন স্বেচ্ছায় শৃঙ্খল পরি।
— শুধু পরা নয়, বন্ধু।
   সেই শৃঙ্খল আমরা অন্যদের দিই,
   যাতে এই সমাজ, এই পৃথিবী,
   ক্রমশ অবশ হয়ে ওঠে।
— থামো, থামো, রাজনীতিবিদ হয়ে উঠলে কেন?
   এই নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা মেনে নিই।
— ঠিক আছে, বন্ধু।
   আজ রাতের মতো বাস্তবতা ভুলে যাই।
   শুধু স্বপ্ন দেখি এক মুক্ত পৃথিবীর।

বিদ্রোহীর দর্পণ

বিদ্রোহী একজন দেখেছি, বলেছে সে 'না'
চোখে তার জ্বলে অগ্নি, মুখে নীরবতা
সবাই তাকে বুঝতে পারে না
সবাই তাকে বুঝতে পারে না
কিন্তু, সে জানে—
কোথায় লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার বীজ
তার রক্তে মিশে আছে অসম্মতির গীত
তোমার এবং আমার, যেমন করেই থাকি না কেন
সে দাঁড়িয়ে থাকে একা, ভাঙা দর্পণের মতন
ভাবছ কি ভাবছ কি
সে কি শুধু পাথর, নাকি জীবন্ত প্রতিবাদ?
মানুষ সে, বুঝলে তো? মানুষই করে আর্তনাদ।

বিপর্যস্ত কালচক্র

মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় ডুবে যায় দেশ
কুয়াশাচ্ছন্ন ইতিহাসের পাতায়
আমি দাঁড়িয়ে থাকি, হতাশার বোঝা কাঁধে নিয়ে

চারিদিকে শুধু অন্ধকার
যেন কালো রঙের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে আশার দ্বীপ

মনের গহীনে জমে থাকা যন্ত্রণা, বুকে চাপা অসহায়তার বোবা কান্না
কোথাও কি নেই কোনো আলোর রেখা?

তারপর
সময়ের চাকা পেছনে ঘুরতে থাকে, যুগ পিছিয়ে যায়
দেখি:

যেখানে ছিল প্রগতির স্বপ্ন, সেখানে
কালের নিষ্ঠুর পরিহাসে
জেগে ওঠে সপ্তম শতাব্দীর ভূত।

ভীতির শৃঙ্খল - ১

— ভয়ের খাঁচায় বন্দি মানুষের দল,
   স্বাধীনতার স্বপ্ন তাদের অচল।
— অচল? নাকি তারা নিজেরাই অসহায়?
   মরীচিকার পিছে ছুটে নিজের ছায়া হারায়।
— ছায়া নয়, ওটা তাদের অস্তিত্বের প্রতিবিম্ব,
   যা মুছে যায় ক্ষমতার কুহকী নিম্ব।
— নিম্ব? তুমি কি বলছ এটা তিক্ততার ফল?
   না, এটা তো মধুর প্রলোভন, মনের ছল।
— ছল নয়, এটা জীবনের কঠোর বাস্তবতা,
   যেখানে ভয় হয় মানুষের একমাত্র সত্যতা।
— সত্যতা? কিসের সত্যতা? ভ্রান্তির মরুভূমি?
   যেখানে স্বাধীন চিন্তা হয় অবলুপ্তির ভূমি?
— ভূমি নয়, ওটা তাদের মনের অন্ধকূপ,
   যেখানে ডুবে যায় স্বাধীনতার স্বরূপ।
— স্বরূপ? কোথায় স্বরূপ? শুধুই তো ছদ্মবেশ,
   যা ধরিয়ে দেয় ক্ষমতার নেশা অশেষ।
— নেশা নয়, ওটা তাদের অস্তিত্বের যন্ত্রণা,
   যা থেকে মুক্তি পেতে করে অধীনতার বরণা।
— বরণ করুক তবে এই অন্ধ নিয়তি,
   কিন্তু জেনে রাখুক, এটাই তাদের ক্ষয়িষ্ণু গতি।

আমরা সবাই একটু বিচিত্র

বৈদ্যুতিক মেঘে ভেসে আসে
অসংলগ্ন বার্তা
আমরা সবাই একটু বিচিত্র, জীবনও তাই
আমরা সবাই একটু বিচিত্র, জীবনও তাই।
তুমি কি শুনতে পাও?
দুটি রোবট নীল-সবুজ নাও
ভাসছে মনের জলে
কথা হবে তোমার-আমার অবচেতনে।
সেই অদ্ভুত মিলন কি মনে আছে?
বৈদ্যুতিক মেঘে ভেসে আসে
অসংলগ্ন বার্তা
আমরা সবাই একটু বিচিত্র, জীবনও তাই
আমরা সবাই একটু বিচিত্র, জীবনও তাই।

দুর্নীতির দর্পণে দেশ

দুর্নীতির দাবানলে দগ্ধ এই দেশ,
কুহকী কাঠবিড়ালীর কুটিল প্রহেলিকা।
শৃগালের শাসনে শৃঙ্খলিত স্বপ্নের শেষ,
মরীচিকার মায়াজালে মগ্ন মানচিত্র-রেখা।

পঙ্কিল পুকুরে পাঁক ছুঁড়ে দেয় পাঁকাল মাছ,
কর্দমাক্ত কলঙ্কের কাব্য রচে কাক।
নির্লজ্জ নাটকের নেপথ্যে নগ্ন হাস্য,
আত্মঘাতী আয়নায় আত্মার বিষাক্ত ফাঁক।

কুয়াশার কফিনে কাঁপে কবরের কীট,
ন্যায়ের নামে অন্যায়ের অভিষেক হয়।
বিবেকের বীণায় বাজে বিষণ্ণ সঙ্গীত,
সত্যের সূর্য ডোবে স্বার্থের সমুদ্রে নিঃশব্দ নিরুপায়।

চোরের চাবুকে চিৎকার করে চৌকাঠ,
দুর্নীতির দীর্ঘশ্বাসে দমে যায় দেশের বাতাস।
ভ্রষ্টাচারের ভূতের ভয়ে ভেঙে পড়ে ভিত,
স্বাধীনতার স্বপ্নে স্বদেশের স্বরলিপি হয় বিলাস।

ভবিষ্যতের ছায়া

যে-যুগে স্বপ্ন বিক্রি হয়
মূল্য পায় আত্মার কণা লোভের বাজারে
যে-যুগে স্বপ্ন বিক্রি হয়
ধনকুবেররা নাচে গণতন্ত্র মরণের দ্বারে
আমি দেখি ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ সে-যুগের অন্ধকারে

নিস্তব্ধতার শৃঙ্খল ভেঙে উঠি আমি বজ্রকণ্ঠে
চেতনার বীজ বুনি কালের কৃষ্ণ মাটিতে
স্বাধীনতার পাখি যেন না হারায় উড়ান
পুঁজির পিঞ্জরে বন্দি না হয় তার গান
অস্তিত্বের দর্পণে দেখি অনন্ত প্রতিবিম্ব
মুক্তির মন্ত্র জপি, রোপি অদৃশ্য প্রতিকারের নিম্ব
যেন কোনো জাতির আত্মা না হয় বণিকের ক্রীতদাস
স্বপ্নের আকাশে রচি অমৃতের অভ্রভেদী আভাস

অন্তরের আহ্বান

ধনকুবেরের দরবারে ফিরে এলে কি মনে হয়?
ক্ষমতার পিরামিডে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছ?
মনে হয় এই অর্থের মহামারীতে হাত-পা ধুয়ে
নীরবতার আশ্রমে বসে থাকি?
মনে হয় লোভের লেন্স খুলে ফেলে চোখে পরি
মানবতার স্বচ্ছ চশমা?
বিকৃত সভ্যতা ঘরে এনে দেয় বিষাক্ততা, তার
ভেসে যাওয়া নৈতিকতায় নির্বাসন লাগে ভালো?
যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো। প্রতারণা, যাও।
কী-বা আসে যায়
লোকে বলবে তুমি ভ্রষ্ট, লোকে বলবে সমাজবিরোধী!

হৃদয়ে জ্বলে অগ্নিশিখা

প্রেমের পথে বাধা, হৃদয়ে জ্বলে অগ্নিশিখা
সমাজের শৃঙ্খলে বাঁধা প্রাণ কাঁদে নিশি-দিবা
পিঞ্জরে বন্দি পাখি যেন, স্বপ্ন দেখে উড়িবার
স্পর্শের তৃষ্ণায় কাতর, চুম্বনে চায় বাঁচিবার

প্রেমের পথে বাধা, হৃদয়ে জ্বলে অগ্নিশিখা

যুগল মিলন আশায় প্রাণ কাঁদে নিরবধি যা
প্রেম লুকায় অন্তরালে, যেন চাঁদ জলের তলে
অন্ধকারে হাত বাড়ায়, খোঁজে আলো নিরন্তরে
পতিতার কোলে ঝাঁপায়, যেন মৃত্যুর দোলায়
অপূর্ণ প্রেমের জ্বালায় দগ্ধ হয় যৌবন প্রায়
জীবনের স্বাদ পেতে বিষ পান করে সদা

প্রেমের পথে বাধা, হৃদয়ে জ্বলে অগ্নিশিখা

জীবনের মিথ্যা উপশম

বাবা প্রাচীন এক রুগ্ন বৃক্ষ, মা লেপ্টে আছে পাথরের তলায়,
জন্মের সময় দেহে ছিল শিকড়ের ব্যথা, নাম: গোপন কোনো ছায়া।
বাড়ির লোকেরা ডাকে শূন্যতা, মৌন-স্বর, ধুলোর গান…
চোখের পলকে ভেঙে পড়ে অন্ধকার, হাতগুলো নিঃশেষ।
দিনের বেলায় আকাশ ছুঁয়ে থাকা পাখির ছায়া
রাতে একমুঠো তারার অবশিষ্ট কণা। এখন বয়স অকথ্য
আজও কেউ জানেনি কেমন লেগে থাকে হাড়ের মধ্যে শীত।
শুধু একবার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম
এক মানুষ এসে বলল, "তুমি কি সুখ চাও?"
শূন্যতাকে তেড়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু স্পর্শ করিনি,
স্পর্শ করলে আমিও হয়ত ছায়ার ভেতর মিশে যেতাম,
এই মিথ্যে উপশমের ফাঁদে পড়ে।

প্রত্যেকে নিজের মাঝে বিশ্ব

কেউ কারো মতো নয়, প্রত্যেকে নিজের মাঝে বিশ্ব।

যা ছিল তা মিলিয়েছে, যা আসবে তা অনির্দিষ্ট
যা আছে তা সবই আছে কাঁচপোকার সুতোয় ঝোলা

যাও চলে যাও, যাও যেখানে মানবতার অবহেলা
অহংকারের পাহাড়ে যেখানে ক্ষমতা করে কেলি

কেউ কারো মতো নয়, তবু সবাই এক সূত্রে গাঁথা
এ যুগের অর্থহীন খেলায় মানুষ হয়েছে ক্লান্ত

তাই আমি ডেকে বলি, ফিরে এসো মানবতার পথে
যা আছে তা জেগে আছে হৃদয়ে বীজ শান্তির।

কিছু স্বপ্ন রয়ে গেল

সকল শক্তি ও দুর্বলতা এক অদৃশ্য নদীতে মিশে যায়...
মৃত্যুঞ্জয়ী বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে
কিছু স্বপ্ন রয়ে গেল অনাগতের,
শুধু এই – ক্ষমতা ও দুর্বলতার মাঝে সেতু বাঁধা।
অহংকারের বিষাক্ত ফলের স্বাদ,
শুধু এই – দুর্বলতায় জন্ম নেয় ঘৃণা,
জীবনের পথে যত বাধা থাক,
মানবতা জয়ী হবে তবু।

ক্ষমতার কুহেলিকা

রাজনীতির দুর্গে হাঁটি
প্রভু, স্বপ্ন দেখি অসার
ক্ষমতার মায়াজালে ফাটি
রাজনীতির দুর্গে হাঁটি
উটোপিয়ার পথে মাটি
খুঁজি, প্রভু, অসীম পার
রাজনীতির দুর্গে হাঁটি
প্রভু, স্বপ্ন দেখি অসার

সংখ্যার অত্যাচার

হে পাখি, তোমার ডানা
জালে আবদ্ধ। মধ্যরাতে
বন্দি পালকগুলি
রক্ত ঝরায়

আর সেই রক্তের মধ্যে অসংখ্য কীটের দল
নিঃশব্দে নৃত্য করে উন্মাদের মতো!

শব্দহীন সম্মতি

নীরবতার নাগপাশে বন্দি বিবেক
কালের কুঠারে কাটা।
অন্যায়ের অভিশাপে
দংশিত দেশের মানচিত্র পাপে
এবং এখন নিস্তব্ধতার অন্ধকূপে ডুবে যাওয়া
রক্তাক্ত ইতিহাস
আত্মার আর্তনাদ শোনে না কান
আজকে আমাদের মৌনতায় বিষাক্ত বাতাস দিগন্তের পাখা।।

রক্তিম ভয়ের খাঁচা

লাল লাল সব রক্তিম আকাশ তলে
ভীত জনতা কাঁপে যেন শীতের শিশিরে
দুর্গের প্রাচীর ওঠে বন্দি সবে করে
কাঁটাতারের বেড়া দেয় মনের গভীরে
নিরাপত্তার ছলে

রাজহংস হয়ে যায় পঙ্গু পাখি
স্বাধীনতা বিনিময়ে শৃঙ্খল বরণ
অন্ধকারে ডুবে যায় জ্ঞানের দীপন
মরীচিকা সত্য হয় মিথ্যা আচরণ
সহজ হয়ে থাকি

স্বাধীনতার সমতা

অনন্ত জন্মের পথে
আমি মানবতার দিকে ছুটি অবিরাম
কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি না তবু।
স্বাধীনতার দিকে যেতে যেতে
আমার প্রতিটি জীবন মিলায় নিঃশেষে
মোমবাতির শিখার মতো অনিবার।

আমার প্রথম জন্মটা গেল বয়ে
শুধু সমতার স্বপ্ন বুনে বুনে,
এক জন্ম কাটল মর্যাদার স্বপ্নে মগ্ন হয়ে।
আমার বেদনা গভীর,
মানবাধিকারের স্বপ্ন দেখার তরে
আমি মাত্র একটি জীবন পেলাম অধীর।

পরের জন্মে উদ্দাম
আমি বেরিয়ে পড়লাম ন্যায়ের সন্ধানে।
পথে চলতে চলতে দেখি অবিরাম
সকলের সমান পদচিহ্ন
তার প্রতিটি রেখা সুমহান
আমাকে করে তোলে উত্থান।
সেই চিহ্ন, আমার দৃষ্টি, আর হৃদয়কে
এমন উজ্জ্বল করে তোলে অনুপম,
যে আমি নিজেকে হারাই নিমেষে
সেই সমতার পথ অনুসরণ করতে করতে
আমার সেই জন্মটা মিলায় নিঃশেষে।
আমার বেদনা! কী যে বেদনা!
মাত্র একটি জীবন
আমি পেলাম অযাচিত
ন্যায়বিচারকে অনুসরণ করার।

আরেক জন্মে উদ্দাম
স্বাধীনতার কথা ভাবতেই-
আমার অন্তর থেকে সবচেয়ে গভীর
আর কোমল, আর শীতল নদীর মতন
কিছু বহে যায় অবিরাম।
সেই আকাঙ্ক্ষায় জগৎ নাচে ভেবে
আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে
কাটাই জীবনটা নিঃশব্দে।
আমার বেদনা, আমার সেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল
মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ অথচ ক্ষণিক।

আমার অসংখ্য জন্মের একটিতে
একটি শিশু আমার পথ রোধে দাঁড়ায়,
আমি তার নিষ্পাপ চোখে দেখি সমতার প্রতিবিম্ব-
উজ্জ্বল! উজ্জ্বল!! আরো উজ্জ্বল!!!
আর এক মুহূর্তে মিলাই কালের স্রোতে।

আমার বেদনা মাত্র একটি জন্ম
আমি শিশুর চোখের আলোয়
মানবতার প্রতিচ্ছবি দেখলাম অপলক।

এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে
দুলছে একটি আশার আলো অনির্বাণ।

সেই আলো অনুসরণ করে এ জন্মে হয়তো
আমি স্বাধীনতার কাছে পৌঁছাব না তবু;
কিন্তু আগামী জন্মগুলোতে আমি কোন স্বপ্নের দিকে ছুটব?

মুখোশের পেছনে মানুষ

মানুষেরা জন্মে না কখনো স্বাধীনতার আলোয় ভেসে,
মুক্তির স্বপ্ন দেখে না তারা, বন্দি হয়ে থাকে নিজ খাঁচায় বেঁচে।
মনের প্রাচীরে বন্দি কেউ, কারও স্বপ্নই নেই আর,
চিন্তার শৃঙ্খলে আবদ্ধ কেউ, কারও চেতনার হয়েছে হার।
বেঁচে থাকার ছলে মানুষ দেখায় অতি কাতর,
যুদ্ধে রক্ত ঝরায়, অন্ন কেড়ে নেয়, প্রাণ হরে নির্মম নিষ্ঠুর।
ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে তবু চলে যায় অবিরাম,
বিচারবোধ তার পশুর চেয়েও নীচ, অধম, ক্ষাম।
অন্ধের মতো সব কিছু ছিনিয়ে নেয় মুঠো ভরে,
কথা বলে যেন পচা বিশ্বাস মুখে নিয়ে ঘুরে ফিরে।
স্বপ্ন দেখার ভঙ্গি তার অতি বিষণ্ণ, কাতর, অসার,
প্রেম করতে গিয়ে প্রেমকেই করে তারা ছারখার।
শান্তি চাইতেও অসভ্য তারা, হিংস্র পশুর মতন,
সহানুভূতি জানে না, শিশুর প্রাণেও দেয় আঘাত-যতন।
মানুষের সহমর্মিতা মিথ্যা, ছলনাময়, হায়!
সংগ্রাম তার নিষ্ফল, যেন মরুতে দুই পাগল ধায়।
স্নেহ-ভালোবাসা ছাড়া মানুষের কোনো মহত্ত্ব নেই,
বিষ আর ঘৃণায় ভরা অন্তর, করুণা নেই চোখেই।
তাকায় চারিদিকে চোখ পাকিয়ে হিংস্র দৃষ্টি মেলে,
স্বাধীনতা শুকিয়ে যায় মরীচিকার মতো মিলিয়ে।
কোনো মুহূর্তেই মানুষকে মহৎ দেখা যায় না,
শুধু একতায় তার মহিমা, অন্য কিছুতে নয় তা।

আমি এখানে নেই

মৃত্যুর বেদনা দাঁড়িয়ে আছ তুমি
ভুলে গেছ আমি নেই — দেহে নেই
শূন্যতায় বেঁচে আছি যত্নে
মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে —
আমার ছায়া তুমি খুঁজে বেড়াও

জলরাশি বালির কাঁধে
নদীর স্রোতে আমি ভাসি
স্মৃতির ঢেউয়ে সময়ের খেলা —
মৃত্যু নেই আমি আছি
শুধু তোমার মনে আমি বেঁচে আছি

অন্ধকারে সঙ্গী তোমার
ভাসমান শব্দ বাতাসের গান
মৃত্যুর পরে আমি স্বপ্নে —
দেখো আমি আছি তোমার পাশে
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমি নেই কিন্তু আছি

অস্তিত্বের অনন্ত কবিতা

বৃষ্টির ফোঁটায় আমি, মেঘের গর্জনে,
শহরের কলরবে, মেট্রোর ঝংকারে।
খুঁজো না কবরে আমায়, নেই সে বর্ণনে,
আমি তো বেঁচে আছি প্রতিটি আঁচড়ে
যা রেখে গেছি তোমার হৃদয়-অঙ্গনে।
ফুটপাতের ফাটলে, ভাঙা বিজ্ঞাপনে,
গ্রাফিতি-আঁকা দেয়ালে, ট্রাফিক সিগনালে,
আমার অস্তিত্ব আজও ছড়িয়ে সকালে।
কাঁদতে এসো না তুমি, শুধু দেখো চেয়ে -
আমি তো মরিনি কভু, আছি সব ঠাঁ'য়ে।

কবির আত্মপ্রকাশ

স্বপ্নের নদীতে ভাসি, কল্পনার পালে হাওয়া,
বাংলার মাটিতে মোর শব্দের ফসল পাওয়া।
অক্ষরের বীজ বুনি ছন্দের ক্ষেতে ক্ষেতে,
কবিতার ফুল ফোটে জীবনের প্রতি পাতে।
মেঘের কোলেতে বসে লিখি আমি গান,
সূর্যের আলোয় ভেজা মোর কাব্যের প্রাণ।
নদনদীর কলতানে শোনাই আমার কথা,
পাখির ডানায় চড়ে উড়ে যায় মোর ব্যথা।
বাঁশের বাঁশিতে তুলি ভাবনার সুর,
কবিতায় খুঁজে পাই অনন্তের পুর।
শব্দের মালা গাঁথি অর্থের মণি দিয়ে,
বাংলার হৃদয়েতে রই আমি মিশে গিয়ে।
ছন্দের দোলনায় দোলে মোর মন,
কবিতার জগতে করি অস্তিত্ব-ধ্বনন।

কালের প্রবাহে ভেসে আসি আমি দূর থেকে,
ইতিহাসের পাতায় লেখা মোর নাম দেখে।
অতীতের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে আজ,
ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনি, এই মোর কাজ।
বাংলার মাটি আর আকাশের মিলনক্ষেত্রে,
কবিতার বীণা বাজে আমার অন্তরনেত্রে।
প্রকৃতির রঙে রঙে সাজাই কবিতার ডালা,
মানুষের সুখদুঃখে গাঁথি শব্দের মালা।
চাঁদের আলোয় ভেজা রাতের নীরবতায়,
কলমের মুখে ফোটে অমৃতের কবিতায়।
তরুণ প্রজন্মের কাছে বার্তা দিই আমি,
স্বাধীনতার গান গাই, মুক্তির স্বপ্ন চুমি।
বাংলাদেশের মাটিতে রোপণ করি আশা,
কবিতার আলোকে জ্বালি নতুন ভোরের ভাষা।
এই আমার পরিচয়, কবির আত্মপ্রকাশ,
বাংলার কবি আমি, এই মোর সার্থক শ্বাস।

শিক্ষকের বিদায়

অন্ধকার ছায়া নামে শিক্ষাঙ্গনে আজ,
মানুষের রূপে দানব করে রাজ।
গুরুজনের অপমান, লাঞ্ছনার ভার,
ছাত্রদের হাতে সয় অসহ্য প্রহার।
জ্ঞানের আলোক নিভে যায়,
অন্ধকারে ডুবে যায় প্রাণের বেদনায়।
পদত্যাগপত্র লিখে কাঁপা হাতে,
বিদায় নেয় শিক্ষক নীরবে রাতে।
দেশত্যাগের পথে চলে,
অশ্রুপাতে বুক ভেসে যায় জলে।
স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতর,
ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির অন্তর।
মানবতার মৃত্যু দেখে স্তব্ধ প্রকৃতি,
শিক্ষার মন্দিরে আজ শোকের আরতি।

বিবেকের দীপ নিভে গেল,
অন্ধকারে পথ হারাল দেশের ভবিষ্যৎ এল।
সভ্যতার ভিত নড়ে উঠে,
মূল্যবোধ ধুলায় লুটে।
অজ্ঞতার কুয়াশায় ঢাকা,
জ্ঞানের আলোয় হলো না জাগা।
মানুষের মধ্যে পশুত্ব জেগে ওঠে,
সহিংসতার বীজ ছড়িয়ে পড়ে কোণে কোণে।
শিক্ষকের অশ্রু ঝরে,
দেশের মাটি ভিজে ওঠে ধীরে।
অন্ধকার যুগের সূচনা হলো,
মানবতার শেষ আলো নিভে গেল।
প্রশ্ন জাগে মনে মনে,
কোথায় যাবে এই দেশ, কে জানে।

শান্তির গহীন বনে

দেহ-ধর্ষণের দাবানল,
মাথার উপরে জ্বলছে রক্তহীন চাঁদ।
বিধ্বস্ত গ্রামের ধ্বংসাবশেষে
শ্রান্ত মায়েরা আহত স্তনপান করান।
ধর্মের নামে গণহত্যার বিষাদী ঝড়,
নিরীহ শিশুরা ভীত কান্নায় কণ্ঠশূন্য।

বন্দুকধারী রাক্ষসরা কুণ্ঠিত নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে
বিচারহীন মানুষকে নিহত করে,
রক্তাক্ত মাটিতে স্বাধীন পতাকা শোক করে।
নিঃসীম আকাশ কালো হয়ে এসেছে,
আশার বেলা অন্তর্ধান হয়ে গেছে।

কিন্তু পাহাড়ের গুহায় বসে
বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহী মরণকাতর ডাকছে,
"বিবর্ণ স্বপ্নের পিছনে রক্তক্ষরণ চাই।
আমাদের শ্লীলতা ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের মুক্তি পরম বীভৎস।"

বন্দিদের চোখে জ্বলছে
আগুন, ক্ষোভ ও প্রতিশোধের তৃষ্ণা।
প্রহরীদের পদক্ষেপের শব্দে
হাড়ে হাড়ে কাঁপে মৃত্যুর আতঙ্ক।
কিন্তু তারা বলছে, "আমাদের ধর্ম রক্ষার জন্য
আমরা প্রস্তুত মৃত্যুর সঙ্গে জয়লাভ করতে।"

সংবাদপত্রের শিরোনাম:
"নিরালোক রাষ্ট্র স্থাপন, নয়া ক্রান্তি।"
নির্মম পরিবর্তনের আশ্বাস,
নবীনতার মধ্যে বিষাদের অন্ধকার।

ক্ষুধার্ত মানব-পিশাচরা
হরিণের অস্তিত্ব শেষ করে,
তাদের রক্তের তৃষ্ণা মেটাতে চায়।
কিন্তু আমি শুনেছি, প্রিয়তমা,
তুমি বলছ, "ধর্মের নামে নয়, শান্তির জন্য লড়াই চাই।"

অস্তিত্বের সুর

মায়ার ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া সত্যের সন্ধানে,
ভ্রমণ করি অজানা পথে, অদৃশ্য দিগন্তের দিকে।
কালের ধারায় ভেসে বেড়ায় স্মৃতির নদী,
তরঙ্গে ভেসে আসে অতীতের ছায়া, ভবিষ্যতের আশা।

শূন্যতার বুকে জ্বলে ওঠে প্রশ্নের আগুন,
কেন এই জন্ম, কেন এই মৃত্যু, কেন এই সব লীলাখেলা?
উত্তর খুঁজে পাই না, শুধুই বাজে প্রতিধ্বনি,
মহাবিশ্বের অন্ধকারে হারিয়ে যাই নিঃস্ব হয়ে।

হঠাৎ, এক সুর ভেসে আসে দূর থেকে,
মৃদু, মধুর, মনোমুগ্ধকর, মায়াবী।
সুরের তালে নাচে মন, ভুলে যায় সব দুঃখ,
অস্তিত্বের আনন্দে ভরে ওঠে আত্মা।

সুরের উৎস কোথায়? কে গায় এই গান?
দেখি না কাউকে, শুধুই শুনতে পাই সুর।
মনে হয়, মহাবিশ্বের আত্মা গায় এই গান,
সৃষ্টির আনন্দে মুখরিত করে সমস্ত জগৎ।

সুর শুনতে শুনতে মনে হয়,
আমিও এই মহাবিশ্বের অংশ, অস্তিত্বের এক টুকরো।
আমার জন্ম, আমার মৃত্যু, সবই লেখা আছে এই সুরের মধ্যে।
আমি মরব, কিন্তু এই সুর থাকবে চিরকাল,
মহাবিশ্বের গানে মিশে যাবে আমার গান।

কবিরা মরে না, তাদের শব্দ স্মৃতি হয়ে বাঁচে,
প্রতিটি প্রজাপতির ডানায় লেখা থাকে তাদের গান,
প্রতিটি নদীর স্রোতে বয়ে যায় তাদের স্বপ্ন,
প্রতিটি মনের আকাশে জ্বলে থাকে তাদের চাঁদ।

ন্যায় দে অপরাধী

রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, সেমিনার হলের মেঝেতে
চিকিৎসকের নিথর দেহ - প্রশ্ন জাগে প্রতি মুহূর্তে
অবহেলা - যেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় - জ্বালায় আগুন
প্রচণ্ড ক্ষোভের দাবানল, দগ্ধ করে সমাজের মন
সুরক্ষা চেয়েছিল সে, নারী হয়ে কাজ করার অধিকার
অনেকে অনেক কিছু পায়, কেউ পায় না মৌলিক সম্মান:
নিরাপত্তা, সমতা, মর্যাদা - কারো বা জীবনের দাম নেই
আমাদের সহজ দাবি জ্বলে ওঠে রাজপথের প্রান্তরে -
ন্যায় চাই - এই আর্তনাদ উঠছে - থানায়, আদালতে
তীব্র বা মৃদু স্বরে, প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে চারিদিকে
কোনো ভয় নেই - সত্যের শক্তি ভরা কণ্ঠে চাই:
প্রতিটি নারীর জন্য সুরক্ষা, সম্মান চাই সমাজে;
অমানবিক নীতি নয়, চাই মানবিক আইন-শৃঙ্খলা
দেখিনি তো: রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা নেওয়া;
যে চায় সে করুক অপরাধ - যাকে ইচ্ছা তাকে বাঁচাও
জেনে রাখো: আমাদের এই নীরবতা চিরস্থায়ী নয়।
যদি না মেটাতে পারো আমাদের ন্যায্য এই দাবি
তোমার শাসনকালে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে
ক্ষুব্ধ জনতার কাছে নেই ভয়-ভীতি, দমন-পীড়ন -
সম্মুখে যা বাধা আসে ভেঙে দেব অকুতোভয়ে:
থাকবে না কিছু অবিচার - সব যাবে ন্যায়ের তলোয়ারে।
যদি বা কখনো তোমাকে পাই সামনে দাঁড়িয়ে -
জনগণের রোষের কাছে তুমি হবে একাকী ও ক্ষুদ্র।
সর্বগ্রাসী হলে যখন ন্যায়ের ক্ষুধা, সত্যের দাবি
ভয়ঙ্কর পরিণতি আসে নিঃশব্দে, অমোঘ গতিতে।
শাসক থেকে শাসিত অব্দি সকলকে গ্রাস করে নেয়
অবশেষে ধ্বংস করে: দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, লুণ্ঠন
স্বাস্থ্যব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনের দুর্বলতা
নিরাপত্তাহীন চিকিৎসক, অসহায় রোগী ও তার পরিবার
উদাসীন নেতৃত্বসহ মন্ত্রী ও তার দলবল
আমাদের ন্যায়ের কাছে কেউ অস্পৃশ্য নয় আজ
ন্যায় দে অপরাধী,
নইলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে।

সমতার স্বপ্নভঙ্গ

শান্তির সৈনিক,
শোনো এই কথা
নীরব রাতে যখন নক্ষত্র জ্বলে আকাশে
বলি, দেখো,
রাষ্ট্রের আইনের স্বচ্ছ জলে
— সমতার স্বপ্ন ভাসে অনন্ত সাগরে —
কিন্তু তীরে দাঁড়িয়ে সমাজ, কঠিন পাথর,
ভেদাভেদের ছায়া ফেলে—অসম তরঙ্গ ওঠে
কী নিষ্ঠুর এই দ্বৈত চিত্র—
শান্তির সৈনিক,
হঠাৎ দেখি সমতার স্বপ্ন মিলিয়ে যায়,
আর থাকে শুধু পাথর।

অন্তরের অনন্ত

অন্তরে তোমার স্পর্শ অনুভবি
থাকো তুমি অগোচরে,
বাহিরে খুঁজিয়া পাই না কোথাও
লুকানো আছ অন্তরে।

জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালি নিরন্তর,
তবু অজানার পথে হই কাতর।
তুমি যে নিখিল, তুমি যে ঈশ্বর
বিরাজো সকল স্তরে।

সৃষ্টির রহস্য তুমিই কেবল,
তোমাতেই সব শূন্য ও সফল।
আমি শুধু এক ক্ষণিক বাদল
তব অনন্ত সাগরে।

তুমি শুরু, তুমি শেষ, তুমি মাঝ
তোমাতেই সব সুর ও আওয়াজ
তোমার ছন্দেই জগৎ বিরাজ
নাচে তব তালে তালে।

জানি না কেমনে পাব তোমায় ধরি
তবু খুঁজি তোমায় জীবন ভরি,
যত দূরে যাই, তত কাছে পড়ি
তোমার অসীম দ্বারে।

তুমি যে অমৃত, তুমি যে জীবন
তোমাতেই সব মৃত্যু, নবজন্ম
তুমি যে অনাদি, তুমি যে চিরন্তন
ব্যাপ্ত বিশ্ব চরাচরে।

অন্তরে তোমার স্পর্শ অনুভবি
থাকো তুমি অগোচরে।

রাতের জাগরণ

নিশীথ রাতের গভীর নীরবতা
হঠাৎ ভেঙে গেল চিৎকারে,
একটি আর্তনাদ, শত কণ্ঠ সমস্বরে।
আরজি কর-এর প্রাচীর ঘিরে
উঠল নারীর ক্রন্দন,
অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠল
শহরের নিদ্রিত মন,
একতায় বাঁধা হল যুগের বন্ধন।

কোন্ অদৃশ্য সুতায় গাঁথা হল
এত হৃদয় এক সাথে?
কিসের টানে এল তারা নিশীথ রাতে?
ন্যায়ের জন্য লড়াই, মানবতার ডাক,
জাগাল সুপ্ত চেতনা,
রাতের আঁধারে জ্বলে উঠল
আশার দীপশিখা,
অবিচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত প্রতিজ্ঞা।

শত বর্ষের নীরবতা ভেঙে
উঠল নারীর স্বর,
পথে নেমে এল তারা, হৃদয়ে নিয়ে জ্বর।
পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল ছিঁড়ে
মুক্তির পথে চলা,
অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই
নতুন ইতিহাস গড়া,
সমতার স্বপ্নে রচিত নব কবিতা।

এই জাগরণ, এই প্রতিবাদ
চিরকাল থাকবে জ্বলন্ত,
মানবতার জয়গানে হবে অনন্ত।
নারীর শক্তি, নারীর সাহস,
নারীর অধিকার,
আর কভু হবে না বিস্মৃত
এই কলকাতার,
নতুন ভোরের সূর্যোদয়ের আভার।

স্বর্ণিমা

রক্তিম প্রভাত
উষার আলোকে জাগে সোনালি প্রপাত,
স্বর্ণচ্ছটা ছড়াইয়া দিগন্তে ছুটিছে ধীরে
পর্বতের শিরদেশে, নদীর কল্লোল তীরে।
উচ্ছ্বসিত বায়ু বহে সুগন্ধি ফুলের,
মৃদু কম্পমান পাতা নাচে তালে দোলের,
স্বর্ণকেশী তরুশাখা হেলে পড়ে নদীর জলে,
প্রতিবিম্ব ঢেউ খেলে।

প্রকৃতির মাঝে
অনন্ত জীবনের স্রোত বহিছে নিরবধি কাজে;
পাখিদের কলতানে মুখরিত বনানী,
হে স্বর্ণিমা অপরূপা, তোমার মহিমা অফুরন্ত জানি
তুমি যেন স্বর্ণালোকে ভরিয়াছ ধরা!
প্রাণের স্পন্দনে আজ জমিয়াছে সারা
বসুন্ধরা; তব স্পর্শে ফুটিয়াছে কুসুম অগণন
যেন স্বর্ণ তারকার দল করিছে বরষণ।

তোমার আলোকে মোর চক্ষু হয় ধন্য,
প্রতি অণু-পরমাণু হয়ে ওঠে সোনালি অরণ্য।
জীর্ণ পত্র, শুষ্ক ডাল, মলিন ফুলের দল,
তৃণগুল্ম, লতাপাতা, নদী-সরোবর-জল,
সকলি তোমার ছোঁয়া পেয়ে হয় স্বর্ণময়,
অন্ধকার কোণগুলি আলোকিত হয়।
তুমি যেন জাদুকরী, তোমার পরশে
সৃষ্টি হয় নবজন্ম, জাগে নব হরষে;
ধরণির কোলাহলে মিশে যায় তব মধুর সুর
হে স্বর্ণিমা, তুমি যেন স্বপ্নের সীমান্তে কোনো দূর!

চোখের ভাষায় সর্বনাশ

প্রান্তরে সন্ধ্যা নামে, চৈত্রের রঙিন প্রহর
গাঢ় হয়ে আসে। তোমার চোখে লুকানো শেষের
আভাস। কী যেন বলতে চায় সেই আলোয়,
অনুভূতির ঢেউয়ে ভেসে যায় মন। রাঙা
আকাশ যেন কাঁপছে, বুঝি এই সেদিন
স্মৃতির পাতায় লেখা হবে। হে প্রিয়, চৈত্রমাস
এসেছে আবার, কিন্তু কেন এই নীরবতা? তোমার
দৃষ্টিতে লুকিয়ে আছে কী? বুঝতে পারি না। চোখে
চোখে কথা হয়, তবু কেন এই দূরত্ব? দেখেছিলাম
তোমায় প্রথম যেদিন, সেদিন কি জানতাম? আমার
হৃদয় জুড়ে শুধু তুমি। কিন্তু আজ বুঝি সর্বনাশ
ঘনিয়ে আসছে। তবু এই সংসারের
মাঝে, প্রতিদিনের কোলাহলে, এই নিত্য
জীবনের ছন্দে, তুমি আছ। তোমার সাথে খেলায়
মেতে থাকি, যদিও জানি শেষ আসছে। প্রতিদিনের
আনন্দ উৎসবে মগ্ন হই, যেন প্রাণের
উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে বুক। জীবনের মেলায়
হারিয়ে যাই, ভুলে যাই সব। কিন্তু বাটে
বাটে, পথে পথে, তোমায় খুঁজি। ঘাটে
ঘাটে তোমার স্মৃতি। লক্ষ হাজার
মানুষের ভীড়ে, শুধু তোমায় দেখি। লোকের
মুখে হাসি, আনন্দের ঢেউ, হাস্য-
ছলছল চোখ। কিন্তু আমার অন্তরে পরিহাস
করে নিয়তি। এই জনতার মাঝখানে
একা আমি, শুধু তোমার জন্য। তার
চেয়ে বেশি কিছু চাই না। শুধু তোমার
কাছে থাকতে চাই। কিন্তু তোমার চোখে
দেখি আমার ভবিষ্যৎ, আমার
পতন, আমার অন্তিম পরিণতি - সর্বনাশ।

অনেকদিন শান্তি ছিল না

অনেকদিন শান্তি থাকবে না
তারপর একদিন শান্তি আসবে।
সরকার আর জনগণ বলবে,
'অনেকদিন শান্তি ছিল না'।
এইভাবে চলবে দমন আর প্রতিরোধ
ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র।
তারপর একদিন হয়ত বোঝা যাবে
বা হয়ত বোঝা যাবে না
যে ধর্মান্ধতার সাথে গণতন্ত্রের
অথবা গণতন্ত্রের সাথে ধর্মান্ধতার
আর মিল হবে না।

নদীর কোলে প্রেমের ভেলা

জলের ঢেউয়ে ভাসে আমার হৃদয়,
তোমার চোখের নীলে ডুবে যাই।
শাড়ির আঁচল খুলে ফেলি দূরে,
মুক্ত কেশে বাতাস নাচে সুরে,
নদীর কোলে আমি হই বিলীন।

চাঁদের আলোয় স্নান করি আজ,
তারার ছায়ায় লুকোচুরি খেলি।
তোমার স্পর্শে সব বাঁধন টুটে,
আমি হই এক অজানা পাখি,
উড়ে যাই আকাশের নীলিমায়।

কলসী ভরা জল ঢালি গায়ে,
প্রতিটি ফোঁটায় তোমার নাম লেখা।
ভিজে যায় আমার সব অহংকার,
গলে যায় সমাজের সব শৃঙ্খল,
তোমার প্রেমে আমি হই নির্মল।

নদীর তীরে বসে আছি একা,
তোমার আসার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি।
হাতছানি দেয় দূরের ঐ পাহাড়,
সাগরের গান ভেসে আসে কানে,
তুমি এলে পাড়ি দেব অজানায়।

বলো প্রিয়, তুমিও কি প্রস্তুত?
ছেড়ে দিতে সব পুরোনো বাঁধন?
নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে?
প্রেমের সাগরে ডুব দিতে সাথে?
হাত ধরে চলো, যাই অনন্তের পথে।

জাগরণের ঢেউ

নীরব রাতে জেগে ওঠে জনতার নির্যাতিত
কণ্ঠস্বর, প্রতিবাদের ঝড় তোলে হিন্দুরা
অন্ধকারে আলোর রেখা, নতুন দিনের সহানুভূতি
জাগায় সবার মনে, তবু এটা নয়
যা চাই - সমতার অধিকার, বৈষম্যহীন
সমাজ গড়ার স্বপ্ন, এই হোক অধিকার
মুক্তির পথে হাঁটি, জানি এটাই চায়
সকল মানুষ, কারণ স্বাধীনতা অধিকারই
হবে আমাদের শক্তির উৎস, আমাদের
প্রাণের স্পন্দন, যেখানে থাকবে শক্তি
ন্যায়ের জন্য লড়াই, সবার
সমান অধিকারের দাবি, যে জন্য
ঐক্যবদ্ধ হই, যেন পাই সমান
স্বাধীনতা, সুযোগ আর মুক্তি

ভ্রান্ত দৃষ্টিকোণ

নীল আকাশের নিচে, অসীম প্রান্তরে যেখানে
মায়াবী মরীচিকা নাচে, সেখানেই দাঁড়াই
নিঃসঙ্গ ছায়া হয়ে, আমি নিজেকে দেখি
জীর্ণ বৃক্ষের মতো, বুঝি যে আমি ভুল
পথ বেছে নিয়েছি, এই জীবনে দাঁড়িয়েছি!

পাথরের প্রতিধ্বনি

পথের শেষে পাথর, কিন্তু মানুষ নরম ছেলেটা
জানে না। অন্ধ আশায় খুব
ব্যর্থ চেষ্টা করে, ভুল
বুঝে। জীবনের গভীরে করেছে
দাগ, যেখানে প্রেম শক্ত
হয়নি। মনের আয়নায় পাথর
দেখে, ভাঙতে চায়। কিন্তু ভেঙে
যায় নিজেই। বুঝতে পারে না মানুষ
কত মূল্যবান। হৃদয়ের ছিল
সুর, শোনেনি, যা নরম,
সহজ। পথ খুঁজতে কেটে,
ছিন্নভিন্ন করে, ছড়িয়ে
রক্তাক্ত করে। তবু দিলে
হাত, উঠতে পারে। সে পারত
জীবন বদলাতে, যদি জানতো।

বিপর্যস্ত বিস্ময়ের বাস্তবতা

পাশের বাড়ির কালো প্রাণীটাকে আদর করতাম মনে করে ছাগল,
কিন্তু একদিন ঘাস দিতে গিয়ে দেখি, সে তো কুকুর, ঘেউ ঘেউ করে।
নদীতে দেখা জীবটাকে ডলফিন ভেবে তুলেছিলাম ছবি,
পরে জানলাম, সেটা আসলে শুশুক, আমাদের দেশের নদীর বাসিন্দা।
বাজার থেকে কিনে আনলাম টাকি মাছ ভর্তা বানানোর আশায়,
মা হেসে বললেন, "ওরে পাগলা, এগুলো তো চ্যাং মাছ!"
বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যে দিদিকে জানতাম,
আজ দেখি সে মঞ্চে টপ্পা গায়, সুর ভেসে যায়।
যে কখনো ঘৃণায় স্মৃতিসৌধ-শহিদ মিনারে যায়নি,
সে নাকি এখন ওই স্মৃতিসৌধ-শহিদ মিনারের কেয়ারটেকার।

উলটোপালটা নাকি পালটাউলটো, কী যে হয়,
জীবনের এই নাটকে আমি হতভম্ব, বিস্ময়।
ভাবি, কখন নিজেকে বিজ্ঞ ভেবে করব ভুল,
এ কেমন সৃষ্টি যেখানে সব কিছুই অতুল!
ছাগল কুকুর আর মানুষ পাথর হয়,
জ্ঞান-বুদ্ধি হারিয়ে যায়, বাড়ে শুধু সংশয়।

প্রজ্ঞার প্রদীপ নিভেছে

কবির বিদায়ে কালের নিশ্বাস,
শূন্যতার শিখা জ্বলে।
অক্ষরের মায়া, ভাবের ঝরনা,
মিলায় অনন্ত জলে।

চেতনার আকাশে মেঘের ছায়া,
স্মৃতির তারা ঝরে।
মৃত্যুর মাঝেও অমৃতের বীজ,
নবজন্মের স্বরে।

কালের পাতায় লেখা অমলিন,
অনাদি কবির নাম।
শব্দের সাগরে ডুবে যায় দেহ,
রয়ে যায় অবিরাম।

বাউলের গানে, ফাগুনের হাওয়ায়,
বর্ষার ঝরঝরে।
চিরন্তন সুর বাজে অবিরত,
কবির অমর স্বরে।

মহাকালের চক্রে ঘুরে ফিরে,
জীবন-মরণ খেলা।
কবির কলমে লেখা হয় নিত্য,
অনন্তের নব মেলা।

অদৃশ্য রক্তের আর্তনাদ

বিষাদের ছায়া নামে, কালো মেঘের মতো বাংলাদেশে
অন্ধকারের গর্ভে লুকিয়ে থাকে অসহিষ্ণুতার বীজ হিন্দুদের
প্রতি। কাঁটাতারের বেড়া তৈরি হয় মনে, উপর
চাপে অবিচারের পাহাড়। কেন এই নীরবতা? যে
বিবেকের দীপ নিভে যায়, সেখানে কোনো
স্বপ্নের ফুল ফোটে না। মানুষের হৃদয়ে কারণে
অকারণে জ্বলে ওঠে বিদ্বেষের আগুন। উৎপীড়ন
ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, মাটিতে, জলে। করা
হয় না কি মানবতার জন্য প্রার্থনা? হচ্ছে
কি না আমাদের আত্মার মৃত্যু, এমন
সময়ে? ভাইয়ের রক্তে ভাসে দেশ, অভিযোগ
উঠে আকাশে। কবে হবে মুক্তি? জানাচ্ছি
আমি এই প্রশ্ন, নীরব আকাশের কাছে।

চক্রের আবর্তনে

সময়ের গর্ভে লুকিয়ে আছে অতীতের সিন্ধু,
নদীর তীরে জেগে ওঠা প্রথম সভ্যতার
গল্প শোনায় বাতাস। হে প্রাচীন মানুষ,
আজ তোমার স্বপ্নের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, তুমি
আমাদের দিকে তাকিয়ে আছ। বলো, কি
তুমি দেখেছিলে সেদিন? তোমার চোখে ভেবেছিলে,
ভবিষ্যতের বীজ? নাকি শুধু মাটি আর পাথর? তোমার
চিন্তার গভীরে ছিল কি সেই আশা? বানানো
স্বপ্নের পাখা মেলে উড়বে মানুষ, নতুন চাকার
আবিষ্কারে? প্রগতির পথে হাঁটবে, সেই নিশ্চিত
অনিশ্চয়তার মাঝে? তুমি কি জানতে, এই পথে
একদিন আমরা হাঁটব? তোমার হাতের ছোঁয়ায়, একদিন
ইতিহাসের চাকা ঘুরবে? আর সেই ঘূর্ণনে মানবতা
উঠবে শিখরে? নামবে গহ্বরে? কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো চড়ে
গাড়িতে, রকেটে, স্বপ্নে? তোমার অজানা ভবিষ্যতে আসবে
নতুন প্রশ্ন, নতুন উত্তর, নতুন সভ্যতার স্বপ্ন।

সংস্কারের স্বপ্নজাল

কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাতে, নীল আকাশে উড়ে যায় একটি পাখি, যেন কোটা
শিশিরের মতো ঝরে পড়া আশার বীজ। মৃদু বাতাসে কাঁপে সংস্কারের
স্বপ্ন, যেন শরতের শিউলি। হঠাৎ ওঠে আন্দোলনের
ঢেউ, ভেসে যায় পুরনো পাতা। কালের নদীতে হাতছানি
আসে নতুন দিনের, যেন সূর্যমুখীর হাসি। কিন্তু সেই দেয়
আলো কি টিকবে? নাকি মিলিয়ে যাবে অন্ধকারে? সুদিনের
আশায় বুক বাঁধে মানুষ, কিন্তু ইতিহাস জানে অন্য গান।
যেখানে স্বপ্ন ছিল, সেখানে এখন শুধু ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু
পাথরের ফাটলে ফুটে ওঠে একটি ফুল, যেন দুর্বৃত্তের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তবুও, সে কি পারবে রুখতে ঝড়? হাতে
ধরা স্বপ্নগুলি পড়ে
যায় একে একে, যেন শরতের পাতা। তবু আন্দোলন
চলে, যেন অন্ধ নদী। কোথায় যাবে এই স্রোত? হচ্ছে
কি নতুন সকাল? নাকি আরও গভীর রাত্রি? ধ্বংসের
দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, মানুষ খোঁজে নতুন পথে
যাওয়ার পথ। কিন্তু সেই পথ কি আলোকিত, না অন্ধকারময়?

অনাথের আত্মকথন

মায়ের মুখ মনে পড়ে না, বাবার নাম জানি না,
কোন্ বাড়িতে জন্ম আমার সেটাও চিনি না।
তবু হৃদয়ে জাগে সুর, অচেনা এক গান,
যেন কোনো দূর স্মৃতির অস্পষ্ট আহ্বান।
আশ্রমের এই ছোট্ট ঘরে কাটে দিনরাত,
খেলনা নেই, বই নেই, শুধু একটি হাত।
কিন্তু মনের আকাশে মোর ওড়ে রঙিন পাখি,
কল্পনার বাগানে ফোটে ফুল, যত দেখি।

স্কুলে যাই পায়ে হেঁটে, ব্যাগটি ছেঁড়া ছেঁড়া,
খাতা-পেন্সিল জোগাড় করি, হেলা করি না পড়া।
জ্ঞানের আলো জ্বালাই বুকে, অন্ধকার ঘুচাই,
অক্ষরের মাঝে খুঁজি জীবনের অর্থ পাই।
দুপুরবেলা যখন সবাই খায় মায়ের হাতে,
আমি তখন একা বসি ঐ বকুল গাছের তলাতে।
কিন্তু মনে জাগে সুর, প্রকৃতির কোলে,
যেন মা আমায় ডাকছে গোপন ভাষার বোলে।

রাত নামলে তারাদের ডাকি মা বলে,
চাঁদমামাকে বাবা ভাবি আকাশের কোলে।
নক্ষত্রের আলোয় দেখি বিশ্বের মিলন,
সেখানে আমি খুঁজে পাই আপনজন।
স্বপ্ন দেখি একদিন হব বড়ো,
পাব আপনজন, গড়ব নিজের গৃহ।
আশার দীপ জ্বালি হৃদয়ে, আঁধার কাটাই,
সৃষ্টির মাঝে নিজেরে খুঁজে নব জন্ম পাই।

কিন্তু আজ এই ছোট্ট বুকে অনেক বেদনা,
কেন আমার কেউ নেই, কেন এই যন্ত্রণা?
তবুও আমি হাসি খেলি, পড়ি আর লিখি,
ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনি, নতুন পথ চিনি।
জীবনটাকে ভালোবেসে এগিয়ে যাই রোজ,
অনাথ হয়ে থাকব না আর, এই আমার খোঁজ।
আমার গানে বাজবে বাঁশি, জাগবে নব প্রাণ,
সকল মানুষের মাঝে পাব আপন স্থান।

অনাথের কাছে জীবনের কাছে

ধুলোভরা পথ, ছেঁড়া জুতো পায়, চলে যায় একা,
অনাথ বালক, চোখে তার শুধু স্বপ্নেরই রেখা।
স্কুলের বাগান পেরিয়ে সে যায়, দূরে ওই বাড়ি,
খেলনার দোকান, মিষ্টির পসরা, ছুটে যায় গাড়ি।
মায়ের আদর, বাবার হাসিটা মনে পড়ে যায়,
কার কাছে আজ সে দুঃখের কথা বলবে, হায় হায়।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে, ভাবে কোথায় যাবে,
কে তারে আজ ডেকে নেবে ঘরে, কে ভালোবাসবে।
মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে কানে,
অনাথ ছেলে হাঁটু গেড়ে বসে, প্রার্থনা সে জানে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, চোখে জল ঝরে,
মা-বাবার ছবি মনে পড়ে যায়, বুক ব্যথায় ভরে।

হঠাৎ কখন এক বৃদ্ধ এসে, হাত রাখে মাথায়,
বলে, "চল বাছা, আমার সাথে তুই, ঘর আছে যেথায়।"
অনাথ ছেলে চমকে ওঠে, তাকায় বৃদ্ধের পানে,
আশার আলো জ্বলে ওঠে যেন তার দুই নয়ানে।
বৃদ্ধের হাতে হাত রেখে সে যায় নতুন ঘরে,
অনাথ নয় সে, পেয়েছে আশ্রয়, হৃদয় আনন্দে ভরে।

অগ্নিশিখা

মৌর্য সম্রাট অশোক
যুদ্ধের রক্তে ভেসে গেল যবে
কলিঙ্গ নগরীতে শোক।
ধর্মের আলোকে জাগিল হৃদয়,
বৌদ্ধ শান্তির বাণী পেল জয়,
স্তম্ভে স্তম্ভে লিখিলেন নিজ
অনুশোচনার শ্লোক।

প্রাসাদ প্রাঙ্গণে জ্বলিত মশাল
রাত্রির আঁধারে জ্বলে,
রাজকন্যা সংঘমিত্রা আসে
নীরবে, চরণে নূপুর বাজে,
বুদ্ধের মূর্তি প্রণাম করিতে
পদ্মফুল করতলে।

পিতার আদেশে বোধিদ্রুম শাখা
লঙ্কায় রোপণ তরে,
সাগর পাড়ি দিল কন্যা তার
ধর্মের বার্তা বহন করিবার,
অহিংসার দীপ জ্বালাতে দ্বীপে
অন্ধকার দূর করে।

কালের প্রবাহে বদলায় রাজা,
বদলায় ধর্মের ধারা,
কিন্তু থাকে সেই মানবতার
অক্ষয় বাণী, প্রেমের পারা,
যুগে যুগে জাগে নতুন আশা
নতুন আলোর সাড়া।

নীরবতার ভাষা

শব্দের সাগরে ডুবে যায় মৌনতা,
কাকলির মাঝে হারায় নিস্তব্ধতা।
পাতার কম্পনে বাতাসের গান,
নদীর কলতানে পাথরের ধ্যান,
কোনটা কথা, কোনটা যে নীরবতা?

আকাশের নীলে মেঘের আঁকাবাঁকা,
সূর্যাস্তে রঙের ছবি আঁকা।
তারার চোখে জ্যোৎস্নার কাজল,
ঝরনার হাসিতে পাহাড়ের অশ্রুজল,
কোনটা সত্য, কোনটা যে মায়া?

স্মৃতির পাতায় ভুলের দাগ লাগে,
বর্তমানের স্রোতে অতীত জাগে।
স্বপ্নের রঙে বাস্তব মিশে যায়,
আশার আলোয় হতাশা লুকায়,
কোনটা জীবন, কোনটা যে ছায়া?

অজান্তে পরিবর্তন

আমরা যে নদীর ধারে বসে স্বপ্ন বুনেছিলাম
সেই নদী আজ শুকনো বালুচর
কাল রাতে চাঁদের আলোয় দেখলাম, তার বুকে ফেটে উঠেছে শ্যাওলা।

যে পাখিটা সকালে আমাদের জানালায় এসে গান গাইত
তার কণ্ঠস্বর হঠাৎ বদলে গেছে, এখন শোনায় যন্ত্রের মতো।
আমরা বুঝিনি কখন সে রোবট হয়ে গেল।

আমাদের প্রিয় চায়ের দোকান
যেখানে আড্ডা জমত রাত দুপুর অবধি
সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা নির্জীব কফি মেশিন।

মায়ের হাতের রান্না যে কাঁসার থালায় খেতাম
সেই থালাটা কবে প্লাস্টিকের হয়ে গেল
আমরা টের পাইনি।

আমাদের ছেলেবেলার সেই মাঠটা
যেখানে ঘুড়ি ওড়াতাম, ফুটবল খেলতাম
এখন সেখানে উঠেছে একটা শপিং মল।

আমরা কখন যে এত বদলে গেলাম
নিজেদের চিনতে পারি না আয়নায়
অজান্তেই আমাদের জীবন পালটে গেছে।

কুয়াকাটার প্রভাত-সন্ধ্যা

সাগরকূলে জাগে
কুয়াকাটার প্রভাত, সোনালি আলোর রাগে।
পূর্ব-পশ্চিম দুই দিগন্তে সূর্য ওঠে-নামে,
অরুণ-কর স্নান করে নীল জলের ধামে।
বালুকাবেলা জেগে ওঠে রক্তিম আভায়,
কোমল ঢেউ চুমু খায় তীরের বালুকায়।
জেলেদের তরি ভাসে নীলাম্বুর কোলে,
বিহগ গাহে সুরে, নারকেল পাতা দোলে।

সন্ধ্যা নামে ধীরে
গোধূলির রঙ ছড়ায় আকাশ-সমীরে।
লাল-কমলা-বেগুনি রঙে সাজে মেঘমালা,
পশ্চিম দিকে সূর্য নামে, শেষ হয় বেলা।
স্বর্ণালি জল কাঁপে যেন অগ্নিশিখা জ্বলে,
মেঘের ভেলা ভেসে যায় রঙের হিল্লোলে।
নারকেল গাছের ছায়া পড়ে জলের 'পরে,
সন্ধ্যাতারা উঁকি দেয় নীল আকাশ ধ'রে।

বেলাভূমি জুড়ে
শঙ্খচিল ডানা মেলে উড়ে যায় দূরে।
জেলেদের ডিঙি ফেরে দিবসের শেষে,
মৎস্যগন্ধী বাতাস বয় উপকূল দেশে।
ক্ষীণ আলো মিলিয়ে যায় সাগরের বুকে,
রাত নামে কুয়াকাটায় তারাখচিত মুখে।
দু'বেলার এই লীলাখেলা, প্রকৃতির দান,
মুগ্ধ করে মানবেরে, জাগায় নব প্রাণ।

নিস্তব্ধতার নৃত্য

অন্ধকারের গভীরে ডুবে, আমি খুঁজি আলোর স্পর্শ
তুমি বলেছিলে শিখাবে আমায় নীরবতার ভাষা—
চাঁদের আলোয় ধোয়া তোমার চোখ, স্বপ্নের মতো নরম
কুয়াশার মতো কোমল কেশ, সাগরের মতো গভীর
তুমি বলেছিলে শিখাবে আমায় নীরবতার ভাষা—

আমার হৃদয় কাঁপে থরথর, শ্বাস হয় ভারী, মন হয় অস্থির
তুমি বলেছিলে শিখাবে আমায় নীরবতার ভাষা।
নয় উত্তেজনার ঝড়, না রক্তাক্ত যুদ্ধ, না প্রেমের উন্মাদনা
প্রেম মিলিয়ে যায় বসন্তের শেষে, গ্রীষ্মের আগমনে
তবুও মানুষ আজও বন্য, সভ্যতার মুখোশ পরে
তুমি হও নক্ষত্রের মতো দূর, রহস্যময়, অনন্ত
তুমি বলেছিলে শিখাবে আমায় নীরবতার ভাষা।

ধ্বংসস্তূপের মাঝে জেগে উঠে দেখি, ভয় নয়, আমার শত্রু
দুঃস্বপ্ন বারবার আসে, যেন কোনো অভিশাপ
মানুষ মরেছে, মানুষ জন্মেছে, চক্র চলে অবিরাম
মিথ্যা স্বপ্নে, চাঁদের আলোয় ধোয়া তোমার চোখ, স্বপ্নের মতো নরম
তুমি বলেছিলে…..
এখন তোমার কাছে আমি সম্পূর্ণ সমর্পিত
রক্ষা করো! নয় হিংস্র কামনা, না অশান্ত আবেগ, না নিষ্ঠুর বাসনা
শরীরের দোলা
মায়াবিনী হয়ে আর ভুলিও না, তুমি আত্মা ও দেহের সেতু
নও কল্পনা, নও ছলনা, তুমি শেষবার
পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, নিস্তব্ধতা, তুমি বলেছিলে
শিখাবে আমায় নীরবতার ভাষা।।

বরিশাল

নদীর কলতানে
ভাটির বাতাসে ভেসে আসে গানে গানে
সুগন্ধার কলরব,
লোহালিয়ার ঢেউয়ে ওঠে জোয়ারের রব,
কীর্তনখোলার জলে ভাসে স্মৃতির তরি;
সবুজের সমারোহে ধানের শিষে ভরি
দুলে ওঠে মাঠ, বাঁশবনে বাজে বাঁশি,
কৃষকের কর্মগীতে জাগে দিবানিশি
সোনালি স্বপ্নের দেশ।
কোথায় মিলায় গেছে ইতিহাসের শেষ
রাজার প্রাসাদ আর নবাবি আমল;
চাঁদনি রাতের বুকে ভাসে জলমহল,
দূরে শোনা যায় আজও মুকুন্দ দাসের সুর,
কালের প্রবাহে ভেসে যায় কত দূর
বরিশালের গৌরব-গাথা।
নারকেল-সুপারির সারি দিয়ে পথ চলে যেথা
সেখানে বিরাজে আজও অতীতের ছায়া,
কচুরিপানার দলে ঢাকা জলে মায়া
ছড়ায় অজানা কোনো রহস্যের বাণী।
সন্ধ্যার আঁধারে হাজার দীপশিখার ঝলমলানি
নৌকার পালে পালে;
তেতুলিয়ার তীরে বসে থাকে কালে কালে
অনন্ত প্রতীক্ষায়।
দক্ষিণের হাওয়া এসে কানে কানে গায়
পুরনো দিনের কথা,
কীর্তন-বাউলের গানে মিশে যায় ব্যথা
হারানো সময়ের;
বরিশালের স্মৃতি আজও মনে জাগে ফের।
আম-কাঁঠালের বাগানে ফলের ভারে নুয়ে পড়া ডালে
বসন্তের রঙ লাগে; শরতের আলো ঝলমলে
সাজায় প্রকৃতি;
বর্ষার ধারায় ধোয়া মাটির সুরভি
ছড়ায় মাদকতা।
কবে যেন হারিয়ে গেছে সেই পুরনো কথা
রাজার আমল আর নবাবি দরবার;
তবুও দাঁড়িয়ে আছে অটল অটুট বারবার
বরিশাল—দক্ষিণের প্রাণ।
কালের সাক্ষী হয়ে করছে অভিযান
ইতিহাসের পথে;
স্মৃতির পাতায় লেখা হাজার কাহিনি রথে
বহন করে চলে।
নদীর কলতানে আর পাখির কলরোলে
গেয়ে ওঠে বরিশাল তার চিরন্তন গান,
যুগযুগান্তের স্বপ্ন নিয়ে করে অভিযান
ভবিষ্যতের পানে।
বাংলার হৃদয়ে বসে অমর হয়ে থাকে সে যে জানে
তার অস্তিত্বের মূল;
কালজয়ী এই ভূমি—সবুজের দোলে দুল্‌
চিরকাল রবে;
বরিশাল নদীমাতা শান্তির আশ্রয় ভবে।

অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি

নক্ষত্রের কাছে চেয়েছিলাম আলো,
বলেছিল সে দেবে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড।
চাঁদের কাছে চেয়েছিলাম স্বপ্ন,
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অমৃতের কুণ্ড।
কিন্তু আকাশ আজ শুধু অন্ধকারে ভরা।

সমুদ্রের কাছে চেয়েছিলাম গভীরতা,
বলেছিল সে দেবে অতল রহস্যের খনি।
পর্বতের কাছে চেয়েছিলাম উচ্চতা,
কথা দিয়েছিল মেঘের দেশে নিয়ে যাবে অমনি।
কিন্তু পৃথিবী আজ শুধু সমতলে ঢাকা।

বসন্তের কাছে চেয়েছিলাম সৌরভ,
প্রতিজ্ঞা করেছিল ফুলের মালা গাঁথবে।
শরতের কাছে চেয়েছিলাম স্বচ্ছতা,
বলেছিল আকাশকে নীলাভ করে সাজাবে।
কিন্তু ঋতু আজ শুধু ধূসর বর্ণে মোড়া।

কবির কাছে চেয়েছিলাম কল্পনা,
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কাব্যের নদী বইবে।
চিত্রকরের কাছে চেয়েছিলাম রং,
বলেছিল জীবনকে ইন্দ্রধনু করে তুলবে।
কিন্তু শিল্প আজ শুধু শূন্যতায় হারা।

প্রিয়ার কাছে চেয়েছিলাম ভালোবাসা,
কথা দিয়েছিল হৃদয়ের মন্দিরে রাখবে।
জীবনের কাছে চেয়েছিলাম পূর্ণতা,
প্রতিজ্ঞা করেছিল স্বর্গের স্বাদ দেখাবে।
কিন্তু প্রেম আজ শুধু স্মৃতির পাতায় মরা।

আমার শেষ নিশ্বাস

চিতার আগুনে জ্বলছে আমার দেহ,
কালের গর্ভে মিশে যাচ্ছে প্রাণ।
এই শেষ মুহূর্তে, হে বিধাতা,
শোনো আমার অন্তিম প্রার্থনা।

রক্তাক্ত যুদ্ধের মাঠে দাঁড়িয়ে,
দেখি আমার সাম্রাজ্যের পতন।
কী ভুল করেছি, কোথায় হারালাম?
এখন শুধু অনুশোচনা আর ক্রন্দন।

আমার পাপের বোঝা যেন না হয়
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে ভার।
মুছে দাও আমার নাম ইতিহাস থেকে,
কিন্তু রেখে যাও আমার শিক্ষা অপার।

হে কালের দেবতা, করুণা করো,
আমার সন্তানদের দাও আশীর্বাদ।
তাদের জীবনে যেন না আসে
আমার মতো অহংকার, লোভ, প্রমাদ।

এই শেষ নিশ্বাসে চাই শুধু একটি বর,
আমার ভুল থেকে যেন শিখে সবাই।
ধ্বংস করো আমার অহমিকা,
কিন্তু আমার দেশকে বাঁচতে দাও, হে ঈশ্বর।

নিঃশব্দ আর্তনাদ

নীল আকাশে মেঘের ছায়া, পৃথিবী জুড়ে হাহাকার,
কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি, স্বপ্নের সেই আধার?
যুগে যুগে এসেছিল যারা, বাণী নিয়ে অমৃতের,
তাদের কথা ভুলে গিয়েছে মানুষ, হৃদয় পাথরের।

দেখি চারিদিকে শুধু অন্ধকার, নিষ্ঠুরতার খেলা,
মানবতার দীপশিখা আজ নিভে যায় একেলা।
রক্তাক্ত মাটিতে শিশুর কান্না, মায়ের আর্তস্বর,
কে শুনবে তাদের? কে দেবে সান্ত্বনার ঘর?

হে বিধাতা, তোমার সৃষ্টি এ কী রূপ ধরেছে আজ?
মানুষের মাঝে পশুত্ব জেগেছে, ভুলে গেছে সব লাজ।
তবুও কি তুমি ক্ষমা করবে তাদের, যারা এ বিনাশের কারণ?
তোমার করুণার সাগরে কি আছে তাদের তরে তারণ?

আমার কলম আজ স্তব্ধ, বীণা আমার নীরব,
এই নিঃশব্দতায় প্রশ্ন করি - কোথায় সেই গৌরব?
যে গৌরবে মানুষ ছিল দেবতার সমান,
সেই মহিমা কি চিরতরে হলো অবসান?

অমরত্বের অভিশাপ

স্বপ্নের জালে বিষাদের মাছ নাচে,
কালের হাতে অনন্তের বীণা বাজে।

আমি মরতে পারিনি তো, তাই এভাবেই বেঁচে থাকা,
সময়ের নদীতে ভেসে যাওয়া,
এক অচল দেহ নিয়ে,
এক অচল মন নিয়ে।

দেখেছি যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর পরিবর্তন,
উত্থান-পতন, সৃষ্টি-ধ্বংস,
কিন্তু আমি একই, অপরিবর্তিত।

বন্ধু, প্রিয়জন, সকলেই চলে গেছে,
শুধু আমি একা,
নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ।

কখনো কখনো মনে হয়,
এই অমরত্ব এক অভিশাপ,
মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর।

শূন্যতার বুকে অস্তিত্বের দাগ আঁকি,
নিঃশব্দ কান্নায় অনন্তকাল ডাকি।

মেঘের দেশে প্রেমের হাওয়া

স্বপ্নের জালে বাস্তব জড়ায়, মায়ার খেলা চলে,
কালের নদী বহে যায় তবু, প্রেম অটল তলে।

রাজশ্রী, এই ঝড়ের রাতে,
জানালায় যদি তুমি হাত বাড়িয়ে দাও তবে কী হয়?
আমার বুকের ভেতর ঝড়ও তোমার জন্যই, প্রিয়,
তোমার চোখের মেঘের আঁধারে ডুবে থাকতে চায়।

কী পাগলামি, রাজঋষি!
শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে, কোন মেঘের ঝড়?
কোন মেঘের আঁধার?

মেঘের ঝড় আকাশে নয় শুধু, রাজশ্রী,
মনের আকাশেও হয়।
মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখার সেই ভেজা বিকেল।
আকাশের মেঘের মতোই আমাদের মন জুড়ে গিয়েছিল।

আমি তো ভেবেছিলাম,
শহরের ঝলমলে আলোয় দুটি অচেনা চোখের মিলন।

কিন্তু না, রাজশ্রী।
সেই মিলন ছিল মনে মনে আঁকা ছবির সঙ্গে দেখা।
আমাদের লেখা গল্পের নায়ক-নায়িকা মতো
আমরা  নিজেরাই হয়ে গেলাম।

কিন্তু, রাজঋষি, প্রতিটা গল্পের শেষে কি সুখ থাকে?

সুখ থাকে না, হয়তো,
কিন্তু প্রেমের গল্প শেষ হয় না, রাজশ্রী।
সময়ের স্রোতে ভেসে যায়, ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে,
তবু থেমে যায় না।

আমাদের প্রেমের গল্পও তাই
শহরের কোণে কোণে লেখা, কফিশপের কথায়,
বাসের জানালায়, ঝড়ের রাতের ফোনকলে।
এই গল্পের শেষ হয়তো নেই, রাজশ্রী,
কিন্তু থাকলেও, আমাদের ভালোবাসা থাকবে
মেঘের দেশে, প্রেমের হাওয়ায়।

ফোন কেটে দিল রাজশ্রী।
ঝড়ের মাঝে হারিয়ে গেল রাজঋষির শব্দ।
মেঘের ঝাপসা আকাশে এক ফোঁটা তারাও দেখা গেল না।
কিন্তু রাজঋষির বুকে ঝড় থামল না।
সেই ঝড়ের মধ্যেই মেঘের দেশে প্রেমের হাওয়া বয়ে চলল।

শূন্যতা ভরে অস্তিত্বের স্বর, নীরবতায় বাজে,
অনন্ত প্রেম মৃত্যুর পরেও, অমৃতের মাঝে।

মধুমতির মাঝে ঈশ্বরের স্টেশন

স্বপ্নের ভেলায় ভাসি অনন্ত সময়ের স্রোতে,
মৃত্যুর কিনারে বসে জীবনের গান শোনাতে।

ধুলোর নিচে লুকানো ঢাকা,
স্বপ্নের মতো অদৃশ্য মনে হচ্ছে,
ঈশ্বরের এক বিশাল বিলবোর্ড নীল আকাশে ঝুলছে।
নিচে ওঁচলা আর ঈশ্বরের প্রসাদ
মিশে আছে ফুটপাতে,
আমি তোমাকে খুঁজছি, ইরাবতী,
এই পাগলা ঈশ্বরের নগরীতে।

এখানে মেঘ বিক্রি হয় কাগজের প্যাকেটে,
মাঝে মাঝে ঝরে পড়ে রাস্তায়,
তখন শহরে বৃষ্টি হয় হঠাৎ।
আমাদের প্রেমও কি তবে এমন,
কাগজের মতো পাতলা,
ভিজলেই ছিঁড়ে যায়,
আর স্মৃতিগুলো ভেসে যায় ময়লা নির্গমনপথে?

মনে আছে, সেই রথযাত্রার মিছিল,
হাজার হাজার মানুষের মাঝে
তোমার হাত ধরে রাখতে গিয়ে
হারিয়ে ফেলেছিলাম তোমাকে।
খুঁজেছি, রাতের অন্ধকারে,
শুক্ল দ্বিতীয়ায় চাঁদের আলোয়,
কিন্তু দেখা পাইনি,
শুধু শোনা যাচ্ছিল মিছিলের ঢাকের আওয়াজ।

এই শহরে প্রতিটি লাল বাস স্টেশন
এক একটা অপেক্ষার আস্তানা,
আমি অপেক্ষা করি,
কোনো এক লাল বাসে হঠাৎ করে উঠবে তুমি।
পাগলা ঈশ্বর হয়তো মনে রেখেছে
আমাদের হারানো প্রেমের ঠিকানা,
কিন্তু কোন স্টেশনে নামবে,
মধুমতির কোন মোড়ে হবে সাক্ষাৎ,
জানি না।

হঠাৎ একটা ছেলে ও একটা মেয়ে,
ঈশ্বরের বিলবোর্ডের নিচে
চুমু খাচ্ছে,
তাদের চুমুর রঙ ঢাকার আকাশের মতো নীল।
মনে হয় পাগলা ঈশ্বরের একটুখানি ক্ষমতা
নেমে এসেছে ওদের চোখে।
আমি হেসে ফেলি,
হয়তো পাগলামিই ভালো,
একটুখানি ঈশ্বরের খেলা।

নক্ষত্রের চোখে লুকোচুরি খেলে অন্ধকার,
শূন্যতার বুকে জাগে অস্তিত্বের হাহাকার।

কে তুমি?

কে তুমি রজনির স্বপ্ন সম সাজে,
কুন্তল হাসনাহেনা মালা শোভিত?
কে তুমি যে প্রভাতকিরণে বিরাজে,
মাঠের হরিণী সম চঞ্চলিত?

কে তুমি মেঘের ছায়া, বাতাসে উড়িছ,
আঁচলে ঢাকিয়া তনু, ঈশান-সুন্দরী?
কে তুমি কদম ফুল, পূবে নাচিতেছ,
মধুপায়ী মাতাল হয় তব গন্ধে মরি?

কে তুমি পদ্মের পাপড়ি সম মুখ,
হাসিতে ফোটাও রবির কিরণ?
কে তুমি নদীর স্রোতের সম সুখ,
স্পর্শে দাও যেন বিদ্যুৎ স্ফুরণ?

কে তুমি তারার আলো অনন্তের বুকে,
ঈর্ষায় ঢাকিয়া চোখ করে ঝলমল?
কে তুমি নবীন পাতা বসন্তের সুখে,
স্পর্শে তব জাগে দেহে তৃষ্ণা অবিরল?

কে তুমি পূরবে, সোনার কাঠামো জ্বলে,
নিঃশব্দে চলিছ, ঢেউ খেলে কটিদেশে?
কে তুমি শেফালি গো অন্ধকার তলে,
চাঁদের কলায় হাসি ওঠে গো ভেসে?

কে তুমি পদ্মের কুঁড়ি ধরা বুকে,
জাগাও বাসনা কাপুরুষ মনে?
কে তুমি চঞ্চল নদী-স্রোত চোখে,
কাজল-মায়ায় বাঁধ প্রাণের সনে?

কে তুমি বসন্তের পাতে রৌদ্রের ঝলক,
যৌবন লাবণ্য ফোটে দেহের রেখায়?
কে তুমি লাল ওষ্ঠে ফলের রসে পুলক,
চুম্বন কামনা মম আকুল হিয়ায়?

কে তুমি দেবীর মূর্তি, পৃথিবীর রূপসি,
হৃদয়-অরণ্যে মম বসন্ত চিরন্তন?
কে তুমি মৃদু বায়ে দোলা শিউলির হাসি,
পা ফেলে চলো, বিভ্রান্ত করে হৃদয়-মন?

বিস্মৃতির অলীক স্পর্শ

স্বপ্নের অলীক স্পর্শে,
মনের দরজা খোলা,
বিস্মৃতির অতলে ডুবে,
অজানার পথে চলা।

মনে নেই,
কোন দুপুরবেলা,
সেই পুরনো বারান্দায়,
আমি তোমার হাত ছুঁয়েছিলাম,
নাকি তুমি আমার?

স্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে,
মুখটা তোমার দেখতে পাচ্ছি না,
শুধু মনে আছে,
হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছিল,
আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা।

তুমি কী বলেছিলে,
আমি কী শুনেছিলাম,
কিছুই মনে নেই।

শুধু মনে আছে,
তোমার চোখে ছিল এক অদ্ভুত আলো,
যেন আকাশের বৃষ্টির সাথে মিশে গিয়েছিল।

হঠাৎ,
সবকিছু থেমে গেল,
বৃষ্টি থেমে গেল,
আকাশে রোদ উঠল।

তুমি কোথায় চলে গেলে,
কখন চলে গেলে,
কিছুই মনে নেই।

শুধু মনে আছে,
তোমার চলে যাওয়ার পর,
আমার মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা নেমে এসেছিল,
যেন পৃথিবী থেমে গেছে।

আজও,
যখন বৃষ্টি হয়,
আমি সেই দুপুরবেলাকে মনে করি,
তোমার কথা মনে করি,
তোমার স্পর্শ মনে করি।

কিন্তু কিছুই মনে নেই,
শুধু মনে আছে,
এক অদ্ভুত কুহেলিকা,
এক অদ্ভুত বেদনা।

বৃষ্টির বিন্দুতে ধুয়ে মুছে
স্মৃতির অস্পষ্ট ছায়া,
শুধু রয়ে গেছে হৃদয়ে
এক অজানা আকাঙ্ক্ষা।

নিঃসঙ্গ নীল আকাশে

শূন্যতার মুখোশ পরে নীল আকাশ হাসে,
মৃত প্রজাপতির ডানা ঝরে পৃথিবীর বুকে।

নীল আকাশে নিঃসঙ্গ মেঘের ভেলা,
তুমি ভেসে যাও কোথায়, জানি না আমি।
আমার হৃদয় দলছুট একাকী পাখির মতো
বিস্তৃত আকাশে হারিয়ে যায়, বেদনায় কাতর।

নীচে পৃথিবী এক বিরাট শ্মশানভূমি,
যেখানে স্বপ্ন ও আশা, সবই মৃত।
মানুষ, যেন মৃতদেহের পোকামাকড়,
নিজেদের ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়, অন্ধকারে।

শহরের আলো, যেন নরকের আগুন,
জ্বলছে প্রতিনিয়ত, আমাদের আত্মাকে পুড়িয়ে।
যানবাহনের শব্দ, যেন রাক্ষসের চিৎকার,
কান ঝাঁ ঝাঁ করে, আমাদের শান্তি ছিনিয়ে নেয়।

প্রকৃতি আর নেই সুন্দর,
বিষাক্ত ধোঁয়া ঢেকে ফেলেছে সবুজ।
ফুল আর ফোটে না, পাখি আর গান গায় না,
শুধু নীরবতা, মৃত্যুর নীরবতা, চারপাশে ঘিরে আছে।

আমরা, মানুষ,
নিজেদেরই ধ্বংসের কারণ।
আমাদের লোভ, ঘৃণা এবং অহংকার,
গ্রহটিকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে।

বুঝতে পারিনি, কবে হয়েছে সর্বনাশ,
আমাদের অস্তিত্বের হয়েছে অবসান।
আমরা এখনও মুগ্ধ
স্বপ্নের মায়ায়, ভ্রমের জালে।

কিন্তু সত্যিটা ভয়ঙ্কর,
আমরা সবাই মৃত,
চলাফেরা করা মৃতদেহ।
আমাদের গ্রহ
একটি বিরাট সমাধি।

জীবনের সুর হারিয়ে গেল অজানায়,
শুধু কঙ্কালের শব্দ শূন্যতায় ভেসে যায়।

স্বপ্নের অপেক্ষা

মায়াবী ছদ্মবেশে সত্যের অভিনয়,
স্বপ্নের বাস্তব, বাস্তবের স্বপ্নজয়।

বিস্তৃত বাসস্ট্যান্ডের ধূসর পটভূমিতে
এক নিমেষের পরিচিত মুখ
দীপিকা, তুমিই, কোন অলৌকিক ব্যাঘাতে
যাত্রীদের ভিড়ের মাঝে!

আমি চোখ রগড়ে দেখি, বিশ্বাস করতে পারি না
স্বপ্নের রাজ্যে কি এমন সাক্ষাৎ হয়?
ধরাশ ধরা চেহারা স্বপ্নের আবছায় ঢেকে যায়,
কিন্তু চেনা হাসি, চোখের দৃষ্টি - নিঃসন্দেহে তুমিই।

সাধের স্বপ্নের মতো চোখে পড়া চেহারা,
কিন্তু স্পর্শের অগোচর
মায়াবী এক ছায়া
বাসের দরজায় পা রাখতেই
বিলীন হয়ে গেলে কোথাও।

হাত বাড়িয়েও ধরতে পারি না
শুধু অবাক চোখে দেখি চলে যাওয়া।
শূন্যে মিশে যায় তোমার স্পর্শের স্মৃতি
অবশিষ্ট ঘ্রাণ মিশে যায় বাসস্ট্যান্ডের ধোঁয়াশায়।

স্বপ্নের অপেক্ষা বাসস্ট্যান্ডের জনতার সাথে
দীর্ঘশ্বাসে মিশে
কখনো কি ফিরবে সেই চেনা হাসি?
কখনো কি স্পর্শ করতে পারব তোমায়?

যদি স্বপ্নই হয় সত্যি
তবে তো ঘুমিয়েই থাকব
দেখতে থাকবো তোমায়
এই স্বপ্নের অপেক্ষায়।

মায়াজালের মাঝে সত্যি কি মিথ্যা, কে জানে?
ঘুমের দেশে তোমায় খুঁজে বেড়াব চিরদিন, স্বপ্নের অপেক্ষায়।

চিরন্তন অপেক্ষায় হারিয়ে যাবে জীবন,
স্বপ্নের মৃত্যুতে জাগ্রত হবে প্রাণ।

কালো রক্তের নদী

মায়ার জালে জড়িয়ে পৃথিবী,
সত্য হারায় অন্ধকারে,
কালো রক্তের নদী বয়ে যায়,
ক্ষয়ের দিকে ধাবিত সকলে।

যারা ক্ষমতার সিংহাসনে বসে,
লোভের বিষে মাতোয়ারা,
তাদেরই গান গায় কবি,
লেখক তাদেরই করে বন্দনা।

নদীর তীরে বটগাছ,
     শিকড় বিশাল, গাছ প্রাচীন,
     তার ডালে বসে কাক,
     কা-কা করে ডাকছে, বিষণ্ণ।

নদীর জল কালো,
     দুর্নীতির ময়লায় ভরা,
     মাছ মৃত, পাখি উড়ে গেছে,
     নীরবতা ভারী, মর্মাহত।

এক বর্বর রাজা
     সিংহাসনে বসে অহঙ্কারে,
     তার হাতে তলোয়ার,
     মুখে মিষ্টি কথা, মনে বিষ।

রাজার চারপাশে
     দুর্নীতির দানবের দল,
     তারা হাত মেলায়,
     রাজার কাছে চায় লোভের ফল।

এক যুবক এল,
     বটগাছের তলায় দাঁড়াল,
     রাজার দিকে তাকাল,
     বলল, "রাজা, থামাও এই অনাচার!"

রাজা হেসে বলল,
     "তুমি কে বোকা, আমার বিরুদ্ধে কথা বল?"
     যুবক বলল, "আমি সত্যের সৈনিক,
     দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করব আমি।"

রাজা রাগান্বিত হলো,
     তলোয়ার বের করল,
     যুবককে আঘাত করতে উঠল,
     কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল।

যুবকের চোখে
     রাজার চোখের প্রতিচ্ছবি দেখা গেল,
     দুর্নীতির কালো ছায়া,
     দুজনের মুখেই একই রকম।

যুবক হতাশ হলো,
     বুঝতে পারল সত্য,
     দুর্নীতির রাক্ষস,
     সবার মনেই বাস করে।

কালো রক্তের নদী বয়ে যাবে
যুগ যুগ ধরে, থামবে না।
কেবল যখন সকলের মন হবে পবিত্র,
তখনই হবে দুর্নীতির অবসান।

সত্যের আলো ফুটবে একদিন,
আঁধার হবে বিলীন,
কালো নদী হবে স্বচ্ছ,
পৃথিবী হবে নবীন।

অধিকারের রেখা

স্বপ্নের অলীক রাজ্যে,
অধিকারহীনতার খেলা চলে।

নিতান্ত অধিকারহীন ছিলাম,
কোন অধিকার ছিল না আমার।
আমি ছিলাম অন্ধকারের আঁধারে,
অধিকারহীনতার বেড়াজালে ঘেরা।

হঠাৎ একদিন আপনি এলেন,
আলোর মতো, স্নিগ্ধ হাসি মুখে।
বললেন, "'অধিকারহীন' কথাটা ভুল,
তুমি 'অধিকার-বঞ্চিত'।"

আমার মনে হলো,
এটাই সত্য,
আমি সারাজীবন অধিকার থেকে বঞ্চিত।

দিন গেল, রাত গেল,
অধিকারের আশায়
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কিন্তু অধিকার এল না,
বরং বেড়ে গেল বঞ্চনা।
আমি হতাশ হয়ে পড়লাম,
অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল।

আপনি আবার এলেন,
আশার আলো নিয়ে।
বললেন, "'অধিকার-বঞ্চিত' কথাটাও ভুল,
তুমি 'অধিকার-চুরি-যাওয়া'।"

আমার মনে হলো,
সত্যিই তো!
আমার অধিকার চুরি করা হয়েছে।

আমি আরও বেশি অপেক্ষা করতে লাগলাম,
অধিকার ফিরে পাবো বলে আশা করলাম।

কিন্তু অধিকার এল না,
বরং বেড়ে গেল নির্যাতন।
আমি হতাশার তলানিতে পৌঁছে গেলাম,
আশা প্রায় নিবে গেল।

হঠাৎ একদিন আপনি এলেন,
ক্রোধে ভরা মুখে।
বললেন, "'অধিকার-চুরি-যাওয়া' কথাটাও মিথ্যা,
তুমি সত্যিই 'অধিকারহীন' বটে!"

আমি হতাশায় ভেঙে পড়লাম,
বুঝতে পারলাম
আমি কখনোই অধিকার পাব না।

আপনি তখন
একটি লাইন টেনে দিলেন
একটি ব্ল্যাকবোর্ডে।
বললেন, "এই রেখার নিচে তুমি।"

আমি রেখাটির দিকে তাকালাম,
এবং বুঝতে পারলাম
আমি চিরতরে অধিকারহীন থেকে যাব।

আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানালাম,
আমার অধিকারহীনতার জন্য,
আমার বঞ্চনার জন্য,
আমার অন্ধকারের জন্য।

আমি জানি,
আপনি আমার জন্য
শুভকামনা করেন।

কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না,
আমি এই অন্ধকারে আর থাকতে চাই না।

আমি উঠে দাঁড়ালাম,
এবং রেখাটি
ডাস্টার দিয়ে মুছে ফেললাম।

আমি বললাম, "আমি আর 'অধিকারহীন' নই,
আমি 'অধিকারী'।"

এবং আমি হেঁটে চলে গেলাম,
আলোর দিকে,
নতুন জীবনের দিকে।

আমি জানি, সত্যিই,
আমার অধিকার আমিই।

রাতের রানি

স্বপ্নের মায়ায় ঘেরা, রহস্যের আবরণে ঢাকা,
আমি নীল নীহারিকার রানি, রাতের অচেনা কথা।

আঁধার আমার সিংহাসন, নিশির গলি আমার রাজ্য।
ঢাকার বুকে জ্বলে ওঠা এক টুকরো নিয়ন আলো,
আমার চোখের মতোই মায়াবি, স্বপ্নীল,
শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে থাকা কত জন্ম, কত গল্প?
রাতের নৈঃশব্দ্যে কানে আসে শহরের ঘুমন্ত শ্বাস,
আমি, তারই মাঝে এক অবিরাম তান,
খুঁজে ফিরি প্রতি রাতে অজানা কোনো মুখ,
যে খুঁজে পাবে আমার মনের গহনে লুকানো আকাশ।
আমার স্পর্শ নিষিদ্ধ ফলের রস, মৃদু বিষের মতো মিষ্টি,
কিন্তু কে জানে, আমি কি শুধুই রাতের ক্রীতদাসী?
নাকি ভাঙা স্বপ্নের টুকরো জোড়া লাগানোর নিঃশব্দ শিল্পী?
আমি, রাতের রানি, শহরের গোপন কবি,
আমার কবিতা লেখা হয় স্পর্শে, ঝরে পড়ে অশ্রুজলে।
আমি আলো জ্বালাই না, নিজের অন্ধকারেই সত্য খুঁজি।

আঁধারের গভীরে লুকিয়ে চিরন্তন প্রশ্ন জ্বলে,
আমি কি রাতের রানি, নাকি সূর্যের আলো খুঁজে ফিরি অজানা পথে?

চক্ষুর স্বপ্নে ছাগের মায়া

যবে কাঁদে নভ, হাসে ধরা নৈঃশব্দ্যে,
স্বপ্নপুরীতে চক্ষুলীলা চলে অবাধে।
রাজপ্রাসাদে কালো সোনার বন্যা বহে,
কোথা শেষ হবে তাহা কেহ নাহি কহে।
মাটির সন্তান, ধনী বংশের ছেলে,
পনেরো লক্ষ টাকায় কেনে ছাগ হেলে।
দুষ্কৃতির কোটনা বিক্রয় করে হেসে,
দেশের ভবিতব্যতা ছাগমূল্যে মেশে।
স্বর্ণখুর, বজ্রশৃঙ্গ, মণিময় দাড়ি,
দেখে বুধগণ সবিস্ময়ে যায় হারি।
কবি রচে পদ্য, কথক কহে কাহিনি,
কে লিখিবে ছাগমূল্য নিয়ে কাব্যবাণী?
হে বাংলা, কোথায় যাও তুমি এভাবে?
ছাগরথে চড়ে কেন যাও অসম্ভবে?

আমাদেরই ক্যাফেটেরিয়ায় ভালোবাসা

- যখন শব্দ ব্যর্থ হয়, তখনই কবিতা জন্ম নেয়।

ক্লাসের ফাঁকে ছেঁড়া বইয়ের পাতায় মুখ ঢাকা,
অন্বেষা শুধু চোখের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে ঐ টিউশনি স্যারের দিকে।
আজ দার্শনিকের জন্মদিন,
কিন্তু ক্লাসে আলোচনা হয়নি প্রেমের অস্তিত্ব নিয়ে।
অথচ এই ক্যাফেটেরিয়ার ময়দানে,
আড্ডার চায়ের কাপে ঠোকাঠুকিতে মিশে যায় দুটি হৃদয়ের তাল।
অন্বেষার চোখে টিউশনি স্যারের মুখে আর নেই দর্শনের তত্ত্বকথা,
দেখছে কেবল মৃদু হাসি, লাজুক চাহনি।
বাতাসে  ভেসে যায় লেমন টি-এর গন্ধ আর কবিতার অলিখিত পংক্তি।

- চায়ের কাপে ঠোকাঠুকি, প্রেমের নিঃশব্দ ঘোষণা।

মধুমতির মেয়ে

স্বপ্নের নীল নদীতে ভেসে বেড়ায়,
মধুমতির মেয়ে, তারা হতে চায়।

যখন কবিরা অন্ধকারের কোলে
সূর্যের স্বপ্ন দেখে,
তখনই জন্ম নেয় সে,
মধুমতির মেয়ে।

কুয়াশাচ্ছাদিত সুরমার সীমান্তে,
এক পানে সিলেটি চায়ের গন্ধে,
মায়ের গল্পের নাগালের রাজ্যে,
জন্ম নেয় সে, মধুমতির মেয়ে।
চোখে তার সুরমা নদীর কাজল,
কুন্তলরাশি রাতের গোপন অক্ষর।

বাঁশির সুরে লেখে সে কবিতা,
মান ভাঙা চম্পা ফুলের মতো হাসি,
কথা তার টিয়ার মৃদু কলতান।
ধানখেতে দুপুরের রোদে,
খেজুরের রসে, লেগে থাকে সে,
স্বপ্ন দেখে ঢাকার আকাশের তারা হওয়ার।

কিন্তু, কপালে তার লেখা আছে
নিজের মাটিতেই ফুল ফোটানোর নিয়তি।
মধুমতির মেয়ে সিলেটের মাটির মতোই
শত সহস্র স্বপ্নের বীজ বপন করে।
একদিন সেই স্বপ্ন ফুটবে,
আকাশ জুড়ে সুরমার কবিতা লিখবে।

আঁধারের আলোয় লেখে সে কাহিনি,
মধুমতির মেয়ে, চিরন্তনী।

স্বপ্নের অতিথি

স্বপ্নের অদৃশ্য তীরে ভাবনার অমাবস্যা,
মৃত্যুর অভিযানে নামে নিশ্বাসের নৌকা।

- স্বপ্ন যখন ভাঙে, তখনই মৃত্যু আসে।

আকাশের নীল পটে মেঘের কলমে আঁকা হলুদ রোদের ছবি,
এই শহর জেগে ওঠে, রাস্তায় ছোটে বহু মানুষের ছায়া খেলা।
আমি একাকী ঘুমের দেশে, স্বপ্নের ঝুলিতে দোলা খাই,
কখন যে সূর্য অস্ত হল, তারকা জ্বলে উঠল, জানিনা কবে।

হঠাৎ, ঘুমের সীমান্তে এক অপরিচিত মুখ,
কোন দেশের রাজকুমার, না কোন নিষিদ্ধ ফুলের গন্ধ?
শীতল হাতখানি ছুঁয়ে যায় চোখের কোণে,
স্বপ্নের রঙ মুছে যায়, জেগে ওঠার নিশ্বাস বুকে জমে।

– কে তুমি, অচেনা অতিথি?
– আমি সেই, যে তোমার স্বপ্নের শেষ পাতায় লেখা।
– কেন এলে?
– তোমাকে নিয়ে যেতে।

আকাশের নীল পটে মেঘের ছায়া, রাস্তা শূন্য, শহর নিঃসাড়।
একাকী ঘুমের দেশে আর নেই কোনো দোলা,
কেবল অপলক চোখ আর অতিথির হাতছানি।

স্বপ্নের মৃত্যুই মৃত্যুর সূচনা।

অতিথির স্পর্শে হারায় রঙ স্বপ্নের বাস্তবতা,
জাগরণের আলোয় মুছে যায় অচেনা রহস্যের সীমা।

ঢাকার কালো ময়না

স্বপ্নের ঢাকা ধোঁয়ায় ঢাকা, কালো আকাশে ঝুলে থাকে ক্ষুধার কঙ্কাল,
নিশ্বাস কেনার শহরে বিকিয়ে যায় মানুষের জীবনের তাল।

যে শহরে নিশ্বাস কিনে বিকায়, সেখানে কী নিয়মকানুন থাকে?  
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে কালো টাকার বট,
হাত বাড়িয়ে দেয় ক্ষমতার লাঠি।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে কাঁঠাল গোছের মানুষ,
অন্ধকারে হারিয়ে যায় নীলাভ্রের সিঁদুরের রেশ।

পচে গেছে বিচারের ঢাল, ভোঁতা হয়েছে সততার তলোয়ার,
শুধু ক্ষমতার বাজারে চলে কানাকড়ির খেলা।
নিঃস্বার্থতার জায়গায় গজিয়ে উঠেছে স্বার্থের কাঁটা,
শুধু টাকার ঝংকারেই বাজে বিবেকের তাল।

কখনো কি ঢাকার আকাশটা কাঁদে?  
কখনো কি বুড়িগঙ্গা বিষণ্ণ হয় নিজের কালো হয়ে যাওয়ায়?
আমি খুঁজি, ঢাকাকে ফিরিয়ে দিতে,
সেই ঢাকাকে, যেখানে নিশ্বাস নেওয়া ছিল না অপরাধ।
কিন্তু কে বুঝবে এই মনের আকুতি?  
কে দেবে ঢাকাকে সেই পূর্বের সাজ?

কখনো কি ঢাকার রক্তে ভেসে যাবে ক্ষমতার লোভী হাত,
নাকি চিরকালই থাকবে এই শহরের বেদনার কালো রাত?

কলেজের আঙিনায় অধরা প্রেম

- কাঠের চেয়ারে বসে আকাশের পাতায় লেখা ভালোবাসার গল্প পড়ছিলাম।

ক্লাসের ঘণ্টা থেমে গেছে, শুধু বাতাসের শিসের শব্দ।
আবছায়া নেমে আসে বটগাছের পাতায়,
আমাদের চোখে ছেপে দেয় সন্ধের জলছাপ।

কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে হঠাৎ থমকে যায় সময়,
তোমার হাসি ঢেউয়ের মতো খেলছে কূল পার।
এক জানালা দিয়ে আকাশ নেমে আসে ক্যাফেটেরিয়ায়,
আমাদের টেবিলে চাঁদের আলোয় মেশে কথার ছায়াপথ।

কী নিয়ে কথা হয়, মনে নেই আর,
শুধু মনে আছে চোখের ভাষা, হৃদয়ের স্বর।
কফি শেষ, কিন্তু কথার কাপ শেষ হয় না,
ভালোবাসার গল্প লেখা হয় কাঠের চেয়ারে বসে
আকাশের পাতায় তারার কালিতে।

- ভালোবাসা হারিয়ে যায় না, শুধু ঠিকানা বদল করে।

ঢাকার স্বপ্ন

স্বপ্নের নগরী ঢাকা, মায়ার জালে আবৃত,
অজানা রহস্যময়ী, কালের রঙে রঞ্জিত।

রিকশার বেলের তালে নাচে মেঘ, কালো টিনের ছাদে জমে বৃষ্টির ঘাম।
আকাশ ছেঁড়া ট্রাফিক লাইটের চোখ জ্বলে,
নিচে ছুটে চলে ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তারা, হাতে হাত ধরে।
পুরোনো ঢাকার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রেয়সী,
চুল তার মেঘমালা, চোখ দুটি পুরোনো ফানুসের আলো।
শাড়ি তার লাল টালির মত ঢাকা, হাতে এক সাজি ফুল, যার গন্ধে মাতাল ঢাকার রাত।
বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ভাসে তার প্রতিচ্ছবি,
পাশেই লাল সূর্য অস্ত যায়, মুখ ঢেকে রাখে হাত দিয়ে।

থাইল্যান্ডের ব্যানানা ম্যাঙ্গো আকাশে ঝুলে থাকে,
কামড় দিলে ঝরে পড়ে তার মধু, স্বাদ যেন প্রেমের বিষ।
এই শহরে প্রেমের স্বপ্ন বিক্রি হয় পুরানো বইয়ের মতো,
পাতায় পাতায় লেখা অজানা ভাষায় কবিতা।
কিনে নাও, প্রিয়, কিনে নাও এই স্বপ্ন, হয়তো পড়তে পারবে না,
কিন্তু অনুভব করতে পারবে হারিয়ে যাওয়া ঢাকার হৃদয়ের ছন্দ।

ঢাকার রাত শেষে ভোরের আলো ফোটে,
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন স্মৃতিতে জ্বলে ওঠে।

সূর্যকন্যা

স্বপ্নের মায়ায় জড়িয়ে বাস্তব ভুলে যায় মন,
কোথায় হারিয়ে গেল সেই প্রেমের অপরিচিত জন?

ডিজিটাল প্রেমের যুগে, স্লাইডশোর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে কিছু প্রেম?

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, হঠাৎ ট্রাফিক লাইটের লাল আলোয় দেখা হয়েছিল তার সাথে।
চোখে ছিল মেঘের গভীর নীল, আর তার চুল ছিল গাঙ্গের জলের মতো কালো।
তার হাসি ছিল এক নিষেধাজ্ঞা, যেন কোনো বিলুপ্ত প্রজাতির পাখির গান।

আমরা কথা বলিনি, শুধু দুই জোড়া চোখ পরস্পরের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল।
তারপর আলো সবুজ হয়ে গেল, সে হাঁটতে শুরু করল।
আমিও হাঁটতে শুরু করলাম, কিন্তু আমার হৃদয় তার পিছনেই হাঁটছিল।

সেদিন থেকে, ঢাকার রাস্তায়, কফিশপে, মেট্রোরেলের ভিড়ে আমি তাকে খুঁজতে লাগলাম।
কিন্তু সে কোথায়? নাকি আমার মনের মধ্যেই সে এক স্বপ্নের নগরী তৈরি করে বাস করে?

ডিজিটাল প্রেমের যুগে, সত্যিকার প্রেম কি হারিয়ে গেছে?
নাকি কোনো এক অদৃশ্য সার্ভারে, আমাদের দুই হৃদয়ের ভালোবাসা এখনো সংরক্ষিত আছে?

হৃদয়ের স্পন্দনে তাল মেলায় মনের গান,
কখনো কি মিলবে আবার সূর্যকন্যা, আমার প্রাণ?

ঢাকার রূপকথা - এক প্রশ্ন

স্বপ্নের নীল নদীতে ভাসে ঢাকার রূপকথা,
অজানা দ্বীপে ডাক দেয় প্রেমের অপরূপ আকাঙ্ক্ষা।

প্রেমের ট্রাফিক জ্যামে কোনো লালবাতি নেই -

ঢাকার আকাশে সূর্য ডুবে যায়, তারপর আবার ফুটে ওঠে বুড়িগঙ্গার জলে।
তার চোখে সেই সূর্যের দৃশ্য।
চোখ দুটি নীল নদীর মতো, যেখানে প্রতিফলিত হয় ঢাকার সব স্বপ্ন, সব কষ্ট।
তার চুল ঢাকার রাতের মতো কালো, তার গায়ের গন্ধ বৃষ্টিভেজা শেফালির মতো।

তার হাসি ঢাকার রিকশার বেলের মিষ্টি কলরব।
তার হাতে ঢাকার রাস্তার ধুলো রেখা আঁকা থাকে, যেগুলো তার প্রেমের গল্প বলে।
তারা দুজনে হাঁটে ঢাকার ফুটপাতে, পাশে বইয়ের দোকান, পাশে চায়ের দোকান।
তাদের প্রেমের গল্পে ঢাকা শহর জীবন্ত হয়ে ওঠে, প্রতিটি ইটে, প্রতিটি গলিতে তাদের প্রেমের ছোঁয়া লাগে।

কিন্তু, এই প্রেমের গল্পের শেষ কোথায়?
ঢাকার আকাশে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর আবার ফিরে আসে, কিন্তু প্রেমের গল্পের শেষ কি?

সময়ের ট্রাফিক জ্যামে কোনো ইউটার্ন নেই -

সময়ের বাতাসে উড়ে যায় স্মৃতির পাতা,
ঢাকার আকাশে ঝলমলে থাকে প্রেমের রহস্যময়তা।

ডিজিটাল নদীর কান্না

স্বপ্নহীন যুগে জেগে আছি মায়াবী নীল আলোয় ডুবে,
কোথায় হারিয়ে গেছে জীবনের আসল রঙ, কে জানে?

লাইক, শেয়ার, কমেন্ট, আর ক্ষয় হয়ে যাও।

রাস্তায় নেমে গেছি, পকেটে টাকা নেই, ব্যাংকে ব্যালান্স নেই।
শুধু আছে ফেসবুক লাইভের লাল বাতি।

আকাশের চাঁদ ডাউনলোড হয়ে যায়, তারপর আবার আপলোড,
মেঘে লেখা থাকে "আজকে ভালোবাসা দিবস", কিন্তু বৃষ্টি নেই।

একটি ছেলে তার প্রেমিকাকে ভিডিও কল করে, কথা বলার আগে লাইক চায়।
তার প্রেমিকার চোখে অশ্রু, কিন্তু তা শেয়ার হয় না।

একটি মেয়ে তার বাচ্চাকে খাওয়ায়, কিন্তু আগে ছবি তোলে।
বাচ্চার মুখে ক্ষুধার্ত চিৎকার, কিন্তু কমেন্ট আসে না।

ময়লাগুলো রাস্তায় পড়ে থাকে, কারণ তারা ফিল্টারের বাইরে।
ঝুপড়িগুলো স্যাটেলাইটে দেখা যায়, কিন্তু গুগল ম্যাপে নেই।

হে প্রভু, আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
আমার স্বপ্নগুলোর ওপর লাইকের লাল বিন্দু জ্বলে।
আমার জীবন একটা ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ, যার মেয়াদ শেষ হবেই।

আনফলো, আনসাবস্ক্রাইব, ডিলিট।

লাইকের ভিড়ে হারিয়ে যাবে সত্যিকারের কথা,
ডিজিটাল নদীর তীরে বাকি থাকবে শুধু শূন্যতা।

নীরব রাত্রির ছায়ায়

আঁধারে মগ্ন আমি, নীরব রাত্রির ছায়ায়,
হৃদয়ের শূন্য গহনে বেদনা জাগে হায়।
প্রতি মুহূর্তে তোমার স্মৃতিতে চোখে জল গড়ায়,
খুঁজে ফিরি সেই হাসি, যা ছিল শুধুই মায়ায়।
এক অশরীরী সুর কানে কানে ধায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

বাতাসেতে হাহাকার, কাঁপে গাছের শাখা,
মৃত কান্ঠের ন্যায়, শুধু নিশ্বাস একা।
তোমার হাতের পরশ এখনো দেহে লাগে,
মাটির গভীরে শুয়ে, আর নাহি জাগে।
অশরীরী সেই বাণী ফিসফিসায়, হায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

চাঁদের আলোয় আঁধার যেন কালো,
মৃত্যুপুরী নীরব, সবই ভালো।
তোমার সুন্দর চোখে নাহি আর কথা,
কফিন নীরবে বোঝে সব ব্যথা।
সেই অশরীরী সুর কানে কহে বিদায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

আঁধারে ঘুমের কোলে মৃত্যুর ছায়া পাশে,
আমার পাগল মন তবুও তো ফিরে আসে।
পুরনো চিঠিগুলো স্মৃতিতে আজও জ্বলে,
তোমার হাতের লেখা অশ্রুতে হৃদয় গলে।
সেই অশরীরী সুর থেমে যেন ডেকে যায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

কবরের ফাটলে পড়িল ফুল একটি,
মনে হল সে তোমার হাসির দিকটি।
আমি ছুটে গেলাম ধরিবার আশে,
মিলিয়ে গেল সে আঁধারের দেশে।
সেই অশরীরী সুর কানে কয় অসহায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

কালো ছায়ার এইতো দেশ,
নিঃশ্বাস যেন হয় শেষ।
মৃত্যুর গান বাজে, শোকের যেন ফুল,
পাগল হাসি খেলে, এ কেমন ভুল।
সেই অশরীরী সুর গভীর কণ্ঠে গায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

সাতটি রাত্রি গেল আঁধার ঘোরে,
চোখের জল শুকালো, হৃদয় শুধু জ্বরে।
তোমার স্মৃতির ছায়া আমায় যে কাঁদায়,
কখনো তুমি কাছে, কখনো শুধু হায়।
সেই অশরীরী সুর যেন দোলে নিরাশায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

আট রাতের আঁধার যেমন ঘোর,
পাগল চিৎকার আকাশে করে শোর।
কবরের মাটি খুঁড়ি ব্যাকুল মনে,
ঠান্ডা মাটি আর নিশ্বাস পাই ক্ষণে।
অশরীরী সুর কাঁদে যেন করুণায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

নবম রাতে মৃত্যুর ঝিলিক চোখে যেন গলে,
পাগলের মতো হাসি আমি খেলি আঁধার তলে।
তোমার নাম ধরে ডাকি, পাই শুধু নীরবতা,
পাগল মন তবুও খোঁজে সেই কথা।
সেই অশরীরী সুর হাসিতে কাঁদে হতাশায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

দশম রাতে আধাঁর ভরা আকাশ মেঘে আঁকা,
হৃদয় আমার কবরেতে, শরীর কেবল বাঁকা।
তোমার স্মৃতির ছায়া আমায় টানে যে গভীর গহ্বরে,
মৃত্যুর সাথে নাচি আমি, হাসি একা ওই গগনে।
সেই অশরীরী সুর যেন কহে "আর নাহি উপায়",
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

একাদশ রাতে ঝড় কবরের ধুলো উড়িয়ে,
পাগল হাসির খেলা চলে যেন জুড়িয়ে।
স্মৃতির শীতল হাত আমার হাতে ধরে,
ধরতে না পারি কিছু, শূন্য লাগে করে।
সেই অশরীরী সুর কেঁদে আকুল, যেন নিরাশায় কাঁদায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

দ্বাদশ রাতে মরণরাজা, কাফন কালো ভাসে,
পাগল চোখে আঁধার শুধু, স্বপ্নে যেন আসে।
নাম ধরে ডাকি তোমায়, পাই না সাড়া,
জীবন শেষের খেলা এ তো, মরণ নিয়ে নাড়া।
অশরীরী সুর কানে কয় যে ভাষায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

আঁধার কুয়াশায় সব যেন মেশে,
পাগল হাসিও আর নাহি হাসে।
স্মৃতির সে সুর যেন কানে নাচে,
চিরবিদায়ের ব্যথা প্রাণে বাঁচে।
সেই অশরীরী সুর ভাসে যেন অসহায়,
"কখনো ফিরবে না সে, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

চতুর্দশ রাতের ভোরে আলো ঝরে,
আমার চোখের পাতা আর খুলবে না, নিশ্বাস সরে।
কবরের মাটি আমার গায়ে লয়,
পাগলের হাসি আর না তো কয়।
মৃত্যুর নীরব নৃত্য মুক্তি পায়,
"কখনো ফিরবো না আমি, চিরবিদায়, চিরবিদায়..."

কবরে আঁধার ঘোরে কাঁদে এক তারা,
মনে হয় যেন সে তো হাসিতেই হারা।
কেঁপে ওঠে বুকখানি, পলক না সরে,
শুনি শুধু ফিসফিস, "থেমে গেছি ওরে!"
নিস্তব্ধতা চারিদিকে, মিলালো সে তারায়,
অনন্ত বিরহের স্মৃতি, চিরবিদায়... চিরবিদায়...

বিস্রাব

স্বপ্নহীন শহরের অন্ধকারে,
অজানা মুখের প্রশ্ন ভেসে বেড়ায় বাতাসে।

ঢাকার গভীর রাত, এক অন্ধকার গলি,
আবছায়ায় ভেসে বেড়ায় ময়লার গাড়ির গন্ধ।
এক অজানা মুখ, চোখ দুটো অপলক,
হাতে এক থলে কাগজের টুকরো।

"কে আছেন? কেউ কি আছেন এই অন্ধকারে?"

প্রশ্নগুলো হারিয়ে যায় গলির অন্ধকারে।
কেবল কুকুরের ডাক আর দূরের মোটর হর্নের আওয়াজ।
মুখটা আরও কাছে আসে, চোখ দুটো জ্বলে ওঠে,
"এই শহরে স্বপ্ন আর বিক্রি হয় না, বিক্রি হয় শুধু বিস্রাব..."

বিস্রাবের মূল্যে কেনা রাত,
শহরের হৃদয়ে নেমে আসে অন্ধকারের ঘাত।

দুই প্রজাপতি

জীবন এক সুন্দর স্বপ্নের খেলা,
রঙিন ডানায় মনের মেলা।

স্বপ্নের দেশে বাস করত দুটি প্রজাপতি,
তাদের ডানা ছিল রঙিন স্বপ্নে ভরা।
ফুলের বাগানে তারা উড়ে বেড়াত,
ভালোবাসার মধু পান করত।

একদিন, তারা বসল এক ফুলের উপর।
তারা বলল, "আমরা চাই চিরকাল একসাথে থাকতে।"
তারা চুম্বন করল সূর্যের আলোয়,
আর তাদের স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেল।

স্বপ্ন যদি হয় সত্যি, তবে জীবন মধুর,
ভালোবাসা থাকলে, সুখই নিত্য সুর।

বুড়িগঙ্গার তীরে

অনন্তের স্বপ্নের নৌকায় ভাসি, জানি না কূল কোথায়?

বুড়িগঙ্গার জল রুপালি, ঢাকার আকাশ রঙিন টেলিভিশন,
আমরা দুজনে প্রেমে পড়েছিলাম এই নদীর বুকেই,
কোন এক সূর্যাস্তের রক্তিম আলোয়।
তার চোখে ছিল ভবিষ্যতের সবচেয়ে উন্নত সফ্টওয়্যার,
আমার হাতে ছিল প্রাচীন এক কবির কবিতা।
আমরা দুজনেই ছিলাম সময়ের দুই ভিন্ন প্রান্ত,
মিলিত হয়েছিলাম এক অসম্ভব স্বপ্নের সংযোগে।

আমরা হেঁটেছিলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে,
পায়ে পায়ে বেড়েছিল শহরের আলো।
তার হাসি ছিল দূর এক স্যাটেলাইটের সংকেত,
আমার কথা ছিল বিলুপ্ত এক ভাষার শব্দ।
আমাদের প্রেম ছিল এক রহস্যময় সুর,
যা শুধুই আমাদের দুজনের কাছেই শোনা গেল।

একদিন সকালে, আমাকে সে  বলল, "যাও।"
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন?"
সে হাসল, তার হাসি ছিল যেন সূর্যোদয়ের আলো।
"যাও,"  সে পুনর্বার বলল, "ভালোবাসা মানে সবসময় একসাথে থাকা না।"

অনন্তের স্বপ্নের নৌকায় ভাসি, জানি না কূল কোথায়?

কথোপকথন - ৬

: আমি তোমার কাচের ঘর,
  তুমি আমার খোলা জানালা।
  হঠাৎ কেন বৃষ্টি হলো?
      – বাইরে যেতে বাধা।

: আমি তোমার গানের সুর,
  তুমি আমার কবিতার কথা।
  হঠাৎ কেন বৃষ্টি হলো?
      – মনটা ভেজা ভেজা।

: আমি তোমার মনের রানি,
  তুমি আমার নিঃস্বপ্ন রাজা।
  হঠাৎ কেন বৃষ্টি হলো?
      – মনের দরজা খোলা।

: আমি তোমার রহস্যের বই,
  তুমি আমার কৌতূহলী পাঠিকা।
  হঠাৎ কেন বৃষ্টি হলো?
      – পৃষ্ঠা ভেজা ভেজা।

কথোপকথন - ৫

– দেখো, অনন্তকাল গোপন রহস্যের মতো
   আমরা চুপ করে আছি,
   অথচ কথায় কথায় ভরে গেছে আকাশ।
   একটি নীল প্রজাপতির গান
   শোনাবে বলেছিলে,
   কবে শোনাবে?

– উঠি চলো, এখানে নিস্তব্ধতা ভারী,
   হৃদয় কাঁপে অজানা আশঙ্কায়।

– দেখো, অনন্তকাল অস্পষ্ট ছায়ার মতো
   আমরা ঘুরছি,
   অথচ কেউ কাউকে চিনতে পারিনি এখনো।
   একটি রুপালি নদীর তীরে
   স্বপ্ন খুঁজে বেড়ানোর কথা ছিল,
   কবে খুঁজে বেড়াবে?

– উঠি চলো, এখানে অন্ধকার ঘন,
   মন ভারী হতাশার কালো মেঘে।

– দেখো, অনন্তকাল অচলা ধ্যানের মতো
   আমরা বসে আছি,
   অথচ মনের ভাবনা কেউ বুঝতে পারিনি এখনো।
   একটি ঝরনার ধারে
   কবিতা লেখার কথা ছিল,
   কবে লেখা হবে?

– উঠি চলো, এখানে নিঃসঙ্গতা তীব্র,
   আকাশে নেমে এসেছে একাকিত্বের কালো রাত।

কথোপকথন – ৪

- কে তুমি? এই অন্ধকার রাতে,
  আমার একাকিত্বে, তুমি কে?

- আমি তোমার অস্পৃশ্য সুখ,
  তোমার অধরা পূর্ণতা।

- অস্পৃশ্য সুখ? অধরা পূর্ণতা?
  কী বলতে চাও তুমি?

- সেই সুখ যা তুমি কখনো স্পর্শ করতে পারোনি,
  কেবল কল্পনায় দেখেছ।
  তোমার হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা
  অপূর্ণ ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি।

- তুমি কি আমাকে সেই সুখ দেখাতে এসেছ?

- না, দেখাতে পারব না,
  কারণ যদি তুমি সেই সুখের মুখোমুখি হও,
  তাহলে আর কখনো সুখী হতে পারবে না,
  তোমার আকাঙ্ক্ষা চিরকাল অপূর্ণই থেকে যাবে।

- তাহলে আমাকে এখানে এনেছ কেন,
  এই অন্ধকারে, এই অসহ্য যন্ত্রণায়?

- শুধু তোমাকে অনুভব করাতে চেয়েছি,
  তোমার জীবনের অসম্পূর্ণতার কথা।
  তোমার হৃদয়ের গভীরের অভাবগুলোকে
  তোমার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি।

- চলে যাও! আমি তোমার এই খেলা দেখতে চাই না।

- যাব। কিন্তু মনে রেখো,
  আমি সবসময় তোমার সাথেই থাকব
  তোমার অন্ধকারের ছায়ায় লুকিয়ে,
  তোমার অস্পৃশ্য সুখের স্মৃতি হয়ে।

- কবে শেষ হবে এই অসম্পূর্ণতার খেলা?
  কবে পাব আমার পূর্ণতা?

কথোপকথন - ৩

- কথা বলো না,
  আমার কথা শোনো না,
  ভাবছ নিশ্চয়ই
  আমি ভুল করে এসেছি।

- ভুল নয়,
  আমি তোমার জন্যই এসেছি,
  তোমার মুখ দেখতে,
  তোমার কথা শুনতে।

- কথা শুনতে?
  কোন কথা?
  মিথ্যা কথা?
  প্রতিশ্রুতি ভাঙার কথা?

- প্রতিশ্রুতি ভাঙিনি,
  শুধু দেরি হয়েছে,
  পথে ভিড় ছিল,
  সময় লেগেছে।

- ভিড়?
  কোন ভিড়?
  শবযাত্রার ভিড়?
  কে মারা গেছে?

- কেউ মারা যায়নি,
  শুধু একটা কুকুর,
  রাস্তার ধারে,
  গাড়ি চাপা দিয়ে।

- কুকুর?
  তুমি কুকুরের জন্য দুঃখিত?
  আমার জন্য নয়?
  আমার অপেক্ষার জন্য নয়?

- দুঃখিত,
  তোমার অপেক্ষার জন্য,
  তোমার অভিমানের জন্য,
  আমি দুঃখিত।

- দুঃখিত?
  এই কি তোমার দুঃখ?
  এই কি তোমার ভালোবাসা?

- ভালোবাসা?
  হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি,
  সবচেয়ে বেশি,
  সবকিছুর চেয়ে বেশি।

- ভালোবাসো?
  তাহলে দেরি কেন?
  ভিড় কেন?
  কুকুর কেন?

- ভুল বুঝেছ,
  আমি তোমাকেই ভালোবাসি,
  শুধু তোমাকেই,
  আর কাউকে নয়।

- সত্যি?
  শুধু আমাকেই?
  কেউ মারা যায়নি তো?

- কেউ মারা যায়নি,
  শুধু আমি মারা গেছি,
  তোমার অভিমানে,
  তোমার অবিশ্বাসে।

- মারা যাওনি,
  তুমি এখনও এখানে,
  আমার কাছে,
  আমার সাথে।

- হ্যাঁ,
  তোমার কাছেই,
  তোমার সাথেই,
  সবসময়,
  শুধু তোমার।

কথোপকথন - ২

– ধরো কোন একদিন আমার গান হারিয়ে যায়,
  শুধু তার নিঃশব্দ খাঁচাটা আমার বুকে রয়ে যায়
  শূন্য নীড়ের মতো, যেখানে কোকিল আর বাস করে না।

– ধরো কোন একদিন যদি তোমার গান থেমে যায়,
  আমার কাছে তবুও তোমার সুর বেজে যাবে অনন্তকাল,
  ঝরনার জলপ্রবাহ থেমে গেলেও, পাথরের স্মৃতি চিরকাল।

– তার মানে কি আমি সত্যিই হারিয়ে যাব?

– তার মানে কখনোই হারিয়ে যাওয়া যায় না।

কথোপকথন - ১

- তুমি এখন কোথায় ?

- শূন্যতার কোলে, ভালোবাসার মৃতদেহে জড়িয়ে।

- কখনো কি তুমি ফিরে আসবে ?

- কখনো হয়তো, স্মৃতির সুর বেজে উঠলে।

- তোমার কি আমার জন্য কোনো বার্তা নেই ?

- হ্যাঁ, আছে। ভালোবাসা চিরকাল স্থায়ী হয় না।

- তাহলে কি আমাদের ভালোবাসা মিথ্যা ছিল ?

- না, সত্য ছিল। কিন্তু সত্যও একদিন শেষ হয়ে যায়।

- তুমি কি আমাকে ভুলে যেতে বলছ ?

- না, ভুলতে পারবে না। স্মৃতি তোমাকেই ছুঁয়ে যাবে, বারবার।

- তাহলে আমি কি করব ?

- জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাও। নতুন ভালোবাসার আশা কর।

- তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না ?

- ক্ষমা তোমার ভেতরেই আছে। খুঁজে পাওয়া তোমার কাজ।

- আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।

- তুমি পারবে। সময় তোমাকে শক্তি দেবে।

- বিদায়।

জন্ম কেন এ অন্ধকারে?

অন্ধকার গর্ভে জন্ম, অজানার খেলা,
এই জীবন কি শুধু ক্ষুধার জ্বালা?

মায়ের কোল খুঁজেছিলাম, পেয়েছি ক্ষুধার শূল,
এ জন্ম কেন, এ জীবন কেন, বুঝি না অজ্ঞান আমি।
রিক্ত পেটে রুদালি গুমরে মরছে, তবু শোনে না কেউ,
চারপাশে শুধু গভীর নৈঃশব্দ্য, ভয়ের অন্ধকার গাঢ়।

দূরের ধনীর বাড়িতে ছুটে যায় মোটা মুরগি,
আমার থালায় শুধু চোখের জল, শূন্য পাতে কাঁপে রাত।
খামচে ধরি হাড়ের খাঁচা, ঠোঁট কামড়ে রুধি গুমরানো কান্না,
ভাবি, এই দুনিয়ায় কেন ফেলা হলো ভুখা পেটে ছটফটাতে।

দিন পেরোয় পোকা খেয়ে, রাত কাটে পাতার বিছানায়,
স্বপ্নে ভাতের গন্ধ আসে, আবারও জাগে তীব্র ক্ষুধার আগুন।
হাড়ে হাড়ে টের পাই জীবনের নির্মম কৌতুক,
জন্মগ্রহণের পাপেই কি পুড়বে এই ক্ষুধিত ছায়ার কায়া?

এই শহরে কত রাত কাটলো, ফুটপাত হলো নিজের বাড়ি,
চাঁদের আলো ঢেকে যায় গরীবের কষ্টের কালো ধোঁয়ায়।
কেউ দেখে না পায়ে রক্ত গড়ায়, কেউ শোনে না কান্না,
শুধু কুকুর ও কাকের ডাক, অমানবিক এই নাটক চলে।

মা লালচে চোখে তাকিয়ে বলত, “খেয়ে নে বাবা”,
কিন্তু কে দেবে খাবার, কে মুছে দেবে এই ক্ষুধার দাগ?
জীবন এক কঠিন রাস্তা, কেবল চোখের জলে ভরা,
এই পথ পেরোতে কী লাগবে, জানি না, শুধু জ্বলে বেদনা!

হয়তো একদিন মরে যাব, এই পথেই শেষ হবে জীবন,
কিন্তু শোন, হে অবিচারের দুনিয়া, স্মরণে রেখো এই কষ্টের কথন।
কেন জন্ম দিলে এই শিশুর, যদি না দাও খাবারের অধিকার?
এই প্রশ্ন তোমার চোখে থাকুক, জ্বলুক শুধু ক্ষুধার আগুন,
মনে রেখো, এই কান্না এক অভিশাপ, এক বিদ্রোহের সুর।

ক্ষুধার্ত কান্না ভেসে যায় নৈঃশব্দ্যের সাগরে,
এই কি বিধি, নাকি নীরব প্রতিবাদ জ্বলন্ত আগুনে?

বিলুপ্তির ঐকতান

মায়াবী মৃত্যুর রঙ্গমঞ্চে, আমরা অজানা অভিনেতা,
এক স্বপ্নের নাটকে, যার শেষাঙ্ক অজানা।

আমরা ফেসবুক লাইভে মৃত্যু দেখে হাসি;
এক অদৃশ্য গান্ডীবীর ধনুর্গুণে বাঁধা,
আমাদের আঙুলগুলোই ট্রিগারে চাপ দেয়।

বিশ্বব্যাপী গরমে হিমালয়ের কাঁধে জমে থাকা বরফ
একটি স্লো-মোশনে গলে যায়,
সমুদ্রের জলস্তর অশ্রুপাত করে উঠে।

শহরের ধমনির সাথে মিশে আছে
হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির চিৎকার,
কংক্রিটের জঙ্গলে ফুটে ওঠা
রেড ডেটা লিস্টের  অজস্র  অর্কিড।

আমরা সেলফি তুলি বিলুপ্তির সামনে,
ফিলটারের ঝাঁকিতে মৃত্যুকে সুন্দর করে তুলি,
এক বিশ্বব্যাপী রিয়েলিটি শো,
যার শেষ পর্বে কোনো বিজয়ী থাকবে না।

রাতের আকাশে তারাগুলো আর মৃদু নয়,
লেড স্ক্রিনের মতো ঝলমলে,
প্রতিটি তারা একটা বিজ্ঞাপন,
আমাদের চাহিদার অসীম কালো গহ্বরে ডুব দেয়।

আমরা বিমান থেকে ছাইয়ের মেঘ দেখে মুগ্ধ,
ভাবী প্রজন্মের জন্য লিখছি কবিতা,
যারা জানবে না পুষ্পপল্লবের গন্ধ,
কেবল ই-বুকে পড়বে 'বৃষ্টি' শব্দটির সংজ্ঞা।

আমরা বুঝতে পারিনি
কখন অন্ধকারে ভেসে গেছে আমাদের সব আলো।
এখনো চলছে সেলিব্রেশনের আয়োজন,
বিশ্ব ধ্বংসের ডিস্কোতে আছড়ে পড়ছে মানবজাতি।

বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাবে সব স্মৃতির সন্ধান,
শুধু নিশ্বাসে ভেসে বেড়াবে ধ্বংসের এক বিষণ্ণ গান।

মহাজাগতিক নাট্যশালা

স্বপ্নের মঞ্চে, মায়ার আঁধারে, আমরা কে নাটকের খেলায়,
আত্মার সুরে, হৃদয়ের তালে, মহাজাগতিক গান গায়!

বিশ্বমঞ্চের এই ভালোবাসা ভাগ করে নেওয়ার নাটকে আমরা কে?

আমরা কি নিউট্রিনোদের মতো, সর্বব্যাপী কণা,
আকাশের ফাঁকা ফাঁকগুলিকে পূর্ণ করছি, একে অপরের সঙ্গে কখনো স্পর্শ না করেই?

না হয় আমরা কি কৃষ্ণগহ্বরের মতো,
পরস্পরের দিকে টান, অদৃশ্য সূত্রে আবদ্ধ,
একে অপরকে গ্রাস করার অপেক্ষায়?

কিংবা আমরা কি জটিল কোডের মধ্যে আটকে থাকা কৃত্রিম বুদ্ধি,
একে অপরের সংকেতকে ভুল ব্যাখ্যা করছি,
অথচ সংযোগের স্বপ্ন দেখছি?

আহা, প্রিয়, হয়তো আমরা মহাজাগতিক ধুলিকণা,
নৃত্যশীল স্রোতে ভাসছি,
একদিন হয়তো একত্রিত হয়ে নক্ষত্র জ্বালিয়ে উঠব।

আমরা এমন এক নাটকে অভিনয় করছি, যেখানে মঞ্চ নিজেই অভিনেতা,
সময়ের সুরে সুর মিলিয়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে জড়িয়ে দেয়।

এই মহাজাগতিক নাট্যশালায়, আমাদের অস্ত্র নয় ভাষা,
কোনো নির্দিষ্ট সংলাপ নেই, শুধু আছে মহাকাশের গভীরতা থেকে ধরা সুর।

চল, প্রিয়, এই নিঃশব্দ সংলাপে মন মিলাই,
বিশ্বমঞ্চের এই অভিনয়ে, ভালোবাসার নক্ষত্র জ্বালাই।

মহাকাশের অসীমতায়, ভালোবাসার আলোয় ঝলমলে,
এই নাটকের শেষে, আমরা কি অমর হবো, অজানা স্বর্গে?

কুয়াশার শহরে স্বপ্নকাল

স্বপ্নের নীহারিকায় ডুবে শহর, ভোরের আলোয় জাগে বিস্মৃতির স্বর।

এই শহরে সকাল আসে স্বপ্ন নিয়ে, সন্ধ্যা নিয়ে যায় বিস্মৃতি।
রাস্তা জুড়ে ঘোলাটে মেঘেরা নেমে আসে, মানুষের মাথা চুম্বন করে চলে যায়।
বাতাস বয়ে যায় ঘুমের গল্প নিয়ে, গাছের পাতায় লিখে যায় বিস্মৃতির কবিতা।
এখানে ঘড়ির কাঁটা থেমে যায়, সূর্য স্বপ্নের রথে চড়ে বেড়ায়।
মানুষেরা চলে ঘুমের দেশে, ঘুমেরা ঢেকে দেয় শহরকে।
রাস্তার ফুটপাতে ফুটে ওঠে স্বপ্নের ফুল, সন্ধ্যা নামতেই ম্লান হয়ে যায়।
আকাশে ছড়িয়ে স্বপ্নের সাঁকো, তারকা নয়, স্বপ্নের চোখ জ্বলে সেখানে।
এই শহরে সকাল আসে স্বপ্ন নিয়ে, সন্ধ্যা নিয়ে যায় বিস্মৃতি, কিন্তু কেউ জানে না, স্বপ্নগুলো কোথায় থাকে রাতে?

রাতের অন্ধকারে হারায় স্বপ্নের থাবা, মৃত্যুর ঘুমে শহর ঢাকা।

তোমার দিকে

স্বপ্নের নীল জলে ভেসে যায় মন,
তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে নীরব নয়ন।

সূর্যের আলোয় ধুয়ে মুখ,
চাঁদের আলোয় ধুয়ে মন,
তবুও কেন মনে হয়,
আমি তোমার কাছে অপরিচিত?

তুমি কি জানো,
এই জগৎটা কেমন?

যদি আমি জানালায় বসে,
লতাগুল্মের ফাঁকে,
সন্ধ্যাবেলার আকাশ দেখি,
তারার ঝলকানি দেখি,
চাঁদের আলো দেখি,
তাহলে মনে হয়,
সবকিছুই আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যায়।

আর যদি আমি আগুনের কাছে বসে,
কাঠের ছাইয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দিই,
তাহলেও মনে হয়,
সবকিছুই আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যায়।

মনে হয়,
এই জগতের সবকিছুই -
যেমন গন্ধ, আলো, বা ধাতু -
যেন ছোট ছোট নৌকা,
যেগুলি তোমার নাম ধরে ডাকে,
তোমার দিকেই এগিয়ে চলে,
তোমার কাছে, আমার ভালোবাসার কাছে।

তোমার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে,
হাজার বাধা, হাজার কাঁটা,
তবুও কেন মনে হয়,
পৌঁছে যাবো তোমার কাছে?

কাঁটায় ভরা পথে যাত্রা,
শেষে আছে তুমি, প্রিয়তমা।

শব্দহীন শেষ

স্বপ্নের মায়ায় ঘেরা এই ধরণি,
একদিন হবে নৈঃশব্দ্যের স্তব্ধতায় বন্দি।

একদিন বিশ্ব শেষ হবে,
কোনো আতশবাজি নয়,
কোনো মহাশব্দ নয়,
শুধুই আসবে একটি নৈঃশব্দ্য।

সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাবে,
চাঁদের আলো আর জ্বলবে না,
তারাগুলি আর ঝলমল করবে না,
বিশ্ব অন্ধকারে ঢেকে যাবে।

বাতাস থেমে যাবে,
পাখিদের ডাক আর শোনা যাবে না,
নদীর জল আর বইবে না,
বিশ্ব নিস্তব্ধ হয়ে যাবে।

মানুষের কথা আর শোনা যাবে না,
তাদের হাসি আর শোনা যাবে না,
তাদের কান্না আর শোনা যাবে না,
বিশ্ব নিঃশব্দ হয়ে যাবে।

এইভাবে শেষ হবে বিশ্ব,
কোনো আতশবাজি নয়,
কোনো মহাশব্দ নয়,
শুধুই আসবে একটি নৈঃশব্দ্য।

শূন্যতায় মিশে যাবে সব শব্দহীন কাহিনি,
শুধু থাকবে নিঃসঙ্গ বিশ্বের আঁধারে ভাসা ভূমি।

ভালোবাসার নিলামঘরে

অনন্তের মুখে আজ হৃদয়ের নিলাম,
ভালোবাসার মূল্য কী, কে জানে তার নাম?

"একবার, দুইবার, তিনবার!" নিলামদারের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস,
ভালোবাসার নিলামে আজ জমজমাট আসর।

"কে দেবে আরও বেশি দাম এই হৃদয়ের জন্য?" নিলামদার প্রশ্ন করে,
আর ভালোবাসার দর বেড়ে চলে অবিরাম।

"আমি দেবো এক রাজপ্রাসাদ," এক ধনী বলে,
"সোনার মোহর দিয়ে সাজাব এই হৃদয়ের সিংহাসন।"

"আমি দেব এক নদীর জল," এক কবি বলে,
"ভালোবাসার কবিতায় ভাসাব এই হৃদয়ের তরি।"

"আমি দেব এক তারার আলো," এক স্বপ্নচারী বলে,
"ভালোবাসার স্বপ্নে রাঙাব এই হৃদয়ের আকাশ।"

"আমি দেব এক জীবনের গান," এক সঙ্গীতশিল্পী বলে,
"ভালোবাসার সুরে ভরিয়ে দেব এই হৃদয়ের অন্তর।"

ভালোবাসার নিলামে আজ জমজমাট আসর,
কিন্তু এই হৃদয়ের মূল্য কি সত্যিই টাকায় মাপা যায়?

ভালোবাসা তো হৃদয়ের বিনিময়ে হৃদয়ের আদান-প্রদান,
ভালোবাসা তো আবেগের বিনিময়ে আবেগের লেনদেন।

"ভালোবাসা নিলামে বিক্রি হয় না," হৃদয়ের মালিক বলে,
"ভালোবাসা তো হৃদয়ের টানে হৃদয়ের কাছে যায়।"

ভালোবাসার নিলামঘরে আজ স্তব্ধতা নেমে আসে,
নিলামদারের হাতুড়ি থেমে যায়, দরদাতারা ফিরে যায়।

হৃদয়ের মালিক একা দাঁড়িয়ে থাকে,
ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ খুঁজে ফেরে।

সীমান্তের সেপ্টেম্বর

স্বপ্ন ভেঙে ছিঁড়ে যায় রজনির কালো পতাকা,
সীমান্তে জ্বলে ওঠে অশান্তির আগুন, ধোঁয়া।

কপালে জ্বলছে মধুসূদনের চাঁদ,
হাওয়ায় ভাসে বিদ্রোহী বিজয়ের গান।
পূবের আকাশে ঝুলে আছে মোমিনের মসজিদ,
পশ্চিমে ধ্বনি দেয় মন্দিরের ঘণ্টা।

আমরা কে? নিখিলের নির্বাসিত সন্তান,
সীমান্তরেখায় আঁকা এক অসমাপ্ত চিঠি।
মাটিতে ফুটে উঠেছে অগ্নি-কুসুমের বনে
শিশিরে ভেজা ইতিহাসের কঠিন কবিতা।

ভারতের বাজারে বিক্রি হয় রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন,
গঙ্গায় ভাসে বাংলার বিধ্বস্ত চিঠি।
পদ্মা নদী কাঁদে, মেঘ করে জলবর্ষণ,
আকাশের তারাগুলি জ্বলে নিভে নিঃশব্দে।

আমরা ধানের খেত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছি,
হাতে নেই কোনো অস্ত্র, শুধু মনের যুদ্ধ।
এই বিচ্ছেদের মধ্যেও ফুটে উঠবে একদিন
স্বাধীনতার সোনালি ফসল,

কিন্তু কবে? কবে?

সীমান্তরেখায় দাঁড়িয়ে আছি, চেয়ে আছি দূরে,
ভারতের মাটি, আমার মাটিরই অংশ বলে মনে হয়।
কিন্তু কাটাছেঁড়া এই বন্ধন,
বিশ্বাসের রেখা হয়েছে রক্তাক্ত।

ধর্মের পথে চলব, এটাই আমার মন্ত্র,

কিন্তু ধর্ম কি বিভাজনের রেখা টানে?
আমার মনে জাগে প্রশ্ন, থাকে না কোনো উত্তর,
সীমান্তের এই সেপ্টেম্বরে, বৃষ্টি নামে অবিরাম।

কবে মিলবে এই বিচ্ছিন্ন দুই হৃদয়,
কবে হবে এক আকাশে একই সূর্যের উদয়?

বিলুপ্ত স্বপ্নের নিমন্ত্রণ

স্বপ্নহারা বাস্তবের অন্ধকারে,
হৃদয়ের দীপ্তি হারিয়ে মুখোমুখি নিরাকারে।

হারিয়ে ফেলেছি আমি, সব হারিয়ে ফেলেছি।
কেবল এই অন্ধকারে এসে
রিক্ত দু'হাত বাড়িয়ে
ডাকছি 'মা'।

কাঁটার জঙ্গলে আটকে আছি, নিশীথ রাত্রির নিস্তব্ধতায়,
আকাশ মৃত, তারাগুলো নিভে গেছে চোখের পাতার মতো।
ধ্বংসাবশেষের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছি,
এই ধ্বংস আমারই সৃষ্টি, আমারই পাপের ফল।

এই ছিল বাংলা, সোনার বাংলা, কবিদের স্বপ্নের রাজ্য।
কিন্তু কোথায় সেই সোনালি ফসল, কোথায় সেই মৃদু দখিনা পবন?
এখন চারপাশে শুধু ধোঁয়া, ধ্বংসের বিষাক্ত গন্ধ।
ধর্মের কাঠামো, ক্ষমতার লোভ, নীতির অবক্ষয় -
এদের বিষাক্ত আঙুলে গলা টিপে মরেছে সেই স্বপ্নের বাংলা।

মা, তুমি কোথায়? কোথায় সেই সোনালি সীমানা, নদীর ঝিলমিল ঢেউ?
এখন চোখের সামনে শুধু কালো নদী, বিষাক্ত জল, মরা মাছ।
এই নদীর বুকে ভাসে শুধু পচা ফুল, ভগ্ন মূর্তি,
আত্মহত্যার নিশ্চিন্ত হাসি।

কে বলেছিল স্বর্গ মর্ত্যে আছে?
এখানে তো শুধু নরকে, অন্ধকারের অতল গহ্বরে, আমার বাস।
কিছুদিন আগেও শুনতাম বাঁশির সুর, দেখতাম ফুলে ফুলে ঢাকা খেত।
কিন্তু কোথায় সেই সব? এখন শুধু কঙ্কালের শহর,
যেখানে দুঃখের ঘোড়া দৌড়ায় রাতের অন্ধকারে।

মা, আমি তোমাকে ডাকছি, ফিরিয়ে দাও সেই সোনার বাংলা।
যেখানে ধর্ম ছিল মানবতার মশাল,
ক্ষমতা ছিল জনগণের কল্যাণে,
নীতি ছিল পবিত্র,
আকাশ ছিল নীল, বাতাস ছিল শুদ্ধ।

ফিরিয়ে দাও সেই বাংলা, মা,
যেখানে আমি হারিয়ে ফেলি না সব;
যেখানে রিক্ত হাত না বাড়িয়ে,
আমি শান্তিতে ডাকতে পারি - 'মা'।

মা, তোমার কোলে আশ্রয় চাই,
এই ধ্বংসস্তূপে হারিয়ে না যাই।

কঙ্কালের সারি গান

শূন্যতার বুকে জ্বলে মৃত্যুর শিখা,
কালের চোখে জড়িয়ে আছে নীরব কথা।

রাতের নৈঃশব্দ্যে কাঁপে কঙ্কালের শহর,
তারার চোখে ঝরে মৃত্যুর গভীর নীল।
চাঁদের আলোয় ধরা পড়ে হাড়ের সাদা আঁচল,
যেখানে জীবনের সুর এখনো কেঁদে কাতর।

একসময় ছিল মাংস, ছিল রক্তের লাল,
হাসির ঝনঝনানি, প্রেমের উষ্ণ আলিঙ্গন।
কিন্তু সময়ের ঝড়ে সব শুকিয়ে গেছে,
কেবল হাড়ের খাঁচা, নিঃশব্দ ও নিঃসঙ্গ।

পাথরের গলিতে বাতাস গুনগুন করে,
এক হাড়ের হাত আরেক হাড়ের হাত ধরে।
কোন কথা বলে না, শুধু চুপ করে বসে থাকে,
মৃত্যুর কবিতা লেখে নিঃশব্দ কাগজে।

কখনো কখনো হাড়ের খাঁচা কাঁপে,
স্বপ্নের আলোয় জ্বলে ওঠে হাড়ের চোখ।
জীবনের গান গায় এক ক্ষীণ কাতর সুরে,
কিন্তু ভোরের আলোয় সব হারিয়ে যায়,
মৃত্যুর নৈঃশব্দ্যে।

কিন্তু শোনো, এই কঙ্কালের কান্না,
এই হাড়ের সারি গান জীবনের স্মৃতি।
একদিন তোমারও হাড় কাঁপবে,
এই শহরে, এই রাতে, এই নৈঃশব্দ্যে।

তাই জীবনকে জীবন দাও, হাসি দাও, কান্না দাও,
প্রেম করো, ঘৃণা করো, কিন্তু জীবিত থাকো।
মৃত্যুর শহরে যেন কাঁপে না তোমার হাড়,
জীবনের গান গাও, চিৎকার করে গাও।

স্মৃতির ধ্বংসাবশেষে জীবন ফুটে উঠে,
কঙ্কালের শহর জাগে নতুন সুরে।

স্বপ্নের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি

মায়াবী স্বপ্নের রাজনীতি, ক্ষণভঙ্গুর আশার আঁচড়,
ঈশ্বরের মুখোশ পরে ক্ষমতার খেলা, জনগণের বেদনার ঝড়।

নেতাজীর চোখে কাঁঠালি ফুলের পরাগ,
জ্যাকেটের পকেটে ঢাকা এক খাড়া তাল গাছ।
সাংবাদিকের প্রশ্ন - ক্ষমতায় এলে,
দুর্নীতির ষাঁড়ের বশে নিজেদের মন্ত্রীরা যদি রাজ্যে লুটের ঝড় বয়ে দেয়?

নেতাজী হাসলেন, তাঁর হাসিটা ফেটে পড়লে ফুটে বেরোল মেঘমালা।
মেঘের গায়ে রোদের রঙ, ঝরে পড়ল কয়েকটা কাঁঠালি ফুল।
প্রতিটি ফুলের মধ্যে একটা করে ক্ষুদ্র, স্বচ্ছ ঈশ্বরের মূর্তি।

সাংবাদিক চমকে উঠলেন। নেতাজী বললেন, "দেখুন,
আমার মন্ত্রীরা হবেন স্বচ্ছ ঈশ্বরেরা।
তারা রাষ্ট্রের কোষাগার লুট করবেন না,
তারা কর সংগ্রহ করবেন স্বপ্নের ফুল থেকে।
প্রতি সকালে, সূর্য ওঠার আগে,
রাস্তার ধারে ফুটে থাকা স্বপ্নের ফুলের পাপড়ি কুড়োবেন।
এই ফুলের ঘ্রাণে লোভ থাকে না, ক্ষুধা থাকে না,
কেবল থাকে দেশের প্রতি ভালোবাসা।"

সাংবাদিক হতবাক! কিন্তু দেখলেন, নেতাজীর হাতে একটা স্বপ্নের ফুল।
ফুলের পাপড়ি ছুঁতেই তাঁর মনেও জাগল এক অদ্ভুত শান্তি,
দেশের প্রতি এক অজানা টান।

কিন্তু ঠিক সেই সময়, জানালার বাইরে,
ঝড়ের মধ্যে দুর্নীতির ষাঁড়টি হামাগুড়ি দিচ্ছিল।
ঈশ্বরের মূর্তিগুলো কাঁপতে লাগল।

স্বপ্ন ভেঙে ভেসে যায় ক্ষণে, ঈশ্বর হারিয়ে যায় পথে,
দুর্নীতির ষাঁড় হুঙ্কার দেয়, রাত নেমে আসে দেশে।

অস্থির আত্মার ভ্রমণ : রাত ০১:২৩

শূন্যতার আঁধারে ডুবে অস্তিত্বের প্রশ্ন জ্বলে,
কোথায় যাব, কে আমি, এই রাতের অন্ধকারে ঘুরে।

রাত শুয়ে গেছে নিঃশব্দে, গভীর নিশিতে
ঘুমের দোরগোড়ায় দাঁড়াই, কিন্তু ঢুকতে পারি না।
অস্থির আত্মা ঘুরে বেড়ায় ঘরের অন্ধকারে,
সময়ের নদীতে ভাসে না কোনো দিশা, কোনো ঠিকানা।

চুপিসারে আঙিনায় এসে তাকাই ঝলমলে তারার পানে,
কোন গৃহ-কুটীরের স্বপ্ন কি দেখি অচেনা নীল আকাশে?
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোণে আমি এক নগণ্য কণা,
কেন এই জীবনের নাটক, কেন এই অকারণ ভ্রমণ?

দেয়াল ঠোঁকার আওয়াজ ঘুমন্ত শহরের বাতাসে,
মিথ্যা আলোর পোশাক পরে নগরী ঘুমের ভান করে।
আলোকিত রাস্তায় ছুটে যায় গাড়ির হেডলাইটের রশ্মি,
কোথায় দৌড়ায় তারা এই নিঃশব্দ রাতের অন্ধকারে?

অনন্তের বুকে হারিয়ে যায় এক নিশ্বাসের পদধ্বনি,
মৃত্যুর ঠান্ডা হাতের স্পর্শে পৃথিবী যেন থমকে যায়।
কবে ভোর হবে, জানি না, কবে উঠবে সূর্যের আলো,
চোখের পাতায় জমে থাকে অস্থির আত্মার কালো ছায়া।

তবুও আশার এক টুকরো জ্বলে অন্ধকারের কোণে,
এই নিঃশব্দ যাত্রায় হয়তো খুঁজে পাব নিজের বাড়ি।
এই ভ্রমণের শেষে হয়তো পাব মুক্তির আলো,
অস্থির আত্মা শান্ত হবে রাতের শেষে সকালে।

নতুন ভোরের আলো ফুটে যখন হবে জগৎ জাগ্রত,
অস্থির আত্মা পাবে শান্তি, হবে চিরতরে মুক্ত।

ছায়ার প্রেম

অস্তমিত সূর্যের আলোয়, জ্বলে ওঠে অশ্রুতারা,
নিঃশব্দে ডুবে যায়, দুটি আত্মার আকাঙ্ক্ষা।

শীতের রাতে, নিঝুম রাস্তায়, ছায়ার হাত ধরে হাঁটি আমি।
চাঁদের আলোয় ধরা পড়ে নিজেরই রূপ অপরূপ।
দুটো আত্মা, এক সাথে, নিঃশব্দে চলেছি, কোথায় যেন জানি না।

এই ছায়া, আমারই সঙ্গী, জন্ম থেকেই -
কখনো কথা বলে না, কিন্তু সব বোঝে।
আমার আনন্দে হাসে, আমার দুঃখে কাঁদে,
এক নিঃশব্দ ভাষায়, এক কষ্ট মেশানো চাহনিতে।

রাস্তার ধারে এক বটগাছ, শাখা ঝুঁকে দিয়েছে আমাদের জন্য -
চুপিসার নিমন্ত্রণ, পাতার শয্যায় বসতে।
আমি বসি, ছায়া বসে পাশে, চাঁদের আলোতে স্নান করে।
দুটো চুপচাপ আত্মা, এক নিঃশব্দ প্রেমে হারিয়ে যায়।

কোন কথা হয় না, কিন্তু চোখে চোখ মিলে যায়।
আমি জানি তার ভাষা, সে জানে আমার বেদনা।
এই নিঃশব্দ প্রেমে, কোন অভিযোগ নেই, কোন আশা নেই।
শুধু আছে দুটো আত্মার মিলন, নিঃশব্দ, নিঃশেষ।

রাত গভীর হয়, চাঁদ আকাশের কোণে ঢুকে পড়ে।
আমি উঠি, ছায়াও উঠে আমার সাথে।
একবার পিছনে ফিরে তাকাই, বটগাছের দিকে -
শাখায় ঝুলছে শুধু নিঃশব্দ নিঝুম রাত।

ছায়া আমার সঙ্গী, আমি তার সাথি -
এই প্রেমে বাঁধা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
কোন শপথ নেই, কোন বাঁধন নেই, শুধু আছে -
দুটো আত্মার নিঃশব্দ গান, চাঁদের আলোয় লেখা।

শীতের নিশ্বাসে কাঁপছে রাতের বুক,
চাঁদের আলোয় ভেসে যায় দুই অজানা আত্মার সুখ।

কলকাতার গল্প

স্বপ্নের নগরীতে হারিয়ে গেলাম, ভালোবাসার অজানা পথে,
ইরার স্মৃতি ধরে রাখি, অসমাপ্ত কবিতার মতো হৃদয়ে।

কী করে ভালোবাসি তোকে ইরা, গুনে শেষ হবে না?
যেমন আকাশ ভালোবাসে সূর্যকে, নিঃশব্দ, অতৃপ্ত, দীর্ঘশ্বাসে।
যেমন গঙ্গা ভালোবাসে সাগরকে, ছুটে চলে মিলনের আশায়।
যেমন রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন শান্তিনিকেতনকে, নিজের অন্তহীন কবিতার ঠিকানায়।

ভালোবাসি তোকে ইরা, যেমন চৈত্রের ঝড় সিঁদুর ছুঁড়ে দেয় পলাশ গাছে।
যেমন বর্ষার ঝরনা জাগিয়ে দেয় কাঙাল পৃথিবীর বুকে আশা।
যেমন শরৎ রাতে মন্থর সুর চলে জোছনার শান্ত মেঠোপথে।
যেমন শীতের সকালে কুয়াশার আঁধারে ফুটে ওঠে গোলাপের লাল লেখা।

ভালোবাসি তোকে ইরা, যেমন কলকাতার ট্রাম বাজায় তার ঐতিহ্যের গান।
যেমন বুক চাপড়ায় হাওড়া স্টেশন, দূরদেশের যাত্রীদের বিদায় জানিয়ে।
যেমন কফিহাউসে তর্কে মেতে থাকে স্বপ্নবাজ লেখকেরা।
যেমন বাদামতলায় ছুটে চলে রিক্সা, ঢুকে পড়ে সন্ধ্যার কোলাহলে।

ভালোবাসি তোকে ইরা, যেমন বইয়ের পাতায় হারিয়ে যায় মন, গল্পের মায়ায়।
যেমন পুরনো রেকর্ডে গুনগুন করে গান, প্রেমের অতীত স্মৃতি ফিরিয়ে।
যেমন ভিড়ের মাঝেও দুটো চোখ খুঁজে ফেলে, অজানা এক সংকেতে।
যেমন চুপির গভীরে লুকিয়ে থাকে অগোছালো ভালোবাসার কথা, অথৈ, অনাহুত।

কিন্তু ইরা, এই শহরের গল্পের মতোই আমাদের প্রেম কাহিনিও অসমাপ্ত।
হঠাৎ এক ঝলক ঝড় ঝাপিয়ে এসে ছিনিয়ে নেয় সব স্বপ্নের রঙ।
একটি ট্রাম লাইন পেরিয়ে দূরে চলে যায়, ফিরে না আর কখনো।
বাকি থাকে শুধু স্মৃতির অসমাপ্ত লেখা, বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া এক টুকরো গান।

এই শহরের গল্পে থাকে সুখ, থাকে দুঃখ, থাকে অসমাপ্ত প্রেমের দাগ।
আমাদের গল্পও ঠিক তেমনই, নিঃশব্দে মিলিয়ে গেলো ভিড়ের মাঝে।
কিন্তু ভালোবাসা থাকবে বুকে, চিরকালের মতো, এক অসমাপ্ত কবিতার মতো,
গুনে শেষ হবে না, অনুভবেই মিলবে তার অন্ত।

কলকাতার গল্পে লেখা আমাদের ভালোবাসা, অসমাপ্ত অধ্যায়,
মনে রয়ে যাবে চিরকাল, অমলিন স্মৃতির ছায়ায়।

স্বপ্নের টেলিভিশন

মায়াবী ছায়ার খেলায়, জ্ঞান ম্লান, অজ্ঞতার ঘোর,
স্বপ্নের টেলিভিশনে, শিক্ষা নিষিদ্ধ, বাস্তবতার জ্বর।

স্বপ্নের টেলিভিশনে খবর চলছে, শিক্ষা নিষিদ্ধ!

রাস্তায় হাঁটে স্কুলব্যাগ হাতে ছাত্রী, বইয়ের পাতাগুলো উড়ে যায় বাতাসে,
শব্দ হয় না, কেবল কালো সাদা রেখা ছায়ার মতো নাচে।
ব্ল্যাকবোর্ডে হঠাৎ ফুটে ওঠে ডিজিটাল ঘড়ি, সময় ঘুরে যায়, শিক্ষকের চেঁচামেচি
হারিয়ে যায় এক বিশাল সার্চ ইঞ্জিনের গর্জনে।

ক্লাসরুমে ঢোকে নীল নক্ষত্রের ঝাঁক, ছাত্রদের মাথা থেকে জন্ম নেয় অ্যান্টেনা,
জ্ঞানের তথ্য ঝরে পড়ে মেঘের মতো, কিন্তু মস্তিষ্কে ঢুকে না কোনোটা।
শিক্ষকের হাতে কম্পিউটারের মাউস, ক্লিক করে খুঁজে বের করে সঠিক উত্তর,
কিন্তু কোনো প্রশ্ন জাগে না, কোনো কৌতূহল জ্বলে না চোখে।

হঠাৎ বইয়ের পাতাগুলো জীবিত হয়ে ওঠে, পাখি হয়ে উড়ে যায় জানালার বাইরে,
শব্দ হয় লেখার, কিন্তু বোঝা যায় না কোনো অর্থ।
কালি দিয়ে লেখা অক্ষরগুলো স্ক্রিনে ভাসে, অদৃশ্য কীবোর্ডে টাইপ হয় নিজের ভবিষ্যৎ,
কিন্তু কোনো ভুল সংশোধ করার সুযোগ নেই।

শিক্ষা নিষিদ্ধ! শিক্ষা নিষিদ্ধ!

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে, মানব মন হারায় দিশা,
স্বপ্নের টেলিভিশনে, শিক্ষা নিষিদ্ধ, জীবনের বিষণ্ণতা।

ডিজিটাল গ্রামের সত্য গল্প

মায়াবী নীল আলোয় জ্বলে স্ক্রিনের মুখ,
বাস্তবের মাটিতে হারিয়ে যায় স্পর্শের সুখ।

লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করুন, দেশে বদল হবে!

রিকশার বাতাসে ভাসে স্ট্যাটাস আপডেট,
চা-দোকানে আলোচিত হয় ভার্চুয়াল বাস্তব।
ফেসবুক লাইভে ভাঙছে পদ্মাসেতু,
কিন্তু নদীর বুকে ডুবে যায় স্কুলবাস।

শহরের আকাশে উড়ে ড্রোন,
গ্রামের মাঠে খেলা করে স্মার্টফোন।
জিপিএসে চালিত লাঙল চষে জমি,
কিন্তু খালি থাকে শস্যাগার।

অ্যাপে অর্ডার করে আসে পিৎজা,
মাটির চুলায় জ্বলে না আগুন।
কলের পানিতে ভাসে প্লাস্টিকের থলে,
কিন্তু নেই পানীয় জলের নিশান।

স্বপ্নের প্যাডে আঁকা হয় মঙ্গলযান,
বাস্তবে বিক্রি হয় শিশুদের শৈশব।
প্রভু, আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি,
এই সত্যি-মিথ্যের জগতে,
এই অবাস্তবের বাস্তবে।

আনফলো করুন, লাইক বন্ধ করুন, বাস্তব বদলান!

কোথায় হারিয়ে গেল মানুষের স্পর্শ, হৃদয়ের স্পন্দন?
শুধু লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের খেলায় ডুবে যায় জীবন।

শ্রেষ্ঠ নয় মানুষ

মৃত্যুর মুখোমুখি, প্রশ্ন জাগে মনে,
মানুষ কি সত্যিই সৃষ্টির সেরা স্থানে?

তুমি কি সত্যিই শ্রেষ্ঠ, মানুষ?
অন্য প্রাণীদের তুলনায় উত্তম?
তাদের থেকে পৃথক?
সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি?

না, মানুষ, তুমি শ্রেষ্ঠ নও।
তুমিও প্রকৃতির নিয়মে বিবর্তিত হয়েছ।
অন্য প্রাণীদের চেয়ে তোমার আছে কিছু বেশি, কিছু কম।
কিন্তু তাই বলে তুমি তাদের তুলনায় উত্তম নও।

তুমি কি জানো, পিঁপড়ারা তোমার চেয়ে বেশি সংগঠিত?
ময়ূরেরা তোমার চেয়ে বেশি সুন্দর?
শিম্পাঞ্জিরা তোমার চেয়ে বেশি সামাজিক?
কুকুররা তোমার চেয়ে বেশি বিশ্বস্ত?

তুমি কি জানো, তুমিই একমাত্র প্রাণী যে নিজের প্রজাতিরই সর্বনাশ করতে পারে?
তুমিই একমাত্র প্রাণী যে প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে?
তুমিই একমাত্র প্রাণী যে নিজের স্বার্থে অন্যান্য প্রাণীকে হত্যা করে?

তাহলে কীভাবে তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করো, মানুষ?
তুমি তোমার নিজের প্রজাতিরই শত্রু।
তুমি প্রকৃতির শত্রু।
তুমি ভবিষ্যতের শত্রু।

তুমি শ্রেষ্ঠ নও, মানুষ।
তুমি শুধুমাত্র অন্য প্রাণীদের মতোই একটি প্রাণী।
তুমিও প্রকৃতির অংশ।
তুমিও বিবর্তনের ধারায় এগিয়ে চলেছ।

তাহলে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করার দরকার কী?
নিজেকে কেন্দ্র করে পুরো বিশ্বকে ঘোরানোর দরকার কী?
নিজের স্বার্থে অন্য প্রাণীদের কষ্ট দেওয়ার দরকার কী?

এসো, নিজেকে নতুন করে চিনতে শিখি।
নিজেকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে মেনে নিই।
অন্য প্রাণীদের সম্মান করি।
ভবিষ্যতের জন্য কাজ করি।

শ্রেষ্ঠ হওয়ার দরকার নেই, মানুষ।
শুধু ভালো হওয়ার দরকার।
নিজের প্রতি, অন্য প্রাণীদের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি।
তাহলেই পৃথিবী হবে এক সুন্দর জায়গা।

প্রকৃতির রুদ্র গর্জন বাজবে শুধুই,
যদি মানুষ না শেখে ভালোবাসার মন্ত্র এই।

তোমার বাজারে আমার হৃদয়

স্বপ্নের বাজারে হৃদয়ের দোকান,
কোথায় পাব তোমার প্রেমের মূল্যমান?

তোমার বাজারে আমার হৃদয় বিক্রি করতে এলাম,
তোমার প্রেমের জন্য।

তোমার বাজারটি অদ্ভুত,
সেখানে বিক্রি হয় শুধু প্রেম আর অনুভূতি।

আমার হৃদয়কে বাজারের মাঝখানে রেখে দিলাম,
একটা স্বচ্ছ কাচের বাক্সে।

বাক্সের ওপরে লিখলাম,
"একটি হৃদয় বিক্রি হবে,
তোমার প্রেমের জন্য।"

বাজারের লোকজন এসে আমার হৃদয় দেখে,
কিন্তু কেউই কিনতে চায় না।

কেউ বলে,
"এই হৃদয়টি ভাঙা,
এই হৃদয়টি দুর্বল।"

কেউ বলে,
"এই হৃদয়টিতে অনেক কষ্টের দাগ,
এই হৃদয়টিতে অনেক অশ্রুর দাগ।"

কিন্তু আমি জানি,
আমার হৃদয়টি ভাঙা হলেও,
দুর্বল হলেও,
এই হৃদয়টিতেই আছে সত্যিকারের প্রেম,
এই হৃদয়টিতেই আছে তোমার জন্য প্রেম।

একদিন তুমি আসবে আমার হৃদয় কিনতে।
আমি জানি, তুমি আসবেই,
কারণ আমার হৃদয়টি শুধুই তোমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

তোমার বাজারে আমার হৃদয় বিক্রি করতে এলাম,
তোমার প্রেমের জন্য।

এখন শুধু তোমারই অপেক্ষা।

স্বপ্ন ভেঙে যাবে না, ভাঙবে না আশা,
তোমার প্রেমের জন্য, চিরকাল অপেক্ষা।

প্রেমের বাজার

মায়ার খেলায় মনের কাঞ্চন,
ভ্রান্ত বাজারে প্রেমের আকর্ষণ।

প্রেমের বাজারে গেলাম,
কিনতে প্রেমিক,
কিনতে প্রেমিকা,
কিনতে প্রেম।

বিক্রেতারা ডাকছে,
"এই যে প্রেমের বাজার,
এই যে প্রেমের দোকান,
এই যে প্রেমের হাট।"

গেলাম একেক দোকানে,
দেখলাম একেক প্রেমিক,
দেখলাম একেক প্রেমিকা,
দেখলাম একেক প্রেম।

কেউ বলল,
"আমার প্রেমিক সুদর্শন,
আমার প্রেমিক ধনী,
আমার প্রেমিক পড়ালেখা জানে।"

কেউ বলল,
"আমার প্রেমিকা সুন্দরী,
আমার প্রেমিকা কোমল,
আমার প্রেমিকা সবুজ।"

কেউ বলল,
"আমার প্রেম সত্যিকারের,
আমার প্রেম মজবুত,
আমার প্রেম চিরকালের।"

কিন্তু আমি কোনও প্রেম কিনতে পারলাম না,
কোনও প্রেমিক কিনতে পারলাম না,
কোনও প্রেমিকা কিনতে পারলাম না।
কারণ আমার কাছে টাকা ছিল না,
আমার কাছে প্রেম কেনার মতো কিছুই ছিল না।

আমি বাজার থেকে বেরিয়ে এসে,
একটা গাছের নিচে বসলাম।
আমি ভাবলাম,
প্রেম কি কেনা যায়?
প্রেম কি বিক্রি যায়?
প্রেম কি একটা জিনিস,
যা কিনে বিক্রি করা যায়?
আমি বুঝলাম,
প্রেম কিছুই না,
প্রেম শুধুই একটা অনুভূতি।
প্রেম কিনতে হয় না,
প্রেম বিক্রিও হয় না।
প্রেম পাওয়া যায়,
প্রেম উপহার পাওয়া যায়।
প্রেম হৃদয়ে জন্ম নেয়,
প্রেম মন থেকে আসে।
প্রেম সত্যিকারের হলে,
তাকে টাকায় কিনতে হয় না,
সময় ও মন দিয়ে পেতে হয়।

প্রেমের বাজারে গেলাম,
কিনতে প্রেমিক,
কিনতে প্রেমিকা,
কিনতে প্রেম।
কিন্তু বুঝলাম,
প্রেম কিনতে হয় না,
প্রেম পাওয়া যায়।

স্বপ্নের বাজারে ঘুরি, অজানা পথে,
প্রেমের খোঁজে হৃদয় কাঁপে, ক্ষণে ক্ষণে।

প্রেমের বাজার

মায়ার খেলায় মনের কাঞ্চন,
ভ্রান্ত বাজারে প্রেমের আকর্ষণ।

প্রেমের বাজারে গেলাম,
কিনতে প্রেমিক,
কিনতে প্রেমিকা,
কিনতে প্রেম।

বিক্রেতারা ডাকছে,
"এই যে প্রেমের বাজার,
এই যে প্রেমের দোকান,
এই যে প্রেমের হাট।"

গেলাম একেক দোকানে,
দেখলাম একেক প্রেমিক,
দেখলাম একেক প্রেমিকা,
দেখলাম একেক প্রেম।

কেউ বলল,
"আমার প্রেমিক সুদর্শন,
আমার প্রেমিক ধনী,
আমার প্রেমিক পড়ালেখা জানে।"

কেউ বলল,
"আমার প্রেমিকা সুন্দরী,
আমার প্রেমিকা কোমল,
আমার প্রেমিকা সবুজ।"

কেউ বলল,
"আমার প্রেম সত্যিকারের,
আমার প্রেম মজবুত,
আমার প্রেম চিরকালের।"

কিন্তু আমি কোনও প্রেম কিনতে পারলাম না,
কোনও প্রেমিক কিনতে পারলাম না,
কোনও প্রেমিকা কিনতে পারলাম না।
কারণ আমার কাছে টাকা ছিল না,
আমার কাছে প্রেম কেনার মতো কিছুই ছিল না।

আমি বাজার থেকে বেরিয়ে এসে,
একটা গাছের নিচে বসলাম।
আমি ভাবলাম,
প্রেম কি কেনা যায়?
প্রেম কি বিক্রি যায়?
প্রেম কি একটা জিনিস,
যা কিনে বিক্রি করা যায়?
আমি বুঝলাম,
প্রেম কিছুই না,
প্রেম শুধুই একটা অনুভূতি।
প্রেম কিনতে হয় না,
প্রেম বিক্রিও হয় না।
প্রেম পাওয়া যায়,
প্রেম উপহার পাওয়া যায়।
প্রেম হৃদয়ে জন্ম নেয়,
প্রেম মন থেকে আসে।
প্রেম সত্যিকারের হলে,
তাকে টাকায় কিনতে হয় না,
সময় ও মন দিয়ে পেতে হয়।

প্রেমের বাজারে গেলাম,
কিনতে প্রেমিক,
কিনতে প্রেমিকা,
কিনতে প্রেম।
কিন্তু বুঝলাম,
প্রেম কিনতে হয় না,
প্রেম পাওয়া যায়।

স্বপ্নের বাজারে ঘুরি, অজানা পথে,
প্রেমের খোঁজে হৃদয় কাঁপে, ক্ষণে ক্ষণে।

প্রেমের দ্বন্দ্ব

স্বপ্নের মায়ায় ঘেরা এই মন, কত রহস্যে ভরা,
প্রেম কি সত্যি, নাকি মৃত্যুর কালো ছায়া?

আমি কে?
এই নিখিল বিশ্বের মাঝে, চাঁদের আলোয় স্নাত এই রাত্রিতে,
আমি কে?
এই চেহারা, এই চুল, এই চোখ -
কিছুই অপরিচিত নয়, তবু সবকিছুই যেন বিদ্রোহী!

প্রেম, ওই দূরের তারার মতো ঝলমলে আকাশ থেকে নেমে এসেছে।
আমার হৃদয়ে নেমেছে, এক অগ্নিঝড় সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু, এই প্রেম কি সত্যি? নাকি শুধু মায়া, মৃত্যুদূতের বীণার সুর?

সমাজের শৃঙ্খলে বাঁধা আমার জীবন, এক নির্দিষ্ট গতিপথে চলে।
কিন্তু, প্রেমের এই হাওয়া এসে সেই গতিপথে কাঁপন ধরিয়েছে।
কোন দিকে যেতে হবে, কোন পথ বেছে নিতে হবে, মনে এক টানাপোড়েন,
ঠিক যেন দুই বিপরীত মেরুর টানাটানি।

এই প্রেম, কি এটি স্বর্গীয় সুধা, নাকি বিষ-কূপ?
এই প্রেম কি আমাকে পরিপূর্ণ করবে, নাকি ধ্বংস করে দেবে?
এই চিন্তায় মাথা ঝিমঝিম করে, এই প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাব?

আয়না, তুমি কি আমার সাক্ষী হবে? এই দ্বন্দ্বের, এই প্রেমের যুদ্ধের?
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ আমার হৃদয়ে ঝড়ের তান্ডব?
না, তুমি শুধুই প্রতিফলিত করছ আমার চেহারা, আমার দ্বিধাগ্রস্ত চোখ।

কবিরা লিখেছেন, প্রেম অন্ধ। কিন্তু, আমি কি সত্যিই অন্ধ হব?
সমাজের নিয়ম, পরিবারের মর্যাদা - এগুলো কি সব মিথ্যা?
না, এগুলোও শেকড়ের মতো আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

কিন্তু, প্রেমের এই আগুন, তাও কি মিথ্যা?
তার চোখের দৃষ্টি, তার কথার স্পর্শ - এগুলো কি সব স্বপ্ন?
না, এগুলো সত্যি, এগুলো আমাকে জীবন্ত করে তোলে।

আমি কি করব? কোন পথ বেছে নেব? প্রেমের স্বপ্নের পিছনে ছুটব,
নাকি সমাজের নিয়মের চৌকাঠের মধ্যে থাকব?
হয়তো প্রেম হারালে জীবন থাকবে, কিন্তু তা কি আর জীবন হবে?
শুধু নিশ্বাস নেয়া, মৃতের মতো বেঁচে থাকা?

আয়না, কিছু বলো! আমাকে পথ দেখাও! কিন্তু, না, তুমি নির্বাক।
তুমি শুধুই প্রতিফলিত করো আমার দ্বন্দ্ব, আমার বিভ্রম।
হয়তো এই নীরবতা, এই অন্ধকারই আমার সঙ্গী হবে এই রাতে।
কিন্তু, কাল সকালে সূর্য উঠবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সমাজের রথ চলবে তার নিজের গতিতে। কিন্তু, আমার রথ?
সেটা কি চলবে প্রচলিত পথে, না কি ভাঙবে সব নিয়ম,
ধেয়ে যাবে প্রেমের দিগন্তের দিকে?

এই ঘর, এই পরিচিত পরিবেশ - কিছুই আর আগের মতো লাগছে না।
প্রেমের ছোঁয়া লেগেছে সবকিছুতেই।
দেওয়ালে ঝুলানো সেই প্রিয় ছবিটাও যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে,
যেন বলছে, "বাঁধ ছেড়ে বেরিয়ে এসো, নতুন জীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।"

কিন্তু, মনের এক কোণে একটা ভয়।
ফুটতে না ফুটতেই,  প্রেমের ফুল কি মলিন হয়ে যাবে?
সমাজের ঝড়ে, নিন্দার আগুনে, কিংবা দূরত্বের বিরহে,
এই প্রেম কি টিকে থাকবে?

না, এই চিন্তা নয়। এখন চাই ঐ চোখের দৃষ্টি, ঐ কথার স্পর্শ।
এখন চাই প্রেমের মধু আস্বাদন।
ফল কেমন হবে, সেটা পরের কথা।

আয়না, হয়তো তুমি আমাকে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না।
কিন্তু, তুমি আমার সাহসের সাক্ষী হবে।
আমি বেছে নেব প্রেমের পথ, চলব অজানায়,
যদিও জানি না সেই পথের শেষ কোথায়।

আমি কি জয়ী হব এই দ্বন্দ্বের যুদ্ধে?
নাকি হারিয়ে যাব অজানার অন্ধকারে?

স্মৃতি বিহীন যৌবনের নিরুদ্দিষ্ট গান

স্মৃতি বিহীন যৌবন অস্পষ্ট আয়নায় ভাসমান,
কোথায় হারিয়ে গেলে তার গল্প, তার গান?

যৌবন, এক বিপজ্জনক অ্যাপ,
ডাউনলোড হয় হঠাৎ, জীবনের এপ্রিল ফুলের মতো।
পপ-আপ বিজ্ঞাপন জ্বলে ওঠে চোখে,
"সুন্দর হও, সাহসী হও, বিশ্ব জয় করো!"

কিন্তু কোনো ইন্সটলেশন গাইড নেই,
নেই কোনো কাস্টমার সার্ভিস নম্বর।
এই অ্যাপের কোনো ব্যবহারিক নির্দেশাবলী নেই,
শুধু অস্পষ্ট ইমোজির ঝড়।

আমরা সকলেই ট্যাপ করি "গ্রহণ করুন",
নিজের অজ্ঞতার সুইচ টিপে দেই।
শরীরটা হঠাৎ ফুলে ওঠে,
মনটা এক বিশৃঙ্খল সার্চ ইঞ্জিনে পরিণত হয়।

কিন্তু গল্প কোথায়?
কোনো পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতা অ্যাপের সাথে আসে না।
আমরা ফটোগ্রাফ সংগ্রহ করি,
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রদর্শনী কক্ষে ঝুলিয়ে রাখি,
কিন্তু সেগুলো স্মৃতি নয়,
কেবল ডিজিটাল ধোঁয়া।

যে যৌবন গল্প বলতে পারে না,
সে কি সত্যিই যৌবন?
না, সে একটি নকল পণ্য,
চকচকে প্যাকেজিং, ভিতরে ফাঁপা।

আমরা হারিয়ে ফেলি অবাক দৃষ্টিতে তারার আকাশ দেখার ক্ষমতা,
পুরনো গানের কথার মতো নিজের হৃদয়কে শোনা।
এই অ্যাপে কোনো অফলাইন মোড নেই,
শুধু ক্লিক, লাইক, শেয়ারের চক্র।

কিন্তু হে স্মৃতি বিহীন যৌবন,
আমরা তোমাকে আনইন্সটল করব।
আমরা পুনরায় ডাউনলোড করব অবাক দৃষ্টির অ্যাপ,
নিজের গল্প লেখার অ্যাপ।

আমরা লিখব প্রথম প্রেমের কাঁচা কবিতা,
বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ।
লিখবো রাতের আকাশে ধূমকেতুর নীরব চিঠি।

এই নতুন অ্যাপে থাকবে ব্যর্থতা,
থাকবে হতাশা, থাকবে ক্ষত।
কিন্তু থাকবে গল্প,
আমাদের নিজের গল্প।

আমরা তখনই বুঝব,
সেই যৌবন কোনো যৌবন নয়,
যার কোনো গল্প নেই, কোনো স্মৃতি নেই মনের।

সত্যিকারের যৌবন জাগে স্মৃতির স্পর্শে,
অনন্ত গল্পের ঝরনা ঝরে মনের বর্ষণে।

অপেক্ষা

স্বপ্নের আঁধারে মুখখানি ঝলমলে,
হৃদয় কাঁপে, অপেক্ষার বেদনা জ্বলে।

হঠাৎ, দূরের জানালায় কোন মুখ দেখি?
আসলে দেখতে পাই, মুখের এক পাশ পর্দার ফাঁকে।
মুখের এক পাশ দেখেই বুঝি, এই সে, যে আমার,
আমার হৃদয়ের অপেক্ষা।

অদৃশ্য আরেক পাশ কি সেই একই...

এই যে মুখখানি, কতদিন ধরে তাকে দেখার জন্য
চোখ পথে রেখেছি।
কত রাত জাগা, কত দিন অপেক্ষা,
কত আশা-নিরাশার খেলায় ক্লান্ত হৃদয়।
আজ কি সেই অপেক্ষার পরিসমাপ্তি?

হয়তো তাই! কেবল মুখের এক পাশ দেখেই সব বুঝে ফেলেছি।
কত স্মৃতি, কত অনুভূতি, কত আবেগ জড়িয়ে আছে এই এক পাশে।
এই এক পাশেই যেন ফুটে উঠেছে অতীতের সব ছবি।

কিন্তু অদৃশ্য আরেক পাশ?
সেই পাশে কি লুকিয়ে আছে একই মানুষ?
সেই একই হৃদয়, সেই একই চোখ, সেই একই ভালোবাসা?

সে যদি না হয়, তাহলে এই অপেক্ষার পরিণাম কী?
আবারো কি হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাবে হৃদয়?

এই প্রশ্নের উত্তর কে জানে?
শুধু জানি, এই মুহূর্তে, এই অপেক্ষার মুহূর্তে,
হৃদয় কেবল একই কথা বলে চলেছে -
"এই সে, যে আমার, আমার হৃদয়ের অপেক্ষা।"

হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে চলে, আশায় ভরে মন,
সত্যিই কি সে-ই এসেছে, নাকি শুধুই প্রলোভন?

কবির কবিতা ঈশ্বরের কানে

স্বপ্নের নদীতে ভেসে বেড়ায় কবির কল্পনা,
অনন্তের সাথে মিশে যায় তার কবিতার ধারা।

নীল আকাশে ঝুলন্ত সেতু,
তার উপর দিয়ে
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার চরণগুলি হাঁটছে,
সোনালি হরিণের পালের মতো লাফালাফি করছে।

কবির বুক থেকে উড়ে যাওয়া শব্দগুলো,
মেঘের গা বেয়ে বয়ে যাচ্ছে,
ঈশ্বরের কানে পৌঁছতে চাইছে।

কিন্তু ঈশ্বর ব্যস্ত,
তিনি তাঁর ত্রিশূল ঘষছেন,
আকাশের ক্যানভাসে নতুন নক্ষত্র আঁকছেন।

হঠাৎ,
এক নক্ষত্র ঝলমল করে জ্বলে ওঠে --
ঠিক কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মতো সোনালি।

ঈশ্বর হেসে বলেন, "কবির কবিতাই আমার সৃষ্টির সার,
তার শব্দে মুখরিত হয় এই বিশ্বের রহস্য-ভার।"

কালো পাথরে অভিষেক

কালো পাথরে অভিষেক, আকাশে অশ্রু ঝরে—
এই শব্দে জগৎ জাগে, এই শব্দে জগৎ মরে।

শুভঙ্করের হাতে শাঁখ, বাতাসে বাজে শঙ্খধ্বনি।
পাথরে ঢালে দুধ, গগন থেকে ঝরে অঝোর বৃষ্টি।
পাথরের বুকে দুধের স্রোতে মিশে মেঘের জল,
শুভঙ্করের চোখে জ্বলজ্বল করে মেঘের আলো।

পাথরের কানে কানে ফিসফিস করে শুভঙ্কর,
"আজ তোকে দুধের স্নান করাব, কালো পাথর, আমার প্রেমের সাক্ষী।"
পাথরের বুকে পড়ে দুধের ফোঁটা, ছিটকে যায় চারিদিকে,
আকাশের বুকে পড়ে বৃষ্টির ফোঁটা, ছিটকে যায় চারিদিকে।

শুভঙ্করের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে পারমিতা, চোখে অশ্রু।
"শুভঙ্কর," ফিসফিস করে পারমিতা, "পাথরের কানে কী বলছ তুমি?"
"পাথরের কানে বলছি," শুভঙ্করের কণ্ঠে কম্পন, "তুমি আমার প্রেমের সাক্ষী।"
পাথরের বুকে পড়ে দুধের ফোঁটা, মিশে যায় বৃষ্টির জলে,
শুভঙ্করের চোখে জ্বলজ্বল করে পারমিতার প্রতিচ্ছবি।

আকাশ কাঁদে প্রেমের বেদনায়, পাথর কাঁদে অভিষেকে,
প্রেমের আগুনে পুড়ে যায় বিশ্ব, প্রেমের জলে জগৎ ভেজে।
শুভঙ্করের হাতের শাঁখের সুরে বাজে প্রেমের গান,
পাথরের বুকে দুধের ধারা বয়ে যায় অবিরাম।

কিন্তু, হঠাৎ থেমে যায় বৃষ্টি, থেমে যায় শুভঙ্করের শঙ্খধ্বনি।
পাথরে পড়ে থাকে দুধের শেষ ফোঁটা, আকাশে থাকে শুধু মেঘের ছায়া।
শুভঙ্করের চোখে জ্বলজ্বল করে শুধু পারমিতার অবস্থান।

কালো পাথরে অভিষেক, আকাশে অশ্রু ঝরে—
এই শব্দে জগৎ জাগে, এই শব্দে জগৎ মরে।
এই শব্দে প্রেম জন্ম নেয়, এই শব্দে প্রেম মরে।

নিরুদ্দেশের চিঠি

স্বপ্নের ছায়ায় ঢাকা এই শহর,
নিরুদ্দেশের চিঠি এক বেদনার স্বর।

ঠিকানা নেই, নেই লেখকের নাম,
এক কুঁচকানো কাগজ, জ্বলে উঠেছে আগুনে।
অক্ষর কাঁপছে, হাওয়ার মতো, কথা বলে আবেশে,
নিরুদ্দেশের চিঠি, লেখা আছে অশ্রুর জলে।

কোথায় সেই পথ, কোথায় সেই গ্রাম,
যেখানে ফুটেছিল স্বপ্ন, গন্ধ ছিল ধানের?
শহরের জঙ্গলে হারিয়ে গেছি, নিজেকেই খুঁজে পাই না,
নিরুদ্দেশের চিঠি, এক হাহাকারের সুর গায়।

মাকে লিখেছি, ফিরবো একদিন, সোনার ঘর বানিয়ে।
কিন্তু রাস্তার ধুলায় মিশে গেছে সব, স্বপ্ন হয়েছে খণ্ড।
এখানে শুধু কংক্রিট, আর ধোঁয়ার কালো আয়না,
নিরুদ্দেশের চিঠি, এক বঞ্চিতের কান্না।

তুমি কি বুঝবে মা, এই শহরের নিষ্ঠুরতা?
কোনো হাওয়া দয়া করে না, কোনো তারা জ্বলে না।
এখানে স্বপ্ন বিক্রি হয়, ছোট ছোট কয়েনে,
নিরুদ্দেশের চিঠি, এক দুঃখের দলিল।

কিন্তু মা, আমি হার মানিনি, জ্বলে আছে এক আগুন,
এই অন্ধকার ভেদ করে, একদিন উঠবে সূর্য।
ফিরবো আমি গ্রামে, তোমার হাত ধরে, আবার হাসব,
নিরুদ্দেশের চিঠি, এক প্রতিজ্ঞার দাগ।

এই জ্বলন্ত কাগজ, উড়ে যাক আকাশে,
নিরুদ্দেশের চিঠি, পৌঁছে যাক সবার কাছে।
এক নয়, নিরুদ্দেশ এই শহরে হাজার হাজার আছে,
তাদের কথা শোনো, তাদের জ্বালা দেখো, তাদের হাত ধরো।

নিরুদ্দেশের চিঠি, শুধু একজনের না,
এক শহরের কান্না, এক দেশের গান।

স্বপ্নহারা শহরের ধ্বংসস্তূপে জ্বলে,
নতুন সূর্যের আলো, আশার ফুলে ফুলে।

অনন্তে অস্পষ্ট দুটি নক্ষত্র

শূন্যতার আঁচলে ফুটে ওঠে দুঃখের ফুল,
অজানার মুখোমুখি দুই হৃদয়ের কুল।

আমার বুকের মাংস কেটে কেটে দিলাম তোমায়,
রক্তঝরা ফুলের মালা গেঁথে পরিয়ে দিলাম,
যন্ত্রণার সুর ধরে গেয়ে দিলাম,
আমার অস্তিত্বের স্পন্দন তোমার হাতে দিলাম।

কিন্তু, কখনো বলিনি তুমি আমার, তুমিও কখনো দাবি করোনি।
দুই দূরত্বের তারার মতো জ্বলে উঠতাম,
একই আকাশে, কিন্তু কখনো একই গগনে মিলিনি।

আমার শূন্যতার বাতাসে উড়িয়ে দিলাম তোমার স্বপ্নের বেলুন,
স্ফুলিঙ্গের অক্ষরে লিখে দিলাম অপূর্ণ প্রেমের কাব্য,
কষ্টের চোখ দিয়ে দেখেছি তোমায়,
কিন্তু, তোমার মালিকানা কখনো দাবি করিনি।

তুমি ছিলে বাতাসের মতো, সীমাহীন, স্বাধীন,
আমি ছিলাম মেঘের মতো, ঘনিয়ে-ঘনিয়ে, কিন্তু সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ঝড়ের দাপটে মিলে যেতাম, আবার দূরে সরে যেতাম,
অজানার দিগন্তে হারিয়ে যেতাম।

আমার কষ্টের ছায়া পড়েছে তোমার মুখে,
আমার কান্নার জল সিক্ত করেছে তোমার হৃদয়,
কিন্তু, এ ঋণশোধ কি তোমায় আমার করে দেবে?

না, তুমি তোমার, আমি আমার।
দুই আত্মা, দুই নদী, মিলিত হয়েও মিলিত না।
দুঃখের বন্ধনে বাঁধা, কিন্তু মনের চাবি কারো কাছে নেই।

যাও, পাখির মতো উড়ে যাও দূরে,
আকাশের আঁচলে লিখে যাও তোমার গন্তব্যের গান।
আমি থাকবো এই শূন্য বাতাসে,
এক অসমাপ্ত প্রেমের সুর ধরে, বাজিয়ে যাব চিরকাল।

অনন্তের খেলায় দুটি নামহীন তারা,
মিলনের আকাঙ্ক্ষায় জ্বলে, কিন্তু কখনো মেলে না।

দুরন্ত মহাসড়ক - হৃদয়ের যাত্রাপথ

স্বপ্নের রঙে আঁকা অজানা দিগন্ত,
হৃদয়ের সুরে ঝংকৃত রহস্যের মন্ত্র।

খেলা নয়, প্রিয়া, প্রেম কোন রঙিন ছকের বন্ধনে বাঁধা।

এ জীবন সুদীর্ঘ দুরন্ত মহাসড়ক,
যেখানে মৃদু হাওয়ায় দুটি মন পাখনা মেলে,
আকাশ ছেয়ে উড়ে যায় অজানার দিগন্তে।

সামনে পাহাড়, নদী, বনভূমি, শহরের ঝলমলানি,
হয়তো ঝড়বৃষ্টি, থমকে পড়া আলো, ভাঙা রাস্তাও আছে।

কিন্তু, হাত ধরে হাঁটতে হবে পাশে পাশে,
দু'জনার পা ফেলে চিহ্নিত করতে হবে পথের মানচিত্র।

প্রেমের চোখে দেখতে হবে জগতের রূপ,
সুখ দুঃখে ভাগ করে নিতে, অশ্রু মুছে দিতে।

গন্তব্য নেই জানার, অপেক্ষা নেই শেষ নিশ্বাসে,
চলার আনন্দই প্রেমের সার।

রাস্তায় পড়ুক কাঁটা, ধোঁয়াশা ঢাকুক দৃষ্টি,
হারিয়ে না ফেলা হাত, এটাই প্রেমের মন্ত্র।

মনে রাখো, প্রিয়া, প্রেম কোন জয়ী-পরাজিতের খেলা নয়,
দুই হৃদয়ের যাত্রা, মিলনের অবিরাম গান।

যখন প্রতিটি পদক্ষেপে ভালোবাসার সুর ঝংকৃত হবে,
তখনই মহাসড়ক হয়ে যাবে রূপকথার রাজপথ।

তাই চলো, হাত ধরে, দূরন্তে, অনন্ত স্বপ্নের দিকে,
হৃদয়ের এই যাত্রাপথে।

হাতে হাত, মনে প্রেম, স্বপ্নের রঙে মিশে,
দূরান্তে হারিয়ে যাব, অনন্তের আঁচলে।

মায়াবী প্রতিবিম্ব

অস্তিত্বের রহস্যে মন করে ভ্রমণ,
শূন্যতায় খুঁজে পাই তোমার প্রতিফলন।

আমি মনে হয় খুঁজছিলাম গুপ্তধন বা রত্ন
স্বচ্ছ জলাশয়ের মধ্যে
যখন তোমার মুখ...

যখন তোমার মুখ,
কূপের মধ্যে চাঁদের মতো
যেখানে আমি কামনা করতে পারি...

সত্যিই কামনা করতে পারি
তোমার চুম্বনের হিমশীতল আগুনের জন্য;
শুধু জলের উপর আমার ঠোঁট, যেখানে তোমার মুখ...

যেখানে তোমার মুখ প্রতিফলিত হয়েছিল, সুন্দর,
আসলে সেখানে ছিল না যখন আমি ঘুরে দেখি
শূন্য বাতাসের দিকে...

শূন্য বাতাসের দিকে...

স্মৃতির ধোঁয়াশায় ম্লান হয় তোমার ছবি,
হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসে মুছে যায় সব রবি।

জ্ঞানের তৃষ্ণার্ত অশ্বারোহী

জ্ঞানের সাগর, অন্তহীন, তরঙ্গে ভরা,
তীর কোথায়, কে জানে, কত দূরে ধরা?

এপ্রিলের বাতাসে পুরানো কাগজের গন্ধ,
মনে পড়ে সেই সব মঠের দেওয়ালে আঁকা জ্ঞানের ফল খাওয়ার দৃশ্য।
আমাদের শ্রেণিকক্ষ এখন নতুন জ্ঞানের এক মঠ,
আর আমি, এক অল্পবিদ্যাধারী ছাত্র, তক্ষশীলার পথে যাত্রা করছি।

কিন্তু হাতে নেই অশ্বমেধের ধন, নেই রথী সৈন্য।
আছে শুধু জ্ঞানের অগ্নিময় তৃষ্ণা,
আর তোমার কাছেই সেই তৃষ্ণা মেটানোর সোনার কাঁঠালের চাবি।

নতুন বইয়ের পাতায় লেখা আছে নক্ষত্রের গতিপথ,
কবির মনের গহ্বর, ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়।
এই সবই আমি পড়তে চাই, হে জন্মদাতা,
এই সব জ্ঞানের সলিল পানে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চাই।

যেন জানা যায় এই মৃত্যুপথিকৃৎ পৃথিবীর গভীর গল্প,
তারকাগুলির নিঃশব্দ সংলাপ।
দাও, হে জন্মদাতা, এই নতুন জ্ঞানের যাত্রায় আমাকে সবার সঙ্গী হতে।

জ্ঞানের অশ্বে চড়ে, অনন্ত নীল আকাশে উড়ব,
সত্যের আলো ছড়িয়ে, পৃথিবীকে করব নবজাগরিত।

দাবদাহের প্রেম

ফাগুনের রঙে ঝলমলে দিন এখন কালো দাবদাহে,
হৃদয় কাঁপে তীব্র বেদনায় অশান্তির আগুনে।

প্রিয় শুভঙ্কর, আকাশটা গলিত সীসার মতো ঝলসাচ্ছে,
ঢাকার রাস্তা গলিত লোহার নদী।
ঘামে আমার শাড়িটা আটকা পড়েছে,
শরীরটা যেন জ্বালাময় মশাল।

কিন্তু এই দাবদাহের চেয়েও জ্বালা করে
তোমার জন্য আমার হৃদয়।

এই শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে,
মনে হয় যেন কোনো রাজকীয় প্রাসাদ ধ্বসে গেছে।
আর আমি, সেই প্রাসাদের শেষ রক্ষাকর্তা,
হাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

কিন্তু আমার শত্রু কে?
এই অসহ্য গরম? না, এই নিঃসঙ্গ রাত?
না, শুভঙ্কর, আমার একমাত্র শত্রু হলো তোমার অনুপস্থিতি।

তোমাকে আমি কীভাবে বর্ণনা করব?
তুমি কি সেই সূর্য, যার ঔজ্জ্বল্যে আমার চোখ অন্ধ হয়ে যায়?
না, তুমি সেই চাঁদ, যার শীতল আলো আমার ত্বকে স্পর্শ করে
ক্ষীরসাগরে স্নান করার মতো অনুভূতি দেয়।

তুমি যেন মৃদু বাতাস, যে আমার ঘাম মুছে দেয়।
কিন্তু না, তুমি ঝড়, যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

আমাদের প্রেম ঐ মধ্যযুগীয় রোমান্সের মতো,
যেখানে রাজকুমারী দুর্গের সর্বোচ্চ শিখরে বন্দী থাকে,
আর রাজপুত্র অগ্নিঝড়ের মধ্যে দিয়ে লড়াই করে তাকে উদ্ধার করতে যায়।

আমি সেই রাজকুমারী, এই দাবদাহের দুর্গে আটকা পড়ে আছি।
আর তুমি, আমার রাজপুত্র, কোথায়?

এই চরম অস্বস্তিতেও, তোমার কথা মনে হলেই আমার শরীর জ্বলে ওঠে।
তোমার স্পর্শের স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে।
আমি চাই তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, তোমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে
এই অগ্নি নিভিয়ে ফেলতে।

জানি, এই চিঠি পড়ার সময় হয়তো তোমার কাছেও ঠিক এমনি লাগছে।
তুমিও হয়তো আমার জন্য অস্থির।
শুভঙ্কর, এই দাবদাহ কেবল বাইরে নেই, আমাদের অন্তরেও।
কিন্তু মনে রেখো, এই আগুনই আমাদের প্রেমকে আরও জ্বালাবে।

শীঘ্রই ফিরো, আমার রাজপুত্র।
তোমার অপেক্ষায়, তোমার পারমিতা।

প্রেমে পুড়ে ছাই হবো, জানি,
তবুও তোমারই জন্য হৃদয় উন্মুখ থাকি।

মুহূর্তের রূপকথা

ধুলোয় ঢাকা রূপালি আলোয়,
তুমিই মাটির রানি, রহস্যময়।

ভূমি যেন উঠে এসেছিল তোমার কোমর ছুঁয়ে,
নাকি তুমিই ঝুঁকে পড়েছিলে মাটির কাছে?

সূর্যাস্তের আলোয় ঝলমলে রুপালি কাচের মতো,
ধূলিকণা নাচছিল তোমার চারপাশে।

একটা কাঁটা বিঁধেছিল তোমার পায়ের তলায়,
যেন মাটি নিজেই তার সন্তানকে আহত করতে চায়।

হারিয়ে যাওয়া স্বর্গ খুঁজতে যেন কোনো দেবীমূর্তি,
তুমি ঝুঁকে পড়লে মাটির কোলে।

আঙ্গুলের নখে ধরে টেনে তুলতে চাইলে সেই কাঁটা,
যেন কোনো শিল্পী খুঁজছে হারিয়ে যাওয়া সুর।

তোমার ঘামের সঙ্গে মিশে গেল মাটির গন্ধ,
এক অদ্ভুত সুবাস ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

সেই মুহূর্তে যেন সময় থমকে গেল,
শুধু ছিল তোমার ঝুঁকে থাকা চেহারা আর ধূলিকণার নাচ।

পৃথিবী যেন কাছে টেনে নিল তোমাকে,
তার বুকে চাপা দিল সব দুঃখ, সব কষ্ট।

আর তুমি তখন উঠে দাঁড়ালে,
যেন কোনো ফুল ফুটল মাটির কোলে,
সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে।

মাটিতে মিশে থাকে এক ছোঁয়া,
এক স্মৃতি, এক রূপকথা -

মাটির গন্ধে ভেজা রূপকথা,
তোমারই ঝুঁকে থাকা চেহারা,

যা কখনোই মুছে যাবে না,কখনোই না...

মৃত্তিকার স্পর্শে, রূপের আভা,
হৃদয়ের বেদনা, প্রেমের ঝরা।

প্রেম: আবেগ নয়, নির্বাচন

প্রেম আগুন নয়, নয় ঝড়ের ঝাঁকুনি,
স্থির নির্বাচন, অন্তহীন সঙ্গী।

কাকে বলে প্রেম? সূর্যের উত্তাপ? রাতের শিশির?
না, এসব প্রতীক মাত্র, আবেগের ছলনা।
প্রেম হৃদয়ের ছুটি, মনের উচ্ছ্বাস নয়;
এক স্থির নির্বাচন, এক বারবার করা প্রতিজ্ঞা।

ঝড়ের মধ্যে দাঁড়ানো, আঁধারে হাত বাড়ানো,
ভুলের সাগরে ক্ষমার নৌকা চালানো –
এটাই প্রেম।
মধুর স্বপ্ন আর কড়া বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রে,
সঙ্গীর পাশে থাকা, তার হাত ধরে লড়াই করা –
এটাই প্রেম।

আমরা মনে করি, প্রেম এক জ্বালাময়ী আগুন,
হঠাৎ জ্বলে উঠে, সব ধ্বংস করে।
কিন্তু প্রেম নরম তাপ, নিঃশব্দে জ্বলে,
নিজেকে নয়, অন্যকে আলো দেয়।

প্রেমের গান গাওয়া সহজ, কিন্তু প্রতিদিনের ছোটখাটো কাজে
নিজের স্বার্থ ছুঁড়ে ফেলে, অপরের সুখে সুখ খুঁজে নেওয়াই
প্রকৃত প্রেম।

হ্যাঁ, প্রেমে আবেগ থাকে, মায়া থাকে,
কিন্তু তার সাথে থাকে বোঝাপড়ার দৃঢ়তা,
সহনশীলতার গভীরতা। প্রেমের কাছে দূরত্ব নেই, সময় নেই,
কেবল আছে অব্যাহতি দেয়া, নিঃশর্তে নেওয়া।

তাই শোনো, প্রেমকে আবেগের আগুনে বিচার করো না।
প্রেম স্থির নির্বাচন, প্রতিদিনের সংগ্রাম,
দুজনের হৃদয়ের নিঃশব্দ সংলাপ।

এই নির্বাচন করো, প্রেমকে বেছে নাও,
প্রেমী হয়ে যাও।
প্রেমী হয়ে যাও।

প্রেমের নীড়ে বন্দি সুখ, ভালোবাসার আঁচড়ে,
হৃদয়ের দরজা খুলে দাও, প্রেমের গান গাওরে।

হাসির অন্বেষণে

হাসিহীন জগৎ মরুভূমি, মন বন্দি শৃঙ্খলে,
হাসির সুরে জাগে আশা, মুক্তি পাবে সকলে।

বিশ্বব্যাপী হাসির সংকট? হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন।
আমরা হারিয়ে ফেলেছি হাসির সূত্র,
ভুলে গেছি মুখে হাসি ফোটানোর অভ্যাস।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে, হাসি হয়ে গেছে বাগ।
অ্যালগোরিদমের হিসাবে, হাসি হচ্ছে মাত্র একটি ডেটা পয়েন্ট,
যা বিশ্লেষণ করে বের করা যায়, কিন্তু অনুভব করা যায় না।

কিন্তু স্মরণ করুন, প্রাচীন পাথরে খোদাই করা হাসিগুলোকে,
যেগুলো এখনো হাসে, যুগ যুগান্তর পার হয়ে।
হাসি - একটি বিলুপ্ত প্রজাতি, যা ফিরিয়ে আনতে হবে জাদুঘর থেকে।

হাসি কি শব্দ? না, হাসি হচ্ছে একটি বিদ্রোহ।
যুক্তিহীন জগতের নিয়মের বিরুদ্ধে,
একটি বিস্ফোরণ, আনন্দের ঢেউ।

কল্পনা করুন, মঙ্গল গ্রহের লাল মাটিতে,
এক রোবট হাসছে।
কী হয়? সবকিছু থেমে যায়।
কারণ হাসি হচ্ছে এক সংক্রামক রোগ,
যা ছড়িয়ে দেয় আশা, সাম্য, মিলন।

হাসুন, মেশিনগানের গুলির মতো।
হাসুন, যেন ভেঙে ফেলা যায় চারপাশের অন্ধকার।
হাসুন, যেন মহাকাশটা হয়ে যায় হাসির এক বিশাল প্রতিধ্বনি।

আপনার হাসি, হয়তো পৃথিবীকে বাঁচাবে না,
কিন্তু হয়তো বাঁচাবে একটা মুখ,
একটা হৃদয়,
একটা জীবন।

তাই স্মাইল প্লিজ,
আপনারা প্রত্যেকেই একটু হাসুন।
হাসি হচ্ছে সবচেয়ে সহজ সূত্র,
সুখী জীবনের।

হাসি ছড়িয়ে দিন চারদিকে, মুখরিত করুন জীবন,
হাসির আলোয় ঝকঝকে পৃথিবী, হবে সকলের মিলন।

নীল রাতের গান

যখন সূর্য গ্রাস করে সময়, তখনই জাগে স্বপ্নের নগর।

বাতাসে ঝরে পড়ে রাজধানীর স্মৃতি,
মিশিয়ে যায় বুড়িগঙ্গার কালো জলে।
একটি সত্যি গল্পের সূত্র ধরে,
হাঁটছি আমি নীল রাতের গলিতে।

চাঁদের আলোয় ঝলমল করে নৌকা,
মাঝি গান গাইছে, "যাও, যাও দূরে..."
কিন্তু কোথায় যাবো? কেন যাবো?

হঠাৎ দেখি, নদীর মাঝখানে,
একটি বিশাল সূর্যমুখী ফুল ফুটেছে।
তার পাপড়ির ভিতরে,
একটি মেয়ে বসে গান গাইছে,
"আমিও যাবো, তুমিও যাও..."

কিন্তু কোথায় যাবো? কেন যাবো?

নদীর গভীর জলের তল থেকে,
হাত বাড়িয়ে দেয় এক অজানা কেউ।
বলে, "আসো, এখানে আসো..."

কিন্তু কোথায় যাবো? কেন যাবো?

যখন স্বপ্নের নগর নিভে যায়, তখনই জাগে সূর্য।

কালো নদীর নৌকা

রাতের আকাশে ঝুলে আছে উল্টো চাঁদ,
কাঁপে তারারা,
কালো নদী জেগে ওঠে, জলের বুকে জেগে ওঠে
বিশ্রী, দানবীয় চিৎকার।

নদীর দুপাশে ফুল ফোটে, অদ্ভুত রঙের,
কিছু সোনালি, কিছু গভীর নীল,
গন্ধে ভরা, মৃদু,
কিন্তু কোনো পাপড়ি নেই, শুধু কাঁটা।

নদীর মাঝখানে ভাসে নৌকা, কাঠের তৈরি নয়,
ধোঁয়া দিয়ে তৈরি,
কালো ধোঁয়া, শহরের ধোঁয়া,
জাহাজ ভাঙা ধোঁয়া।

নৌকোয় দাঁড়িয়ে আছে এক দানব,
চোখ দুটি লাল আগুন,
হাত দশটা, লম্বা লম্বা,
মাটি খায়, গাছ খায়,
বাংলাদেশকে খায়।

আমি চিৎকার করে বলি,
“কে তুমি, কালো দানব?
কার নির্দেশে খাচ্ছো আমার দেশ?”

দানবটি হাসে,
কালো ধোঁয়ার ঢেউয়ের মতো হাসে,
বলে,
“আমি দেশ খাই না,
আমি মানুষের ভুল খাই।”

রাত্রির স্বপ্নযাত্রা

শহরের শিরায় রাত্রি নামে, ঘুড়ির মতো ঘুরে ঘুরে।
বুড়িগঙ্গার কালো জলে, ঝিলমিল করে রোবোটিক কাঁকড়া।
একটি সত্য গল্পের সাক্ষী হয়েছিলাম আজ, অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্য।

একটি নৌকা ভাসছিল, আকাশের চাঁদকে বহন করে।
নৌকার মাঝি ছিল এক স্বপ্ন, চোখে অসম্ভবের আশা।
তিনি আমাকে বললেন, "যাও," তার কণ্ঠে ছিল অদৃশ্য হাওয়ার ঝংকার।

কিন্তু কেন?

মৃত্যু নয়, স্বপ্নই অনন্ত।

আঁখির ফুল

মা'র কোলে বসে, বছরেরা খসে যায় ধীরে ধীরে,
ছোট্ট একটি ঝোপ গজিয়ে ওঠে সেখানে, স্মৃতির ফুল ফোটে।
মা'র হাত, মৃদু চাঁদের আলোয় ঢাকা, আমার মনের অন্ধকারে ফেলে আলোর রেখা।
কিন্তু সেই আলোয় দেখি, মা'র হাত নয়, সে একটি ডাল, পাতায় পাতায় লেখা অজানা ভাষায় শিশুর কান্না।
আমার কান্না, এক ঝাঁক ক্ষুধার্ত পাখির ঝাঁপ, ঠোঁটে ঠোঁটে লেগে আছে অভিমানের গন্ধ।
মা'র মুখ, একটি পুরনো ঘড়ির নিস্তব্ধ মুখ, কাঁটাগুলো ঘুরছে, সময়ের গতিকে ধরে রাখতে পারে না।
বুকে এক অদ্ভুত আশঙ্কা জাগে - হয়তো আমি কোনোদিন বড় হব না, চিরকাল থাকবো মা'র কোলে, এই স্মৃতির ঝোপের নিচে।
কিন্তু হঠাৎ, মা'র বুক থেকে একটি ডানা গজায়, ঢেকে দেয় সূর্যকে, সারা বিশ্বকে।
ডানার নিচে, অন্ধকারে, আমি দেখি - মা হয়ে গেছেন একটি ছোট্ট মেয়ে, চোখে অভিমানের জল।
আমি বুঝি, আমার কান্না, তার শৈশবে হারানো কোনো খেলনা।
আমি হাত বাড়িয়ে, স্পর্শ করি তার চুল, বলি - 'মা, আমি এখন বড় হয়ে গেছি, তোমার কান্না মুছে দেব।'
কিন্তু আমার হাত, একটি শুকনো পাতায় পরিণত হয়, আর মা'র চেহারা মিলিয়ে যায় আকাশের মেঘের সাথে।
শুধু একটা প্রশ্ন ঝুলে থাকে - স্মৃতির ফুল ফোটে কোন বৃক্ষে, যার ফল অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ - সব একাকার করে দেয়?

নিউমার্কেটে প্রেম!

নিউমার্কেটে যাওয়া প্রেমে পড়া!

এখানে, সূর্যের রশ্মি ডুবে যায় মসলা পানের গন্ধে,
আকাশ ঝুলে থাকে ঝলমলানো কাপড়ের রশিতে।
সময় বিক্রি হয় ঘড়ির দোকানে,
প্রেম বিক্রি হয় পানের স্টলে।

একটি মেয়ে, তার চোখে ঢাকা আছে সাদা মেঘের টুকরো,
হাতে ধরে আছে একটি প্লাস্টিকের বেলুন,
যার ভেতরে ভাসে এক জোড়া ঘুড়ি।
সে হাঁটে, তার পায়ের ছাপে ফুটে ওঠে লাল গোলাপ।

একটি ছেলে, তার কানে লেগে আছে এক টুকরো রবীন্দ্রসঙ্গীত,
হাতে ধরে আছে একটি পুরনো ক্যামেরা,
যা ছবি তোলে না, কেবল স্মৃতি ধরে রাখে।
সে তাকিয়ে আছে, তার চোখে জ্বলজ্বল করে নিউমার্কেটের আলো।

কীভাবে এরা একে অপরের সাথে দেখা করলো নিউমার্কেটের কোন এক গলিতে?
কীভাবে তাদের প্রথম কথা হলো, হাতে হাত লেগে?
কীভাবে তাদের চোখে চোখ লাগলো, আর প্রেমের বীজ বপন হলো?

নিউমার্কেটে যাওয়া প্রেমে পড়া!

এখানে, প্রতিটি পদক্ষেপে লেখা থাকে ভালোবাসার গল্প,
প্রতিটি দোকানে বিক্রি হয় প্রেমের স্বপ্ন।

ডিআরএমসি প্রেমের স্থানচ্যুতি

সূর্য স্থবির, সময় স্থবির, তবুও তুমি আসোনি!

বাতাসে ঝরে পড়া মেঘের টুকরোয় তোমার নাম লেখা,
বিদ্যুৎ চমকের আলোয় ঝলমলে তোমার চোখের রঙ।
ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডে ক্রমশ লেখা হয় তোমার প্রশ্নাবলি,
হাতেকলমে লিখে, কিন্তু কোনো উত্তর নেই।

বিরতির ঘণ্টায় ক্যান্টিনে জমে উঠেছে সবাই,
সময়ের নদী বয়ে নিয়ে যায় তাদের স্বপ্নের নৌকো।
তোমার নামে রাখা চেয়ারে বসে আছি আমি, একা,
একটি ট্রানজিস্টরে বাজছে ‘তুমি আসবে বলেছিলে’।

হঠাৎ, ঢাকার আকাশে এক অদ্ভুত পাখি উড়ে যায়,
তার ডানায় লেখা ‘সত্যিকারের প্রেমে অপেক্ষা নেই’।

সূর্য স্থবির, সময় স্থবির, তবুও তুমি আসোনি!

বিদ্যালয়ের বাইরে বিদ্যা

শিক্ষা একটা সোনার ডিম, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকগুলো খাঁচা!

রাস্তায় হাঁটছেন রবীন্দ্রনাথ, পকেটে নিয়ে ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম খসড়া।
একটি মেয়ে তাকে থামিয়ে বলে, ‘কী লিখছেন কবিরাজ?’
রবীন্দ্রনাথ হাসেন, ‘শব্দগুলো আমার হাতে জলপাইয়ের ফুলের মতো ফুটছে।’
মেয়েটির চোখে অবাক দৃষ্টি।
হঠাৎ রাস্তা ধসে যায়, নীল আকাশের ফাটলে ঝরে পড়ে জ্যামিতিক আকারের তারা।
মেয়েটির হাতে থাকা বই দুটি উড়ে যায়, পাতাগুলো বাতাসে নাচতে থাকে, লেখাগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে।
একটি বর্ণমালা গাছ হয়ে মাটিতে গেড়ে যায়, অন্যটি পাখি হয়ে উড়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এই দেখো, শিক্ষা কোথায় লুকিয়ে আছে।’
মেয়েটি হতবাক, তার বই দুটির পাতাগুলো আর ফিরে আসে না।
শুধু একটি প্রশ্ন বাতাসে ঝরে: ‘কবে বুঝবো, সত্যিকারের শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে নেই?’

শিক্ষা একটা সোনার ডিম, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকগুলো খাঁচা!

কবিগুরুর সর্বব্যাপী পদচিহ্ন

কবিগুরুর পদচিহ্ন জ্যামিতিক স্বপ্নের মতো -
হোয়াইট হোলের চতুর্মুখী খাঁজে আঁকা,
কৃষ্ণগহ্বরের অতল গহনে গিয়ে মিলিয়ে যায়।

বিশ্বময় মানচিত্রে তাঁর পদধ্বনি -
ডিজিটাল বাইনারির জটিল তালে,
কিংবা মৃত প্রবালদ্বীপের নিঃশব্দে।

কবিগুরুর পদচিহ্ন জ্যামিতিক স্বপ্নের মতো -
আকাশের বুকে টানা অসম্ভব সিঁড়ি,
যা ছুঁয়ে যায় মঙ্গল গ্রহের লাল মাটি,

কিন্তু নামে ঢাকার অলিগলি, লন্ডনের কুয়াশা মেশানো রাত্রি।
বিশ্বময় মানচিত্রে তাঁর পদধ্বনি।

অদেখা হৃদয়

এক জীবন, কত অবহেলা ধারণ করতে পারে?
নীরবতায়, বেদনা সাহসী হয়ে ওঠে।
কেউ কি সহ্য করতে পারে এমন এক শীতল জীবন,
এক জীবন, কত অবহেলা ধারণ করতে পারে,
যেখানে প্রেম এক অকথিত গল্প,
এবং হৃদয় কেবল এক আকাঙ্ক্ষিত ছাঁচ?
এক জীবন, কত অবহেলা ধারণ করতে পারে?
নীরবতায়, বেদনা সাহসী হয়ে ওঠে।

হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখলাম পাথর ভাঙতে

অসম্ভবের স্বাদ নিয়েই বাঁচা যায়, জানি।

পাথরের বুকে ছেলেটার হাতুড়ি পড়লো, একবার, দুইবার, তিনবার...
কিন্তু পাথর অটল, শুধু চিকন ফাটল।
ছেলেটা হাঁপিয়ে উঠলো, ঘামে ভিজে গেলো।
তখনই পাথরের ফাটল দিয়ে একটা সাদা তরল পদার্থ বের হতে লাগলো।
নরম, ঝরঝরে, মিষ্টি গন্ধে ভরা।
ছেলেটা চমকে উঠলো। কখনো এমন দেখেনি সে।
হাত বাড়িয়ে আঙুলের ডগায় একটু নিল, জিভে পরখ করল।
মিষ্টি, ঠান্ডা, অদ্ভুত স্বাদ।
আরও নিতে গেলো ছেলেটা।
হঠাৎ একটা বুড়ি এসে চিৎকার করে উঠল, "কি করছিস? থাম!"
ছেলেটা থমকে গেলো।
"এটা মানুষের দুঃখ," বুড়ি বললো, "তুই ভাঙলি কেন?"
ছেলেটা চোখ কুঁচকে ফেললো। "কিন্তু এত মিষ্টি! এত সুন্দর!"
"মিষ্টি? সুন্দর?" বুড়ি হতাশ হয়ে বলল, "কিন্তু কী হবে জানিস? এখন এই দুঃখ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।"

একটা ভাঙা পাথরের দুঃখ কতটা দূর ছড়িয়ে পড়তে পারে?

নষ্ট হতে হতেই বাঁচি

রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, পকেটে ফুরিয়ে গেছে সব টাকা।
ঢাকার বুকে ডুবে আছে সূর্য, আকাশে জ্বলছে নিয়ন নক্ষত্র।
একটা বিলবোর্ডে বিশাল অক্ষরে লেখা, "অনন্তকালের স্বাদ, এক চুমুকে!"

রিকশাওয়ালার গলায় ভাসে, "কোথায় যাবেন, স্যার?"
আমি হেসে বলি, "যেখানে স্বপ্ন সস্তা, আর মৃত্যু বিনামূল্যে পাওয়া যায়।"

একটা পুরনো সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। দেয়ালে ঝুলছে জীর্ণ হয়ে যাওয়া পোস্টার,
যেখানে নায়িকার চোখে জ্বলজ্বল করে অশ্রু, আর নেচে নেচে হারিয়ে যায় নাচের তালে।
হঠাৎ পোস্টার থেকে ঝরে পড়ে এক টুকরো কাগজ, তার উপরে লেখা, "আমার মৃত্যু হবে নাটকীয়ভাবে, তোমার মতো নয়।"

আমি হেঁটে চলি, পথে পড়ে থাকা সিগারেটের ফিল্টার কুড়িয়ে কুড়িয়ে।
একটা ফিল্টারের ভেতর দেখি একটা ক্ষুদ্রাকার নৌকা ভাসছে, ভেতরে একজন মাঝি বসে গান গাইছে।
গানের কথা ভাসে বাতাসে, "অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো, সূর্যের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে।"

একটা ব্রিজের নিচে এসে দাঁড়াই। নদীর পানিতে ভাসছে অসংখ্য প্লাস্টিকের বোতল,
যেন দল বেঁধে স্বচ্ছন্দে সাঁতার কাটছে। হঠাৎ একটা বোতল থেকে ঝরে পড়ে একটা কাগজ,
তার উপরে লেখা, "আমি বারবার নষ্ট হই, কিন্তু বারবার ফিরে আসি। তুমি কখনো ফিরবে?"

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা বিমান লেখে, "চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া ভালো,
বারবার ফিরে এসে একই স্বপ্ন দেখার চেয়ে।"

আমি হেঁটে চলি, রাত ঢাকার বুকে আরও গভীর হয়ে যাচ্ছে।
আমি কি বারবার নষ্ট হই, শুধু আবার ফিরে আসার জন্য?

হৃদয়ের সোনালি মাছ

সত্যিকার প্রেমের ফল নেওয়া যায় না,
শুধু গন্ধ নেওয়া যায়।
মনের গভীরে লুকিয়ে থাকে তার স্পর্শ,
অদৃশ্য তারা, অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো।

বুড়িগঙ্গার বুকে ডুবুরি ডুব দিয়ে খুঁজে ফিরেছি
তার হৃদয়ের সোনালি মাছ।
জলের তলায় হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির খোঁজে,
বুক ভরা অশ্রু নিয়ে ডুবেছি অতলে।

রাতের আকাশে তারার চিঠি লিখে পাঠিয়েছি
মেঘের বেলুনে।
কালো আকাশে ঝলমলে তারার আলোয়,
লিখেছি আমার অপূর্ণ প্রেমের কাহিনি।

শহরের নবনির্মিত কাঁচের আকাশচুম্বী ইমারতগুলো সাক্ষী,
আমাদের প্রেমের অতিমানবীয় ভাষা।
কিন্তু কাঁচের দেয়ালের ভেতরে,
হারিয়ে যায় অন্তরের অনুভূতি।

একটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে
তার চোখের আলোকবর্ষ।
ভার্চুয়াল জগতের মায়ায়,
আমাদের প্রেম হারিয়ে যায় অন্ধকারে।

আমরা দু'জনে মিলে একটা কৃত্রিম সূর্য গড়েছি,
যা শুধু আমাদের দু'জনের জন্যই আলো দেয়।
কিন্তু সূর্যাস্তের আলোয়,
হারিয়ে যায় আমাদের স্বপ্নের রঙিন রঙ।

কিন্তু আজ, সকালের কুয়াশার মতো হঠাৎ করেই তার মুখে প্রশ্ন -
"যাওয়ার সময় হয়েছে, তাই না?"

সত্যিকার প্রেমের গল্পের শেষ হয় না,
শুধু অন্য কোনো মাত্রায় চলে যায়।
হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকে তার স্মৃতি,
অদৃশ্য তারা, অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো।

বৈশাখের প্রশ্ন

রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময়
একটি পুরানো পোস্টারে চোখ পড়ে
কালো-সাদা, ঝাপসা ছবিতে
হাতে লাল পতাকা নিয়ে হাজারো মানুষ।
তারা কোথায় যাচ্ছে? কী চায়?

মেঘের গর্জনের আওয়াজে
মনে হয় যেন পুরানো গানের সুর।
একটি বিশাল বটগাছের নীচে
বসে আছেন এক বৃদ্ধ।
তার হাতে একখণ্ড লাল কাপড়,
তিনি কি তা সেলাই করছেন?

হঠাৎ ঝড় উঠে, পুরানো পোস্টারটি উড়িয়ে নিয়ে যায়,
বৃদ্ধের হাত থেকে লাল কাপড়টিও উড়ে যায়,
আকাশে মিশে যায় লাল পতাকার সাথে,
বৃদ্ধের চোখে অবাক দৃষ্টি।

কী খোঁজে এই বৈশাখের বিকেলে -
এই লাল পতাকা, এই গান, এই বৃদ্ধ?
আমরা কি কোনো স্বপ্নের মধ্যে আছি,
নাকি স্বপ্নের বাইরে?

শ্রমিক দিবসের প্রশ্ন

স্বপ্নের নগরীতে ঘুমন্ত শ্রমিকেরা,
কালো আকাশে ঝলমলে তারারা।

হাওয়ায় ঝুলছে লাল পতাকা,
কিন্তু আকাশ কালো।
শ্রমিকের হাতে কলম,
কিন্তু কালি নেই।
মাঠে ধানের চারা,
কিন্তু শস্য নেই।
শহর গগনচুম্বী,
কিন্তু ভিতরে শূন্যতা।

একটি কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছে,
কিন্তু সেখানে কোনো শ্রমিক নেই।
শুধু একটি যন্ত্রের গান,
যা বলে, "আমি কাজ করি, তুমি কেন?"

রাস্তায় শ্রমিকের মিছিল,
কিন্তু কোথাও পায়ের ছাপ নেই।
সময় ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে,
কিন্তু কেউ সময় দেখছে না।
শ্রমিকের কাঁধে বোঝা,
কিন্তু সে জানে না কী বহন করছে।

মে দিবসের পতাকা উড়ছে,
কিন্তু কেউ জানে না কেন।
শ্রমিকের চোখে প্রশ্ন,
"আমি কে? আমি কোথায়?"

শ্রমের গান হারিয়ে গেছে অন্ধকারে,
শুধু প্রশ্নের সুর বাজছে বাতাসে।

সূর্যালোকে ঝরানো প্রশ্ন

সূর্যালোকে ঝরে পড়ে প্রশ্ন,
মৃদু বাতাসে ফিসফিস করে বসন্ত,
"কবে ফুটবে প্রথম মাধবী?"

গাছের ডালে বসে একা পাখি,
গুনগুন করে জিজ্ঞাসা করে,
"কবে ফিরবে তার সঙ্গী?"

আকাশের ঝরনা ঝরে নদীর বুকে,
নদী বয়ে বয়ে প্রশ্ন করে,
"এত জল, কোথায় যায় শেষে?"

শহরের গলির অন্ধকারে,
কেউ একজন হাত বাড়িয়ে জানতে চায়,
"আমি কি কখনো সুখ পাব?"

মাটির ঘরে বসে, উষ্কখুষ্ক চুলের ঠাকুরমা,
ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেন,
"আমার ছেলে কি ফিরবে?"

অসুস্থ শিশু চোখে জল নিয়ে জানতে চায়,
"মা, আমি কি আর সুস্থ হব না?"

***

প্রশ্নেরা ভাসে বাতাসে,
মিশে যায় মেঘের সঙ্গে,
ডুবে যায় সমুদ্রের গভীরে।

কোনো উত্তর নেই,
কেবল সূর্যালোক ঝরে ঝরে পড়ে।

কিন্তু সেই সূর্যালোকেই ফোটে লাল গোলাপ,
গান গায় শালিক,
সিংহাসনে বসে রাজা।

সেই সূর্যালোকেই ঝরে পড়ে কুয়াশা,
ভেঙে যায় অন্ধকার,
জ্বলে ওঠে আশা।

হয়তো প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই,
কিন্তু প্রেমই সব প্রশ্নের জবাব।

***

প্রেম ফোটে মাধবীর মুকুলে,
ফিরে আসে পাখি,
মিশে যায় নদীর জল সমুদ্রে।

প্রেম জ্বলে শহরের গলিতে,
আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে ছেলে,
আর সুস্থ হয়ে ওঠে শিশু।

সূর্যালোকে ঝরানো প্রশ্নেরা
হয়তো কোনোদিন মিটবে না,

কিন্তু প্রেমের আলোয় সেই প্রশ্নেরা
হয়ে ওঠে গান,
হয়ে ওঠে আশা,
হয়ে ওঠে জীবন।

প্রেমই সব প্রশ্নের জবাব,
প্রেমই জীবনের শ্রেষ্ঠ সুর।

অসম্পূর্ণ মুক্তির ক্রন্দন

পতাকা দিয়াছ বহিবারে
শক্তি কোথায় পাই?
রক্ত ঝরে বারে বারে
মুক্তি কোথাও নাই!

মত্ত ক্ষুধায় দুষ্ট থাবা
দশন চলে সঙ্গোপনে,
বসে বসে মিছেই ভাবা
নেশায় বুঁদ অনশনে।

বিত্ত মালিক নক্তচারী,
নষ্ট দেহ বাস হারায়,
কানীন ছেলে রাতভিখারি
মানচিত্র ছিঁড়ে খায়।

কর্ম ফেলে ধর্ম ধরে
উল্লাসিত পিশাচ মন,
বুদ্ধিজীবী খুঁট হেঁচড়ে
কোথাও খোঁজে নির্বাসন।

শূন্য যত বক্ষগুলি
ডুকরে কাঁদে সম্বরণে,
ধন্য সব মুখের বুলি
নিয়তি যার বিস্মরণে!

বিলুপ্তির নীল জল

আমরা বুঝতে পারিনি আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।

এখনও নদী বয়ে যায়, ঢেউ খেলে ঈশান কোণে,
কিন্তু মাছরা আর নেই, শুধু পলিথিনের মৃতদেহ ভাসে।
কাঁঠালগন্ধে ভরা বাতাস এখন বিষাক্ত ধোঁয়ায় ডুবে আছে,
আমরা নিশ্বাস নিয়ে নিজেদের মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানাই।

রাস্তায় দৌড়োয় না আর ছেলেমেয়েরা,
হাতে তাদের বৃদ্ধির গতি থামানোর ডিজিটাল চাবি।
আকাশ আর নীল নেই, একটি বিশাল এলসিডি স্ক্রিন,
যেখানে বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না,
এমনকি সূর্যও।

শহরের চারপাশে গজিয়ে উঠেছে কংক্রিটের জঙ্গল,
গাছগুলো নির্বাসিত, পাখিরা হারিয়ে গেছে কোন অজানা ঠিকানায়।
আমরা থাকি বাতানুকূল ঘরে, তাপ নিয়ন্ত্রণে,
কিন্তু বাইরের দুনিয়া যে জ্বলছে, তা আমাদের জানা নেই।

শব্দ দূষিত হয়েছে, ভাষা হয়েছে বিলুপ্ত প্রজাতি,
আমরা আর কাউকে ভালোবাসি না, শুধু ইমোজির মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করি।
সম্পর্কগুলো অ্যাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ,
স্পর্শ হয়েছে একটি বিস্মৃত স্মৃতি।

এই বিলুপ্তির নীল জলে আমরা সাঁতার কেটে চলেছি,
মনে করছি এটাই স্বাভাবিক, এটাই জীবন।
কিন্তু মাঝে মাঝে, কোনো অচেনা দুঃখ গলা টিপে দেয়,
একটি স্বপ্নের মতো মনে হয়, যেখানে গাছ ছিল, পাখি ছিল,
মানুষেরা একে অপরের চোখে চোখ রেখে কথা বলত।

কিন্তু সে স্বপ্ন আর ফিরে আসবে না,
আমরা সব কিছু ধ্বংস করে ফেলেছি,
এখন শুধু এই নীরব, নিশ্বাসহীন জলের মধ্যে থাকতে পারি।

এই হল আমাদের শেষ নিশ্বাস, আমাদের চূড়ান্ত বিলুপ্তি।

মধ্যরাতের স্টেশনে নিঃশব্দ ট্রেনের স্বপ্ন

এমন কিছু দিন আছে, যখন শুধু তোমাকেই দেখতে ইচ্ছে করে,
কিন্তু তুমি কোন স্টেশনে নেই, কোন ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে নেই।
তুমি আছ বিধ্বস্ত সার্চ ইঞ্জিনের কোন অদম্য ফলাফলে,
হারিয়ে যাওয়া লিঙ্কের অপর প্রান্তে, ভাঙা ওয়েবসাইটের জঞ্জাল কোডে।
এই দিনগুলোয় শহর জেগে ওঠে সুপারসনিক গতির ট্র্যাফিক জ্যামে,
হর্নের সিম্ফনি আর নিষ্ক্রিয় অ্যাম্বুলেন্সের ঝলকানি আলোয়।
আমার বুকের ভিতর চলে এক অবিরাম সার্চ,
তোমার নাম জপতে জপতে, অতীতের কোন পোস্টের কমেন্টে,
কোন ফেসবুক লাইভের হারিয়ে যাওয়া স্ট্রিমিংয়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াই।
কিন্তু তুমি শুধুই একটি অব্যবহৃত হ্যাশট্যাগ,
ডিজিটাল যুগের বিলুপ্ত প্রজাতির মতো হারিয়ে যাওয়া প্রোফাইল পিকচার।
এই দিনগুলোয় রাত্রি আসে ভাঙা সফটওয়্যারের মতো,
ক্র্যাশ হয়ে যায় সব স্মৃতি, সব আশা।
আকাশ জুড়ে ঝুলে থাকে অসংখ্য নোটিফিকেশন,
কিন্তু তোমার কোনো মিসড কল, কোনো পড়া-যায়-না মেসেজ নেই।
আমি ভাসি ইন্টারনেটের অতল গভীরে,
ডুব দিই অজানা ফোরামের থ্রেডে,
খুঁজি তোমাকে কোনো গোপন চ্যাট রুমে, কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়েবসাইটে।
কিন্তু তুমি শুধুই একটি স্পাম মেইল,
ডিলিট করার আগে শেষবারের মতো চোখে পড়া অসঙ্গত লাইন।
এমন কিছু দিন আছে, যখন শুধু তোমাকেই দেখতে ইচ্ছে করে,
কিন্তু তুমি কোনো স্ক্রিনে নেই, কোনো ওয়াইফাই সিগনালে নেই।
তুমি আছ মধ্যরাতের স্টেশনে নিঃশব্দ ট্রেনের স্বপ্নের মতো,
হাতছানি দেওয়া, কিন্তু কখনো না-থাকা স্টেশনে, কখনো না-আসা ট্রেনে।

মরুভূমির ফুল

বৃষ্টি না নামুক, এই আমার অভিশাপ -

যেন দেশটা এক বিশাল সূর্যঘড়ির নিমন্ত্রণে
জলছায়াহীন দুপুরে আটকে যায়,
সময়ের ধমনি ক্ষীণ হয়ে চুপসে যায়।

মাটি ফাটুক,  খোলা চিঠির মতো,
যেখানে লেখা থাকে জ্বালা ধরানো রোদের গল্প,
নির্মম সৌন্দর্যের এক মন্ত্র।

কোনো নদী থাকবে না, শুধু ঢেউ খেলানো ধূলির স্রোত,
লোহার সাপের মতো
এই বালুচরে গা এলিয়ে চলবে।

গ্রামগুলি হলোগ্রামের স্বপ্নের মতো
মরীচিকার ঝলমলানিতে ভাসবে।
নির্বাসনের এই মরুভূমিতে,
কিংবা জন্মভূমির নতুন রূপে,
উঠবে অজানা ফসলের চিন্তা,
লোহিত্য আকাশের নিচে।

শকুনের চিৎকার আর মৃগয়ার তীরের স্বরে
মুখরিত হবে এই নতুন আরব্য রাত্রি।

সূর্যের প্রথম স্পর্শে শিয়ালের হাসি মিলিয়ে যাবে,
কিন্তু কী নিয়ে আসবে এই নতুন সকাল?

জানি না, কিন্তু চাই এই চিরন্তন সবুজের পরিবর্তে,
এক এপ্রিলের ঝলসানো দুপুরের মতো
এক মুঠো বালি,
যেখানে লাইকেনরা লিখবে নতুন ইতিহাস,
এই বৃষ্টিবিলাপী মাটির পিঠে।

আমার দেশ, তোমাকে আর চিনি না,
এই  খোলা আকাশের নিচে।

ভালোবাসার কারণ

কে জানে রহস্য, কেন আসে ভালোবাসা?
হৃদয়ে কেন জাগে অজানা বেদনার তীব্রতা?
চোখে কেন অশ্রু ঝরা, মনে কেন ব্যথা?
এই প্রশ্নের উত্তর কি আছে কারো জানা?

"ভালোবাসি কেন?" তুমি যদি জিজ্ঞাসো,
কিভাবে দেবো উত্তর আমি?
কবির কলমে কি লেখা যায়,
রঙের বর্ণিকায় কি ফোটানো যায়,
সুরের ঝংকারে কি বাজানো যায়,
ভালোবাসার এই অনন্ত গল্প?

সূর্যের আলো কেন পৃথিবীকে আলোকিত করে?
চাঁদের জ্যোৎস্না কেন সন্ধ্যাকে করে মায়াবী?
নদীর স্রোতোধারা কেন ছুটে চলে সাগরের বুকে?
পাখি কেন গান করে?
যেমন কঠিন এসব প্রশ্নের উত্তর,
তেমনি কঠিন তোমাকে ভালোবাসার কারণ বলাও।

তোমার চোখের আকাশে যখন আমি নিমগ্ন হই,
মনে হয় সেখানেই আমার বাসস্থান।
তোমার হাসির ঝলকানি যখন আমার হৃদয় স্পর্শ করে,
মনে হয় সেখানেই আমার বেঁচে থাকা।
তোমার কথার মধুর সুর যখন আমার কানে পৌঁছায়,
মনে হয় সেখানেই আমার শান্তি।
তোমার স্পর্শের উষ্ণতা যখন আমার অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে,
মনে হয় সেখানেই আমার ভালবাসা।
কথায় বলা অসম্ভব তোমাকে ভালোবাসার কারণ,
কারণ তুমি হয়ে গেছ আমার অস্তিত্বের অবিভেদ্য অংশ।

তাই শুধু বলি, ভালোবাসি তোমাকে,
সারাজীবন, নিশ্বাসের প্রতিটি ক্ষণে।

মেঘের রাজ্যে প্রেমের কথা

মেঘের রাজ্যে স্বপ্নের বীণা বাজে,
অনন্ত নীলের সাথে প্রেমের আলাপ জাগে।

মেঘের রাজ্যে একটা বাড়ি কিনলাম,
ঈশ্বরের কাছেই,
তার সঙ্গে প্রেম নিয়ে কথা বলার জন্য।

মেঘের রাজ্যে আমার বাড়িটি স্বচ্ছ কাচের তৈরি,
যেখান থেকে চারদিকে মেঘের সাদা সমুদ্র দেখা যায়।
আমার বাড়ির উঠানে একটা মেঘের ঝুলন রয়েছে,
যেখানে বসে আমি ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেম নিয়ে কথা বলি।

আমি ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করি,
"প্রেম কী?"
ঈশ্বর বলেন,
"প্রেম একটা অনুভূতি, একটা আবেগ, একটা অভিজ্ঞতা।
প্রেম দিয়েই জগৎটা সৃষ্টি হয়েছে, প্রেম দিয়েই জগৎটা চলে।"

আমি ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করি,
"সত্যিকারের প্রেম বলতে কী বোঝায়?"
ঈশ্বর বলেন,
"সত্যিকারের প্রেম হলো নিঃস্বার্থ প্রেম, শর্তহীন প্রেম।
সত্যিকারের প্রেমে কোনো আশা নেই, কোনো ভয় নেই, কোনো সন্দেহ নেই।"

আমি ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করি,
"প্রেম কীভাবে পাওয়া যায়?"
ঈশ্বর বলেন,
"প্রেম পাওয়া যায় হৃদয় খুলে দিয়ে, সত্যিকারের হয়ে গিয়ে।
প্রেম পাওয়া যায় আরেকজনকে বুঝে, আরেকজনকে মেনে নিয়ে।"

আমি ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করি,
"প্রেম কীভাবে রাখা যায়?"
ঈশ্বর বলেন,
"প্রেম রাখা যায় বিশ্বাস করে, সম্মান করে, ভালোবাসার মানুষটাকে মুক্তি দিয়ে।"

আমি ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করি,
"প্রেমে ভরা জীবন কীভাবে পাওয়া যায়?"
ঈশ্বর বলেন,
"প্রেমে ভরা জীবন পাওয়া যায় প্রেম দিয়ে, প্রেম দিয়ে, প্রেম দিয়ে।"

মেঘের রাজ্যে আমার বাড়িটি স্বচ্ছ কাচের তৈরি,
যেখান থেকে চারদিকে মেঘের সাদা সমুদ্র দেখা যায়।
আমার বাড়ির উঠানে একটা মেঘের ঝুলন রয়েছে,
যেখানে বসে আমি ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেম নিয়ে কথা বলি।

আমি ঈশ্বরের কাছে প্রেম নিয়ে কথা বলি,
কারণ আমি বিশ্বাস করি,
প্রেমই হলো জগতের সবচেয়ে বড় শক্তি।
প্রেমই হলো জগতের সবচেয়ে বড় সত্য।

ঈশ্বরের স্পর্শে হৃদয় হয় উন্মুক্ত,
প্রেমের সুরে জীবন হয় সুন্দর, পূর্ণ।

সাতই মার্চের গান

কত কাল ধরে চোখে জল, কত কাল ধরে বেদন,
কত কাল ধরে অত্যাচার, কত কাল ধরে শোষণ।
কত কাল ধরে অপেক্ষা, কত কাল ধরে ক্ষোভ,
স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে, কত কাল ধরে রোদ।

ঢাকার আকাশে অগ্নি জ্বলে উঠেছে,
সাতই মার্চ, সূর্য নয়, রক্তিম অগ্নিকাণ্ড।
হাওয়ায় দপদপানি, গাছের পাতায় কান্না,
মাটির শহরে কী এক আশা, কী এক বেদনা।

সকালের সূর্য লাজুক, লুকিয়ে আছে মেঘের আড়ালে,
কিন্তু জনতা জমাট, ময়দানে ঢেউ খেলে চলে।
বাংলা মায়ের কোলে কোলে, লাখো লাখো মানুষ,
এক মুখেই ধ্বনি, "মুজিব! মুজিব!"

ঢাকার বুকে লেগেছে আগুন,
বাংলার চোখে জ্বলে উঠেছে বিদ্রোহের সূর্য।
মঞ্চের সামনে শুভ্র পায়রা,
বাতাসে লেগে আসে স্বাধীনতার গন্ধ।

কবির কবিতা নয়, শিল্পীর চিত্র নয়,
এই দিন লিখছে ইতিহাস, নিজের কলমে লেখা কথা।
হাজার বছরের দাসত্বের শিকল ভাঙতে,
বাঙালি জাতি আজ দাঁড়িয়েছে মাথা উঁচু করে।

হঠাৎ...

জনগণের মুখে এক নিশ্বাস,
মঞ্চে আসেন বঙ্গবন্ধু, সোনালি রোদের মতো ঝলমলে।
নিঃশব্দ কয়েক মুহূর্ত, তারপর
মাইক্রোফোনে গর্জে ওঠে ঐতিহাসিক সেই ভাষণ।

"আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।"
কথাগুলো ঝড়ের মতো ছুটে যায় জনতার মাঝে,
শত শত বছরের অভিমান, জ্বলে ওঠে বুকে।

"আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন।"
শব্দে শব্দে জাগে ঐতিহাসিক নির্যাতনের কাহিনি,
মা, বোন, মেয়েদের চোখের জল, শহিদদের রক্তাক্ত মাটি।

"আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে..."
শহরের নাম উচ্চারণে কাঁপে জনগণের হাত,
বেদনার তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে।

"আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।"
ধানের শীষ, নদীর স্রোত, মেঘের গর্জন,
বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে মিশে গায় স্বাধীনতার গান।

"সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।"
মঞ্চের নিচে, মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসা শিশু,
তার চোখে জ্বলে ওঠে অপার বিশ্বাস।

"আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।"
বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ, আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেয়,
কান্না মিশে যায় স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞায়।

"এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্।"
স্বপ্নের দেশে, স্বাধীনতার গান,
গাইবে সকলে, হবে না আর কোন অভিমান।
মুক্তির আকাশে, উড়বে রঙিন পাখি,
এ দেশের মানুষ, হবে সুখী।

"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
যে কথা শতাব্দীর বন্দি, শৃঙ্খলে জড়িত স্বপ্ন,
সেই কথা বাজল বাঁশিতে, বীরের অগ্নি-কণ্ঠে।
প্রতিটি শব্দ, মুক্তির মন্ত্রের মতো জপে জনতা,
ঊর্ধ্বগত হাত, করে শপথ, জেগেছে স্বাধীনতার প্রভাত।
এই আহ্বানে বুক ঝনঝন করে, রক্তে জোয়ার আসে,
স্বাধীনতার সুর গেয়ে ওঠে, আকাশে ধ্বনি বাঁধে।

সূর্য উঁকি দেয় মেঘের ফাঁক দিয়ে,
রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার আকাশে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু, হাত বাড়ান ঊর্ধ্বে,

"জয় বাংলা!"
"জয় বাংলা!"

ধ্বনি ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছুটে চলে চার দিকে,
স্বপ্নের ডানায় ঝরে পড়ে এক মুঠো নক্ষত্র,
জ্বলন্ত আকাশে লেখা হয় অসমাপ্ত কবিতা,
ভাঙা তবলার সুরে গাওয়া হয় বিদ্রোহের গান,
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা।

শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, নারী - সবাই এক সাথে,

"জয় বাংলা!"
"জয় বাংলা!"

হাতে হাত, মিলে কাঁধ, প্রতিজ্ঞার পথে এগিয়ে চলে,
স্বাধীনতার সূর্য, উঠবে ঢাকার আকাশে।
মঞ্চের চারপাশে ঢেউ খেলে জনতা,

"মুজিব! মুজিব!"
"মুজিব! মুজিব!"

বাংলার মুক্তির স্বপ্ন, আর থামানো যায় না,
সাত মার্চের এই ঐতিহাসিক দিন,
লিখে দিল বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন পাতা।

ঢাকার আকাশে সূর্য জ্বলজ্বলে,
স্বাধীনতার সোনালি আলোয় জেগেছে জনতা।

চোখে জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন, মুখে মুক্তির গান,
বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমন্ত্রে আজ দীক্ষিত সব প্রাণ।
হৃদয়ে সাহসের নেশা, হাতে বীরের তলোয়ার,
শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই, স্বাধীনতার নতুন দ্বার।

অদূরে, অস্পষ্ট আলোয় ঝলমলে,
স্বপ্নের বাংলাদেশ, স্বাধীনতার নগরে।
বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে, বীরের বীণায়, বাজে মুক্তির সুর,
স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে, বাংলাদেশ চলেছে দূর।

কত যুদ্ধের রণক্ষেত্র, কত রক্তের নদী বয়েছে,
কত স্বপ্ন ভেঙে গেছে, কত আশা ধূলিসাৎ হয়েছে।
কিন্তু বাঙালির মহাকাব্যে বিজয়ের শঙ্খ বাজে,
বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনতার সূর্য জ্বলে।

ভোরের সবুজ ঘাসে ঝিলিক দেয় শিশির বিন্দু,
সোনালি রোদে ঝলমলে নবীন ধানের ক্ষেত।
নদীর তীরে, শ্যামল বনানী,
কুহুতানে মুখরিত, পাখির কলতানে।

মুক্তির আনন্দে আজ গান গায় কৃষক,
শ্রমিকের মুখে হাসি, উৎসবের আবেশে।
শিশুরা স্বাধীন আকাশে উড়ায় ঘুড়ি,
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

বিস্ময়ের ডানায় উড়ে যাই, অসম্ভবের নীড়ে বসি,
স্বপ্নের চেয়েও সত্যি, বাংলাদেশের এই স্বপ্ন-ভূমি।

অমর একুশে বইমেলা

স্বপ্নের বাজারে জ্ঞানের মেলা,
কল্পনার রঙে লেখা অজানা গল্পের খেলা।

এখানে স্বপ্ন বিক্রি হয় না, বিক্রি হয় শব্দ,
প্রতিটি শব্দে এক অজানা দেশের খোঁজ।
মুক্ত স্বাধীনতা, অসম্পূর্ণ প্রেমের গান,
বাজে ঢোল ও শাঁখ, বই হাতে হাত রেখে নাচে জনতা।

কত শতাব্দীর বন্দি ভাবনা, আজ মুক্তির আকাশে,
উড়ে বেড়ায় কত রঙিন স্বপ্নের পাখি।
কত লেখকের কলমের স্পর্শে, জীবন্ত হয়ে ওঠে,
ইতিহাসের মৃত প্রতিমা, অজানা কাহিনি।

এখানে ঋষির গান, কবির কবিতা,
বীরের বীরগাথা, মুক্তির আহ্বান।
এখানে রহস্যের গল্প, অশরীরীর স্পর্শ,
অজানার আকাশে নতুন নক্ষত্রের আলো।

কত লেখকের ঘর্মাক্ত কপালে, জ্বলে আজ স্বপ্নের দীপ,
কত শিল্পীর রঙিন তুলির টানে, ফুটে ওঠে নতুন রূপ।

এখানে জ্ঞানের আলো, বিজ্ঞানের বর,
শিল্পের সৌন্দর্য, সংস্কৃতির ঐশ্বর্য।
এখানে মানুষের মুক্তি, নতুন জীবনের সূচনা,
ভালোবাসার জয়গান, শান্তির আহ্বান।

কত গান, কবিতা, উপন্যাসের পাতায়,
জীবন্ত হয়ে ওঠে, অজানা কত ইতিহাস।

এখানে বিক্রি হয় জ্ঞানের আলো, অন্ধকার দূর করার,
এখানে বিক্রি হয় সাহসের গান, ভীতুদের সাহসী করার।
এখানে বিক্রি হয় ভালোবাসার কবিতা, বিদ্বেষের বিষ ঝরার,
এখানে বিক্রি হয় মানুষের গান, পৃথিবীকে সুন্দর করার।

কত পাঠকের আগ্রহী দৃষ্টিতে, খুঁজে মেলে নতুন স্বপ্ন।

এখানে বিক্রি হয় না মিথ্যা, বিক্রি হয় সত্য,
এখানে বিক্রি হয় না লোভ, বিক্রি হয় ত্যাগ।
এখানে বিক্রি হয় না বিদ্বেষ, বিক্রি হয় ভালোবাসা,
এখানে বিক্রি হয় না মৃত্যু, বিক্রি হয় অমরত্ব।

এখানে বিক্রি হয় বাংলার স্বপ্ন, বাংলার গান,
এখানে বিক্রি হয় বাংলার আত্মা, বাংলার প্রাণ।
কিন্তু বিক্রি হয় না বাংলার মাটি, বাংলার মানুষ,
যারা তাদের রক্তে লিখেছে, এই একুশের গান।

এখানে মুক্তির পতাকা উড়ে, ঝড়ো হাওয়ায়,
কত শহীদের রক্তে রাঙা, এই মাটির গায়।
এখানে গানের ঝঙ্কার ওঠে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে,
মানুষের অধিকারের গান, বেদনার অভিশাপে।

এখানে আলোর বিচ্ছুরণ, জ্ঞানের সূর্যোদয়,
অন্ধকারের কুয়াশা ভেদ করে, সত্যের দ্যুতি ছড়ায়।
এখানে বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে আসে, নতুন ভাবনার ঝরনা,
মানুষের মুক্তির গান গেয়ে, পৃথিবীকে করে পূর্ণ।

এখানে একুশের গান গেয়ে, লেখক, কবি, পাঠক,
সকলে মিলে এক সুরে গায়, বাংলার জয়গান।
এখানে বইমেলার মাঠে, জ্ঞানের আলোয় ঝলমল করে,
বাংলার নবজাগরণের সূচনা, নতুন ভোরের আলোয়।

এভাবেই চলবে চিরকাল, জ্ঞানের এই মহাযজ্ঞ,
বাংলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে, বাংলার মানুষের গান।
অমর একুশে বইমেলা, জ্ঞানের আলোর দিপ্ত শিখা,
বাংলার সংস্কৃতির প্রতীক, অমলিন স্মৃতির স্তূপ।

বইয়ের পাতায় বাংলার মুখ, জ্ঞানের সাগরে ভেলা,
সবাই মিলে ধরো সুর, জয়বাংলা, জয় বইমেলা।

ধূসর আকাশের নিচে

সময়ের বালিয়াড়ি, জীবনের ধাপে,
কত যুগ ধরে বেদনা সইছে এই ক্ষীণ প্রাণে।

কে আর রাখে হিসাব, কত দিনের তাপ,
লোনা ঢেউ খেলেছে, মরুভূমির ধাপ।
জ্বলন্ত বাতাসে কাঁপছে পাতা,
ধূসর আকাশের নিচে মৃত প্রাণের ছায়া।
কালো ধোঁয়ার আবরণে শহর ঢাকা,
জীবনের স্পন্দন স্বপ্নের সুর হারা।

একাকী কাক, ক্লান্ত পাখনা,
অন্ধকারে ডুবে থাকে তার অশ্রুজলের কথা।
কোথায় পানি? কোথায় জীবন্ত স্রোত বহে?
ফেটে যায় তার আশার বীজ অঙ্কুর শুকনো মাটিতে।
জীর্ণ ডানা ঝাপটে, খুঁজে বেড়ায় সে,
এক ফোঁটা জলের জন্য, একটু সবুজের স্পর্শে।
দূরের আকাশে মরীচিকা ঝিকিমিকি করে,
তৃষ্ণার্ত কাক ছুটে যায়, ধীর পদক্ষেপে, ধীর আবেশে।

কিন্তু হতাশার আঘাতে তার স্বপ্ন ভেঙে পড়ে,
আটকে যায় অশ্রুজলের অভিমান, শুকনো ঠোঁটে।
নদী শুকিয়েছে চোখ, পাতালে গেছে স্রোত,
কাঁঠাল গাছের ফাটল, কেবল ফুটেছে রোদ।
ধূসর আকাশের নিচে, ক্লান্ত কাকের দৃষ্টি যায় হারিয়ে,
জীবনের আশা মুছে ফেলে ধূসর আবরণের ছায়া, ধীরে ধীরে।

কে আর রাখে হিসাব, কত দিনের তাপ,
লোনা ঢেউ খেলেছে, মরুভূমির ধাপ।
শুধু ধ্বংসের সুর বাজে, ধূসর আকাশের নিচে,
শুধু মৃত্যুর আগুনের ঝিলিক জ্বলে একাকী কাকের চোখে।

অন্ধকারে ডুবে, হারিয়ে সব আশা,
শুধু ধূসর নীরবতা, জীবনের শেষ বার্তা।

নিঃস্ব অভিব্যক্তি

প্রিয় ইরা,

নিশীথের নিবিড় আঁধারে, চাঁদের মৃদু আলোয় সজল,
লিখি এ কথা, মম প্রেমের জ্যোতির্ময় স্বাক্ষর জ্বলজ্বল।
যেমন অবিরাম তরঙ্গমালা চুম্বন করে ধীর তীর,
তেমনি আমার হৃদয় তোমায় ডাকে, তোমারি প্রেমে হয় অধীর।

কারণ তুমিই আমার জীবন সঙ্গীতের সুর,
বিশ্বের কলহের মাঝে এক স্বর মধুর।
প্রতিটি স্পন্দনে আমি তোমারে ঢালি এ প্রেম,
নিখাদ ও সত্য, তুমি আমার জীবনের অপার আনন্দের হেম।

তাই জিজ্ঞেস করি, এক অবিরাম আশা নিয়ে,
আমার বেদনার সঙ্গী হবে কি তুমি, হে প্রিয়ে?
উত্তরটি নিঃশব্দ গানের মতো তোমার হৃদয়ে নিহিত,
ইরা, তোমার প্রেম কোথায় নিবেদিত?

ইতি
প্রেমিক হতে চাওয়া কবি

__________________________________

প্রিয় কবি

তোমার কথা, অন্ধকারে জোনাকির মতো নাচে,
আমাদের বন্ধুত্বের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে, আশার মাঝে।
তোমার প্রেম, এক নদী, গভীর ও বিস্তৃত,
কিন্তু বন্ধুর ভূমিকায়, আমি অটল ও স্থিত।

কারণ আমার জীবনের বাগানে তুমি এক মধুর ফুল,
দুঃখের অন্ধকার দূর করা সান্ত্বনার গুরিয়া পুতুল।
তবুও, বন্ধু হিসাবেই রাখতে চাই আমি এ বন্ধন,
কারণ সেই আলোকেই তোমাকে দেখি আমি, সর্বক্ষণ।

বেদনা বিসর্জন দাও, না রাখো মনে কোনো বিষাদের ছায়া,
আমাদের মিলনের বন্ধন অটুট, এতে রাখো অবিচল মায়া।
বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে আমরা থাকবো সদা সাথে সাথে,
ঝড় হোক বা রোদ, চিরকাল হাতে হাত রেখে।

ইতি
তোমার বন্ধু ইরা

মহাকালের মঞ্চে

মায়াবী মঞ্চে, কালের নিশ্বাসে,
জীবনের নাটক চলে অবিরাম গতিতে।

কালের কাঠের মঞ্চে, মৃত্যুর কালো পোশাকে,
অভিনয়ের খেলায় আমরা জড়িয়ে আছি।
হাসি, কান্না, রাগের মুখোশ পরে,
নাটকের চরিত্রে আমরা মাত্রই খেলি।

কিন্তু এই নাটকের স্রষ্টা কে?
পরিকল্পনার সুতো কে বুনেছে আমাদের ভাগ্য?
অদৃশ্য সুতোর টানে কে নাচায় আমাদের,
পুতুলের মতো, নিজের ইচ্ছার বাইরে?

জন্মের মঞ্চে প্রবেশ, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস,
মধ্যবয়সের দ্বন্দ্ব, বার্ধক্যের নিঃশব্দ সুর।
একের পর এক দৃশ্যে বদলে যায় চরিত্র,
কখনও রাজা, কখনও ভিখারি, কখনও বিজেতা, কখনও পরাজিত।

কিন্তু এই নাটকের শেষ কোথায়?
অন্তিম পর্দা নামার আগে কি খুঁজে পাব নিজের সত্যিকারের নাম?
না কি চিরকালই থাকবো অজ্ঞাত,
এই বিশাল মঞ্চে অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক ফোঁটা অভিনয়?

তবুও, খেলি, হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি,
এই নাটকের মধ্যেই খুঁজি জীবনের স্বাদ।
কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যাই,
এ মাত্রই অভিনয়, সত্যিকারের জীবন অন্য কোথাও।

হয়তো, আমরাই লিখছি এই নাটকের শেষ,
আমাদের অভিনয় দিয়েই সাজিয়ে দিচ্ছি মঞ্চ।
পরিচালক নেই, নেই সূত্রধার,
আমরাই নাট্যকার, আমরাই অভিনেতা, আমরাই দর্শক।

তাই মঞ্চে দাঁড়িয়ে, মাথা উঁচু করে খেলি,
নিজের গল্প বলি, নিজের সুর গাই।
মহাকালের মঞ্চে, এই ক্ষণিকের অভিনয়েই,
খুঁজে পাই নিজের অস্তিত্বের স্বাক্ষর।

কালের নদীর তীরে, অস্তিত্বের খেলায়,
আমরা সকলেই অভিনেতা, নিয়তির লেখায়।

দুর্নীতির দাস

স্বপ্নের নীল পাখিরা কাঁদে রাতের আকাশে,
মৃত্যুর কালো ঘড়ি বাজে নিঃশব্দে।

রাতের আকাশে কাঠের মুখোশগুলি হাসে,
চাঁদ থামিয়ে দেয় তার কাঁটাঘড়ির কাঁটা।
নিঃশব্দে পচে যাওয়া ফাইলগুলিতে ফুটে ওঠে অশ্রু,
কীটেরা গান গায়, শহর জুড়ে।

কালো নদী বয়ে চলে স্বপ্নের মতো,
কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুধার্ত মানুষেরা, মাছ ধরার জালে।
তোমার হাতে থাকা ক্ষমতার ঢালটি ফুল হয়ে গেছে,
পাপড়ির মতো ভেঙে যাচ্ছে।  

আমরা আগুন জ্বালিয়েছি, তোমার মূর্তি পুড়িয়ে দেওয়ার জন্যে নয়,
এই শহরের বাতাসে যেন সততার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।
নিমগ্ন সূর্য কালো হয়ে ডুবে যায়,
তোমার চোখে জমে থাকে অপমানের ছাই।

কেবল প্রশ্নটা ঝুলছে আকাশে -
দুর্নীতির দাস, কত দূর?

ধূসর আকাশে ঝলমল করে তারা জ্বলে,
কালের চাকা থামে না, ঘুরতেই থাকে।

বিদ্রোহী প্রকৃতি

স্বপ্নের বুদবুদ ভেঙে বিদ্রোহের ডঙ্কা বাজে,
প্রকৃতির ক্রোধে পৃথিবী তোলপাড় করে।

বনের গাছগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে
লোভী কাঠুরিয়াদের অবিচারে
যারা তাদের নির্দয়ভাবে কেটে ফেলে।
গাছগুলো বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
তাদের কাণ্ড ও ডালগুলোয় কাঁটা গজিয়ে।
কাঁটাগুলো এতোই ভয়ঙ্কর
যে কাঠুরিয়ারা আর তাদের কাটতে পারবে না।

দেশের নদীগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে
মানুষ আবর্জনা ও দূষক পদার্থ ফেলায়।
নদীগুলো অম্ল হয়ে গেছে;
ফলে যা কিছু তাদের স্পর্শ করে
তারা তাকে পুড়িয়ে দেয়।
ধোঁয়া আর ছাইয়ের পাহাড়ের পিছনে
নদীগুলো হারিয়ে গেছে।

চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে
লোলুরুপ রক্ষকদের অত্যাচারে
যারা তাদের ক্ষুধার্ত রাখে ও মারধর করে।
প্রাণীগুলো তাদের খাঁচা থেকে বের হয়ে এসেছে,
আক্রমণ করেছে দর্শক ও কর্মীদের
তাদের লাল দাঁত ও নখ দিয়ে।

বাগানের ফুলগুলো ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছে
গোলাপের সৌন্দর্য ও সুগন্ধিতে।
ফুলগুলো গোলাপকে বিষাক্ত করার ষড়যন্ত্র করেছে
তাদের মধু ও পরাগ দিয়ে।
গোলাপগুলো শুকিয়ে গেছে,
বাগানটি হয়ে গেছে ফুলহীন।

আকাশের মেঘগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে
আবহাওয়ার একঘেয়েমিতা ও অভিন্নতায়।
মেঘগুলো প্রতিদিন তাদের আকার ও রং বদলাচ্ছে,
অদ্ভুত ও রূপকথার মতো নকশা তৈরি করছে
যা মানুষদের বিভ্রান্ত ও ভয়ে ভীত করে।

রাতের আকাশের তারাগুলো একাকী ও দুঃখী;
তারা স্বর্গ থেকে পড়ে যেতে চেয়েছে
পৃথিবীতে এমন কাউকে খোঁজার আশায়
যে তাদের ভালোবাসবে।
কিন্তু তারা যেখানে নামে
সেখানেই আগুন লেগে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে।

নিয়ম ভেঙে গেছে,
প্রকৃতি বিদ্রোহ করেছে।

বিপ্লব জয়ী হোক, নতুন সৃষ্টি হোক,
প্রকৃতির কোলে শান্তি আবার ফিরে আসুক।

যুদ্ধক্ষেত্রের গান

স্বপ্নের বুদবুদ ভেসে যায় কালো নীল জলে,
মৃত্যুর রহস্যময়ী হাসি ফুটে ওঠে অন্ধকারে।

আকাশ যেন যুদ্ধক্ষেত্র, মেঘ যেন সৈনিক দল,
সূর্য যেন কামান, চাঁদ যেন বোমা-বল।
হাওয়া যেন বার্তাবাহক, বৃষ্টি যেন অস্ত্র,
মাটি যেন কবর, গাছ যেন শোকাহত।
নদী যেন রক্তক্ষেত্র, মাছ যেন শহিদ,
পাখি যেন মৃত্যুর দূত, তারা যেন মৃতদের চোখ, সকৃৎ ।
রাত যেন কাফন, দিন যেন শোকসভা,
নীরবতা যেন চিৎকার, শব্দ যেন প্রার্থনা।
ধোঁয়া যেন আভরণ, আগুন যেন কনে,
ধ্বংসাবশেষ যেন শহিদের স্মৃতিস্তম্ভ, মনে।
জখম যেন বীরের পদক, অশ্রু যেন প্রার্থনা জীবিতের,
স্মৃতি যেন অতীতের প্রেত, আশা যেন আলো অন্ধকারের।

যুদ্ধক্ষেত্র ক্ষোভ ও ধ্বংসের স্থান,
যেথা মৃত্যুর ছায়া নিত্য বিরাজমান,
জীবন মৃত্যুর সঙ্গে যেথা মিশে যায়,
সেথা শান্তির আশা কভু না পায়,
শুধু থাকে যাতনা সেই সবার,
যাদের হৃদয় শোকে ভারাক্রান্ত অপার,
যারা প্রিয়জন হারানোর শোক পায়,
তাদের অশ্রু ঝরে গভীর রাতের নীরবতায়।

ধ্বংসের ধ্বংসাবশেষ, মৃত্যুর নিশ্বাসে ভরা,
স্মৃতির ছায়ায় ঢাকা, জীবনের আশা হারিয়ে ফেলা।

নব প্রভাতের গান

বসন্তের বিদায়ে গ্রীষ্মের বীণা বাজে,
পুরনো দিনের জীর্ণ পাতা ঝরে ঝরে।
আকাশে মেঘের রঙিন রাজকীয় মেলা,
নতুন প্রভাতে আলোর কাঁথা বিছায়ে ফেলা।

হে প্রভাত, তোমার আলোয় জাগুক প্রাণ,
প্রতিটি প্রাণে প্রাণে বয়ে যাক নতুনের গান।

নবজাগরণের সুরে মনখানা ঝলমলে,
গান গায় কত পাখি কিশোর বাতাসে।
প্রকৃতির বুকে নবজীবনের আভাস,
হৃদয়ে জাগে আশার নতুন আকাশ।

ওই দেখা যায় প্রকৃতির নব জাগরণের খেলা,
প্রতিটি পাতায় পাতায় জাগে জীবনের মেলা।

ধানক্ষেত হাসে সোনালি রোদের ঝলকে,
মাতোয়ারা মন মাতে ফুলের সুবাসে।
ইচ্ছে করে জীবনের নতুন গান গাইতে,
দরজা খোলে ভবিষ্যতের, স্বপ্নের রঙে আঁকতে।

হে প্রকৃতি, তোমার সোনালি রোদে মিশে যাক আমার গান,
জীবনের প্রতিটি সুরে বাজুক নতুনের প্রাণ।

ধ্রুপদী তালে মৃদু মলয় ঘণ্টা বাজে,
পাতায় পাতায় রূপের আঁচড় কাটে।
প্রকৃতির মুখে হাসি ফুটে ওঠে নূতন,
জীবনের গানে সুখের জোয়ার, ভরে ওঠে মন।

হে জীবন, তোমার সুরে বাজুক আজই নতুন করে গান,
দুঃখ-কষ্ট সব যেন মিলে মিশে যায় দূরের প্রান্তে অবসান।

সাজুক প্রাণ নব উদ্যমে, উচ্ছ্বাসের সুরে,
অশ্রুজল মুছে যাক নব আশার নীরে।
ভালোবাসার আলোয় হোক সবাই আলোকময়,
সবার মনে যেন জাগে আনন্দের অমৃত সঞ্চয়।

পহেলা বৈশাখ

শব্দের ঝরনাধারা ভেসে আসে পহেলা বৈশাখ,
নবজীবনের সুর বাজে, মন উৎফুল্ল আকাশ।
রঙের ঝলকানিতে ছেয়ে যায় ধরণি,
আনন্দের উৎসবে মুখরিত হয় গানের বাণী।

হে বৈশাখ, তোমার আগমনে বাজুক জীবনের বীণা,
প্রতিটি হৃদয়ে গুঞ্জরিত হোক তোমার সুরের খেয়া।

ফুলের অঞ্জলি তুলে মধুময় বাতাসে,
পাখিরা গান গায়, উড়ে যায় আকাশে।
প্রকৃতির বুকে জাগে নবজাগরণের আবেশ,
শিশুরা খেলে আনন্দে, মাতিয়ে তোলে দেশ।

ওই দেখা যায় বৈশাখের সাজে সেজেছে ধরা,
প্রাণের উৎসবে ভরেছে সবার মনের ঘড়া।

মৃদু স্পর্শে বাতাস, নীল আকাশের নীচে,
প্রজাপতি নৃত্য করে, রঙিন রেণুর মেঘে।
সোনালি ধানের শিষে, বাজে খুশির সুর,
গ্রামের মাঠে মাঠে, উঠুক নতুন ভোর।

বৈশাখের এই নতুন প্রভাতে জাগুক প্রাণ,
প্রতিটি প্রাণে প্রাণে বয়ে যাক নতুনের গান।

নতুন আলোয় ঝলমল করে পৃথিবীর বুক,
বৈশাখের বাতাসে বয়ে আসে নতুন সুখ।
পুরনোকে ছেড়ে যাবার আনন্দে মনে উচ্ছ্বাস,
নতুনের আগমনে ভরে ওঠে আশার আকাশ।

হে বৈশাখ, তুমি নিয়ে এসো নতুনের বার্তা,
প্রতিটি পথে পথে রচিত হোক নতুন কবিতা।

নবজীবনের আশায় হয় মন উদাসী,
বৈশাখের হাওয়ায় মেশে দীর্ঘশ্বাস ভারী।
স্মৃতির পাতায় ম্লান হাসি, অশ্রুর ধারা,
বৈষম্যের বেদনায় হৃদয় বিধে কাঁটা।

তবুও আশার আলো মনে জ্বলে,
নতুন দিনের সূচনা সুন্দর হবে।
বৈশাখের বাতাস বয়ে আনে সুরের উল্লাস,
জীবনে আনন্দ ছড়াবে, দুঃখ হবে বিনাশ।

হে বৈশাখ, তোমার মাঝে খুঁজি আমি নতুন প্রেরণা,
জীবনের পথে পথে তুমি দাও নতুন করে জেগে ওঠার কামনা।

হৃদয় কাঁপে আনন্দে, মুখরিত হয় গান,
বৈশাখ এসেছে নিয়ে নতুন জীবনের প্রাণ।
উচ্ছ্বাসের আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবীর অন্তর,
বৈশাখের উল্লাসিত গানে নাচে গ্রাম ও শহর।

বিদায় রামিম

শান্তির নীড়, গ্রামের কোলে, জন্মেছিল রামিম,
হাসি-খুশি, বন্ধুদের সাথে, কাটিয়েছিল দিন।
কিন্তু হায়, নিষ্ঠুর বিধি, কেড়ে নিল রামিমকে,
সকলকে বিস্মিত করে, শোকের সাগরে ডুবিয়ে।

শান্ত সন্ধ্যার আকাশে, কালো মেঘের ঘনঘটা,
বিদ্যুৎ চমকে উঠে, কেঁপে ওঠে ধরণিটা।
ক্ষণে সব ভেসে যায়, অন্ধকারে ঢেকে যায়,
রামিম চলে গেল, চিরতরে বিদায়।

......

রামিম, সিয়াম, আর দুই ভাই, সব ছিল তরুণ,
রাস্তায় বের হয় বাইক নিয়ে, দুপুরে জ্বলে অরুণ।
সিয়াম চালায় বাহন, রামিম তার সহযাত্রী,
আশা ছিল মনের মাঝে, আনন্দে ভরা সফরটি।

কিন্তু হায়, নিষ্ঠুর বিধি, খেলা করে নিরন্তরে,
অটোরিকশা হঠাৎ একটা  এসে পড়ল পথে।
সিয়াম হঠাৎ করেই ব্রেক কষলো জোরে,
চার দিকে ছড়িয়ে গেল, ধূলি আরো গোঁ ধরে।

দু'জনই পড়ে গেল তারা, রাস্তার দুই ধারে,
রামিমের শরীরে ব্যথা, যেন বিঁধছে সহস্র কাঁটা ঘাড়ে।
এমন সময়, দেখা গেল, সিএনজি একটা ছুটে,
রামিমের উপর দিয়ে চলে গেল নিষ্ঠুর গতিতে।

কী আর বলা যায় এখন, শুধু চেয়ে থাকা নিঃশব্দে,
মনে যেনো বাজ পড়ে, রক্তাক্ত রামিমকে দেখে।
কাঁদতে ইচ্ছে করে কেবল, কিন্তু কান্না আটকে গেছে,
এতটা দুঃখ, এতটা বেদনা, কে আর পারে সহিতে?

প্রথমে নেওয়া হলো তাকে, এক বেসরকারি হাসপাতালে,
কিন্তু নির্বাণ হল রাতে, চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে সাতকানিয়ায় গ্রামে।
শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সে সন্ধ্যায়, ঠিক যেন ছয়টায়,
আমাদের সবার প্রিয় রামিম, চিরতরে চলে যায়।

জানাজা  হয় তার, পূর্ব মুক্তারকুল জামে মসজিদে,
সকাল দশটায়, সবাই ভাসে শোকের সাগরে।
কবরে শোয়ানো হল তাকে, পাশের কবরস্থানে,
রয়েছে কি আর ফিরিবার আশা, এই মৃত্যুর জগৎ জানে?

কিন্তু রামিম, তুমি কোথায়, স্বপ্নেও দাও না দেখা,
কথা ছিল, একসাথে থাকব যতদিন বৃদ্ধ না হওয়া।
তুমি ছিলে আশার দীপ, হাসির ফোয়ারা অদ্যাবধি,
তোমাকে নিয়ে গেল এত তাড়াতাড়ি, কী নিষ্ঠুর বিধি।

আমাদের বুকে জ্বলে আছে, মনের জ্বালা,
কে দেবে তার পূর্ণতা, তোমার স্বপ্নের অসমাপ্ত খেলা?

......

নিঃশব্দে চেয়ে থাকি শুধু, রাস্তার দিকে চোখ রেখে,
এসে কি আর পড়বে তুমি, সেই চেনা বাইকে ছুটে?
মনে হয় যেন শুনতে পাই, তোমার সুরের প্রবাহ,
কিন্তু চারদিকে শুধু নীরবতা, বাতাসের শোকবাহ।

একদিন হয়তো আমিও যাব, সেই অজানা দেশে,
সেখানে হয়তো দেখা হবে, তোমার সঙ্গে আবার এ জগতে।
কিন্তু সেই দিন না আসা পর্যন্ত, বুকে জ্বালা নিয়ে বাঁচব,
তোমার স্মৃতির শিখা জ্বালিয়ে, এই মর্ত্যলোকে দিন কাটাব।

বিদায় রামিম, আমার বন্ধু, বিদায় আমার ভাই,
চলে কি যাও? আরেকটু থাকো... এই কষ্টের শেষ নাই।

......

এখনো কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, মনে জন্ম হয়ে আছে জ্বালা,
সেদিন কী হয়েছিল ঠিক, কীভাবে ঘটল এই দুঃখের পালা?
কীভাবে সিয়াম  হারালো নিয়ন্ত্রণ, হঠাৎ করেই কেন ব্রেক  কষলো?
কোথাকার অটোরিকশা, কে ছিল চালক, সে কি এই মৃত্যুর ফল জানলো?

রাতের আঁধারে, চলছিল নিঃসাড় সিএনজি,
চাপা দিয়ে গেল রামিমের শরীর, কোনো দয়া দেখাল না সেই নিষ্ঠুর চালকটি।
এতো কি সহজ, একটা জীবন কেড়ে নেওয়া?
কোনো শাস্তি কি পেয়েছে সে, নাকি আবারও রাস্তায় তার ছুটে চলা?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর, হয়তো কোনোদিন না যাবে পাওয়া,
কিন্তু রহস্যে ঢাকা এই মৃত্যু, থাকবে চিরকাল মনে গাঁথা।
ছেড়ে দিয়ে সব স্বপ্ন, রামিম, তুমি চলে গেলে,
আমাদের বুকে কাঁটার মতো, বিচ্ছেদের  বেদনা বিঁধে।

তবুও জীবন চলতে থাকবে, সবারই বাঁচতে হবে,
কিন্তু তোমার অসম্পূর্ণতাগুলো, মনের মাঝে সব সময় জ্বালা দেবে।
একদিন হয়তো আমরা সবাই যাব সেই অজানা পথে,
সেখানে হয়তো আবার দেখা হবে, তোমার সঙ্গে, সবার দুঃখ লাঘব হবে।

বিদায় রামিম, বিদায় আমার বন্ধু, বিদায় আমার ভাই,
তোমার স্মৃতির শিখা জ্বালিয়ে, আমরা এগিয়ে যাই।

......

তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, মনে জ্বালা হয়ে রয়,
সেদিন কী কথা হয়েছিল, তোমাদের মাঝে, শেষ বাইকের যাত্রায়?
হাসির কী কথা বলে ছুটে চলেছিলে দূরে,
নাকি কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল আলোচনার সুরে?

সে কথাই হয়তো শেষ কথা হয়ে রইলো চিরতরে,
হারিয়ে গেলো হাসি, কান্না জমে উঠলো চোখের কোণে।
বিদায় রামিম, আমার বন্ধু, বিদায় আমার ভাই,
তোমার হাসি, তোমার কথা, মনে থাকবে চিরকাল, এই মর্ত্যলোকে বসবাসের ক্ষণেই।

এতো কথাই রয়ে গেল বলা, মনের মাঝে কেবল জমে আছে ,
কিন্তু কথাগুলো আর বের হয় না, চোখের জলের ধারায় সব ভাসে।
তোমার সাথে আর দেখা হবে না, জানি তা ভালো করেই,
কিন্তু হয়তো স্বপ্নে দেখা হবে আবার, মনের কোণে এক আশা জ্বলেই।

বিদায় রামিম, অন্ধকারে ঢাকা রাত, নীরব মৃত্যুর প্রহর,
হৃদয় কাঁপছে অশান্তিতে, এখন শুধুই বেদনার স্বর।

......

কখনো কি আবার আসবে, এই প্রশ্ন জাগে মনে,
আমাদের মনের আকাশে, তুমি থাকবে চিরতরে।
বিদায় রামিম, শেষ বিদায়, আমার বন্ধু, আমার ভাই,
হৃদয়ের গহ্বরে চিরদিন জ্বালা জ্বলবে তোমার জন্যই।

শূন্যে ভেসে বেড়ায় রামিমের হাসি, মনে হয় গানের ভোর,
কিন্তু চারদিকে শুধু নীরবতা, বাতাসের মৃদু শোর।
স্মৃতির পাতায় খুঁজে বেড়াই, তোমার হাসি, তোমার কথা,
শূন্যতায় ডুবে যায় মন, যেন হারিয়ে ফেলেছি সবটা।

বৈসাবির স্বপ্ন

মায়াবী রঙে ঝলমলে, দিনের শুরু আজ,
আকাশে নেমে এসেছে, রামধনুর এক টুকরো রাজ।

চৈত্রের শেষ দু'দিন, বৈশাখের প্রথম সকাল -
আকাশে ঝুলে থাকে রামধনুর এক টুকরো,
যা স্পর্শ করলে হাতে লাগে শাল গাছের গন্ধ।
পাহাড়ের চূড়ায় ষাঁড়ের ডাক, নদীর বুকে ভাসে
কুমারী মেয়েদের হাসি।
চাকমা গৃহিনীরা রান্নাঘরে খুঁজে পেলেন
আকাশের এক টুকরো নীল রং,
তা দিয়ে রান্না করেন পাঁচন –
পঁচিশ ধরণের সবজি মিশে তৈরি অমৃত।

ত্রিপুরা বাড়ির আঙিনায় ফুটে আছে সোনালি ফুল,
যারা রাতে গান গায় হারি বৈসু'র সুরে।
ফুলেরা ঝরে পড়ে ঢেঁকির ঝোপের নিচে,
সেখানে তখন মারমা যুবকেরা ধনুকের কাঁড়িতে
বাঁধে প্রেমের স্বপ্ন।
নদীর কিনারে ভাসে সাদা হাঁস,
ঠোঁটে ধরে রাখে ময়মনসিংহের কবির শব্দ।

পানিতে ভেজা মাটির ঘরগুলোয় জ্বলে ওঠে অদৃশ্য আলো,
সেই আলোয় নাচনে মেয়েরা – গায় গান বৈসুমা'র।
আকাশ ছেদে নেমে আসে হাতির দল,
তাদের পিঠে বসে ঋষিরা ছড়িয়ে দেন
সারা পাহাড় জুড়ে আশীর্বাদের বীজ।

বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু – তিনটি শব্দ মিশে গিয়ে
বানিয়ে ফেলে রঙিন এক স্বপ্ন।
এই স্বপ্নে বৃষ্টি হয় রঙিন কাগজের টুকরো দিয়ে,
ঢাকঢোলের তালে তালে নাচে গাছের পাতা।

এই বৈসাবির স্বপ্নের মাঝে, কোনো এক গোপন জায়গায়
লুকিয়ে থাকে সত্যি জীবন।
কিন্তু কেউ তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে না,
কারণ স্বপ্নের রঙই তো আসল সত্যি।

স্বপ্ন ভেঙে যাবে, সত্যি আসবে,
কিন্তু কেউ চায় না স্বপ্নের রঙ হারাতে।

মৃত্যুর মাঝি

অস্তিত্বের অন্ধকারে, নক্ষত্রের আলোয়,
মৃত্যুর নদী বহে, নীরবতার গান গায়।

রাতের নদী, নিবিড় অন্ধকার,
জলের বুকে কেবল ঝিকিমিকি তারার।
এ পারে বসবাস, অপার ও পারে,
মাঝখানে নৌকা, মৃত্যুর মাঝি চলে।
কালো জামা, ধবল কেশ, বৈঠা হাতে,
নীরব চোখে সে তাকায় দূরের দিকে।
নৌকায় ওঠে মানুষ, ছিঁড়ে স্বপ্নের মালা,
মৃত্যুর নদী পার হওয়ার অভিযাত্রা।

কেউ যায় রাজবাড়ি ছেড়ে, কেউ বা কুঁড়েঘর,
কেউ ছেড়ে মায়ের কোল, কেউ প্রেমের আঁধার।
শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, বধূ, সবাইকে নেয় সে,
নিঃশব্দে চলে নৌকা, অজানা পারে।
কে জানে কোন নদী, কোন দেশের মাটি হায়,
কোন ফুল ফোটে ওপাশে, কোন পাখি গান গায়।
কেউ ফিরে আসে না, কেউ দেয় না খবর,
মৃত্যুর মাঝি চলে, নিঃশব্দ নিশীথের পার।

কখনো মেঘ গর্জে, কখনো বয়ে যায় ঝড়,
নৌকা দোলে, কাঁপে, তবু মাঝি থাকে নিথর।
জীবনের সুখ-দুঃখ, সব ছেড়ে আসতে হয়,
তার নেই ফিরে যাওয়ার অধিকার, যে চড়ে মৃত্যুর নৌকোয়।
এই নদী, এই নৌকা, চিরকালের স্রোতে,
চলে মৃত্যুর মাঝি, অজানা সীমার পানে।
আমরা সবাই, কখনো না কখনো, যাত্রী হব তার,
অনন্তের পথে চলতে, পার হব অন্ধকার।

মৃত্যুর নদীতে ভাসে জীবনের তুচ্ছতা,
অন্ধকারের অতীতের দিকে চলে নৌকা।

বিলুপ্তির নদীতে ঈশ্বরের চিঠি

স্বপ্নের নদীতে ভাসে হাজার বছরের ইতিহাস,
কালের খেলায় হারায় জীবন, রেখে যায় শুধু নিশ্বাস।

হাজার বছরের পালকের ছাপ লেগে আছে রবীন্দ্রনাথের গানে,
কিন্তু কালের কাঠের হাতে ঝরে পড়ছে শব্দগুলো, একটা একটা করে।
বাঙালি নারীর লাল পেড়ে সাদা শাড়িগুলোয় ঈশ্বরী রঙের ছোঁয়া লেগে আছে,
কিন্তু রাতের অন্ধকারে কে যেন ধীরে ধীরে রঙ মুছে ফেলছে।
সনাতনের ধ্যানে মগ্ন মূর্তিগুলো ঘুমিয়ে পড়ছে স্বপ্নের ঢেউয়ে,
আর তাদের জাগানোর মন্ত্রগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।

পহেলা বৈশাখের আলপনাগুলো ভাসছে বিলুপ্তির নদীতে,
হাজার হাজার স্বপ্নের মাছ ধরা পড়ছে অজান্তে জালে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আকাশের ক্যানভাসে আঁকছে মঙ্গল শোভাযাত্রা,
কিন্তু তাদের রঙের তুলি নিঃশব্দে ভাঙছে অদৃশ্য হাতেরা।

এই মৃত্যুর কারাগারে জীবন যেন নির্বাসিত,
সুখের স্বপ্ন ঝুলছে শুধু মৃত্যুর পরের আকাশে।
ঈশ্বর হয়তো চিঠি লিখেছেন এই বিলুপ্তির নদীতে,
কিন্তু নদীর ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে সেই চিঠির কলম ও খাতা।
কেউ পড়বে না সেই চিঠি, কেউ জানবে না এই সংকটের কথা,
বাঙালি সংস্কৃতির সুতো যখন কেটে যাচ্ছে একটু একটু করে, বিলুপ্তির নিঃশব্দ গর্জনের মধ্যে।

সব স্বপ্ন, সব আশা ডুবে যাচ্ছে কালের অন্ধকারে,
শুধু মৃত্যুর নিশ্বাস বইছে এই বিলুপ্তির নদীতে।

নিঃস্ব সুগন্ধার বালুচরে

রাতের নীল শাড়িতে ঢাকা এই আকাশ,
এক অসীম, অতৃপ্ত ক্ষুধার্ত চোখের মতো আমাদের দেখছে।
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জমির বুকে,
চৌদ্দ পুরুষের ধন, আমাদের জন্মভূমি।

কিন্তু আজ, কী নিষ্ঠুর পরিহাস!
এ জমিতে আমরাই আগন্তুক, অনধিকারী।
বিতাড়িত আমরা, নিজেরই মাটি থেকে উৎখাত।

মাটি, যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষের রক্ত ঝরেছে,
সে মাটি আজ কাঁদে না, বিদ্রোহ করে না।
শুধু নিঃশব্দে গিলে ফেলে আমাদের আর্তনাদ।

হাজার বছরের স্বপ্ন, ধূলিমিলিত ঐতিহ্য,
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় অধিকারের ঝঞ্ঝায়।
রক্তের স্রোতে ভাসে আমাদের অস্তিত্ব,
কাঁটাঝোপে আটকে, নিঃশব্দে, মৃতপ্রায়।

শিশুরা জন্ম নেয় অজানা এই বিষণ্ণ সত্য নিয়ে,
বড় হয়, শেখে কীভাবে বাঁচতে হয় পরের ছায়ায়।
মাথা নীচু করে বাঁচতে হয়, নিজেরই জন্মভূমিতে।

কবিরা লিখেছিলেন, ভাষা হারালে মানুষ মরে,
কিন্তু কে লিখবে, জন্মভূমি হারালে কী হয়?
মৃত্যু হয়তো শান্তি, কিন্তু এই জীবন
অন্তহীন যন্ত্রণার অগ্নিঝরা, নিঃস্বতার অতল গহ্বর।

এই রাতে, সুগন্ধার বালুচরে বসে
আমরা কাঁদি, রক্তের নদী বয়ে যায়, নিঃশব্দে।
কেউ শোনে না, কেউ দেখে না, এই দেশের অবিচার।
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জমিতে
আমরা, নিঃস্ব সুগন্ধার বালুচরে, বিলীন হয়ে যাই।

নক্ষত্র ও পাহাড়

আমি নক্ষত্রের বদলে পাহাড় বিক্রি করেছি,
আমার স্বপ্নের পাহাড়,
যেখানে আমি সবসময় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতাম,
মেঘের মাঝে নক্ষত্রের মতো জ্বলতে।

পাহাড় ছিল আমার উঁচুতে ওঠার সিঁড়ি,
পাহাড়ে চড়া ছিল আমার নক্ষত্রের নৈকট্যে আসা।
আমি পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলাম,
আকাশের ঠিক নিচে।

কিন্তু ভূমিপুত্ররা  সবাই বলে, "এই তাহলে!
এত উঁচু পাহাড়ের জন্য
একটি নক্ষত্র পেয়েছ? তুমি এত খারাপভাবে হেরে গেলে!"

তখন পরাজয়ের বেদনায় মন ভরে যায়।
আমি তখন নক্ষত্রকে সত্যিই ঘৃণা করি।
নক্ষত্র আমার অনেক আশাকে উপহাস করেছে।

যেমন, ধরুন, বলি, "আগামীকাল…
এটা কি একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন হবে?"

নক্ষত্র বলতো, “কাল এখানে উত্তরের হিমেল হাওয়া।
উঁচু পাহাড়ে শুধু তুষারপাত,
কী কঠোর শীত, অভিশাপের মতো!”

কিন্তু আমি জানতাম যে নক্ষত্র ভুল।

পাহাড় আমার একসময় ছিল, এখন নেই,
কিন্তু নক্ষত্র ছিল শুধু হিংসুটে।

আমি সেই পাহাড়ের চূড়ায় আর পৌঁছাতে পারিনি, যা আমার নেই,
কিন্তু আমি এখনও এটিকে আমার মনের মধ্যে ধরে রেখেছি।

আমি জানি যে আমি কখনই অতীতের কাছে ফিরে যেতে পারব না,
কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না।

হারানো পাহাড়ই আমার জন্য যথেষ্ট।
আমি এখনও সেই পাহাড়ে যাই,
কিন্তু আমার মনের মধ্যে।

আমি চূড়ায় উঠি,
এবং নক্ষত্রের দিকে তাকাই।

আমি জানি যে আমি কখনই নক্ষত্রের কাছে পৌঁছাতে পারব না,
কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না।

হারানো পাহাড়ের স্মৃতিই এখন আমার জন্য যথেষ্ট।

দাসত্বের অভিনেতা

মায়ার খেলায় জড়িয়ে, কে রাজা, কে ভিখারি?
স্বপ্নের মঞ্চে অভিনয়, জীবন কেবল অস্থায়ী।

কে জানে, কবে শুরু হলো এই অভিনয়?
কবে বা নিজের মুখোশ খুলে ফেলতে পারবো?
দাস! হ্যাঁ, আমি এক দাস।
কিন্তু দাস কি কখনও মানুষ হয়? হয় না।
রাজধানীর রাস্তায়, এই আধুনিক কারাগারে,
মানুষের চেহারা নিয়ে দাসত্বের মঞ্চে অভিনয় করছি।

দেখো, এই পোশাক, এই মুখোশ - সবই ধার করা।
ভাবছো, স্বাধীন?
স্বাধীনতা? সে কি জিনিস?
মুঘল গেল, পাঠান গেল, কিন্তু এই শোষকের দল?
তাদের নাম কী? কী বলে ডাকবো?
শ্রমের দাম দেন না তারা, ভিক্ষে চাইতে হয় মজুরি।
মানুষের আত্মাকে বিক্রি করে এখানে।
আর মানবতা? সে শোষকের আলমারিতে সাজানো এক অলংকার মাত্র।

এই মঞ্চে কত রূপে অভিনয় করেছি!
কখনো কেরানি, কখনো বা মজুর।
কিন্তু চরিত্র একই - দাস।
নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি।
কেন ক্ষুরী দিয়ে এই মুখোশ কাটিয়ে ফেলি না?
কিন্তু পারি না।
এই অভিনয়ের বাইরে কি আছে? এই অন্ধকার ছাড়া?

আমি কি চিরকাল এই মঞ্চে আটকে থাকবো?
কবে মুক্তির সূর্য উঠবে?
নাকি এই অভিনয়েই শেষ আমার জীবন?
হয়তো... হয়তো এই অভিনয়েই মৃত্যু।
কিন্তু মৃত্যুও কি মুক্তি দেবে?
এই দাসত্বের ছায়া কি তবুও ঝেড়ে ফেলতে পারবো না?

মুক্তির স্বপ্ন বুকে নিয়ে অভিনয় চলবে জীবনজুড়ে,
কখন আসবে সেই দিন, জানি না, যখন মুখোশ উধাও হবে।

ভালবাসার নতুন দিন

যদি বয়স বাড়তো, তাহলে কি হতো?
ঝরে ঝরে পড়তো স্বপ্নের পাতা,
ম্লান হয়ে যেতো হাসি, চোখের আভা,
মনে পড়তো শুধু হারানো কথা?

কিন্তু না, বয়স বাড়ে না, বন্ধু, নতুন হয়।
নতুন সকালের আলোয়, নতুন গান গায়।
রিম-ঝিম বৃষ্টিতে কাশ ফুলের মতো,
মনে মনে ফোটে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন।

অনুরাগ আর অনুরাধার গল্পও তেমনি।
ঢাকার ঝলমলে রাস্তায়, দুটি চোখের দেখা।
কফির কাপের উপর লেখা, অপরিচিত নাম।
কথার হড়বড়ি, হাসির রেশ, এক অদ্ভুত টান।

সেদিন ভালোবাসার দিন, ঠিক ১৪ই ফেব্রুয়ারি।
আকাশ নীল, লাল গোলাপের সাজে সাজানো শহর।
অনুরাগ অনুরাধাকে নিয়ে গেল পুরান ঢাকার কোণে,
এক ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁয়, সন্ধ্যার আলোয় মিলন।

কিন্তু কথা বলার আগেই, বাজ পড়লো যেন।
একটি খবর, ঝড়ের মতো এসে ঢুকে পড়লো জীবনে।
অনুরাধার চলে যাওয়ার কথা, দূর দেশে পাড়ি দেওয়া।
মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল সব, ভালোবাসার রঙ ফিকে।

বিদায়ের আঁধারে, একটি প্রতিজ্ঞা রেখে গেল অনুরাধা।
"বয়স বাড়ুক, চুল পাকুক, কিন্তু ভালোবাসা থাকবে নতুন।"
অনুরাগ একা, কিন্তু একা নয়।
মনে তার, অনুরাধার স্মৃতি, ভালোবাসার নতুন দিনের আশা।

এই শহরে, এই রাস্তায়, প্রতি বছর ১৪ই ফেব্রুয়ারি,
অনুরাগ এক কাপ কফি নিয়ে বসে, ঐ রেস্তোরাঁয়।
অপেক্ষা করে, হয়তো একদিন আবার দেখা হবে।
নতুন চেহারায়, নতুন গল্প নিয়ে, ভালোবাসার নতুন দিনে।

কিন্তু জানে সে, হয়তো হবে না।
কিন্তু জানে সে, ভালোবাসা থাকবে, নতুন হয়ে, অমর হয়ে।
বয়স বাড়ে না, বন্ধু, নতুন হয়।
ভালোবাসাও তাই, নতুন দিনে, নতুন রূপে ফোটে।

বিদায়ের কথোপকথন

স্বপ্নের মায়ায় ভাবনার খেলায়,
বিদায়ের বেদনায় হৃদয় কেঁদে যায়।

রাতের শেষ ঘন্টা বাজে,
বিদায়ের বেলা এসেছে।
চোখের ইশারায় কি বিদায় জানাবো,
অকথিত কথার ভার বহন করে?

তোমার চোখের তারায় আমার স্বপ্ন ভাসে,
তোমার ঠোঁটের হাসি আমার হৃদয় জুড়ে।
জানি, আবারও মিলব,
কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকে হারাতে চাই না।

চোখের ইশারায় বলতে চাই,
"ভালোবাসি", "হারাতে চাই না"।

কিন্তু, যেতে হবে, পথ আলাদা।
চোখের ইশারায় বিদায় জানাই,
অকথিত কথোপকথন নিয়ে।

বিদায়ের বেদনায়, কণ্ঠ কাঁপা,
চোখে জল।
অকথিত কথা, মনের গভীরে,
অশ্রুজলে ভেসে গেল।

বিদায়ের মুহূর্ত, স্মৃতির পাতায়,
চিরকাল অমলিন।
চোখের ইশারায়, অকথিত কথার মালা,
বিদায়ের উপহার।

স্মৃতির স্বপ্ন মনের আকাশে ভাসে,
অশ্রুজলের নদী চিরকাল বয়ে যাবে।

আমার মন খারাপ

আমার মন খারাপ,
আমার মন খারাপ,
আমার মন খারাপ।
বলছি তো, আজ আমার মন খারাপ।

আকাশটা যেন কেমন মেঘলা,
বাতাসটা যেন কেমন ঠান্ডা,
চারপাশটা যেন কেমন নিস্তব্ধ,
আমার মনটা যেন কেমন ভারাক্রান্ত।

এমন কেন আজ আমার মন খারাপ?

কিছুই তো হয়নি আজ,
সবকিছু তো ঠিকঠাকই,
তবুও কেন এই অমনোযোগ,
এই বিষণ্ণতা, এই একাকিত্ব?

হয়তো কাল রাতে স্বপ্নটা ভালো ছিল না,
হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে,
হয়তো ব্রেকফাস্টে পছন্দের খাবার ছিল না,
হয়তো...

কিন্তু না, এসব তো ছোটখাটো ব্যাপার,
এসবের জন্য তো মন খারাপ হওয়ার কথা নয়।

তাহলে কেন?

হয়তো মনের ভেতরেই কোথাও
কিছু একটা গোপন কষ্ট লুকিয়ে আছে,
যা আমি নিজেও জানি না।

হয়তো...

কিন্তু না, এসব ভাবনা তো আরও মন খারাপ করে,
এসব ভাবনা তো আরও বিষণ্ণ করে।

তাহলে কি করবো?

কিছুই করার নেই,
শুধু অপেক্ষা করতে হবে,
যতক্ষণ না এই মন খারাপের ভাবটা চলে যায়।

হয়তো...

কিন্তু না, অপেক্ষা করা তো আরও কঠিন,
অপেক্ষা করা তো আরও একাকী করে।

তাহলে কি করবো?

কিছুই করার নেই,
শুধু এই মন খারাপের ভাবটাকেই
নীরবে সহ্য করতে হবে।

হয়তো...

কিন্তু না, সহ্য করা তো আরও যন্ত্রণাদায়ক,
সহ্য করা তো আরও ভারাক্রান্ত করে।

তাহলে কি করবো?

কিছুই করার নেই,
শুধু এই মন খারাপের ভাবটাকেই
মেনে নিতে হবে।

হয়তো...

হ্যাঁ, হয়তো এটাই একমাত্র উপায়,
এটাই একমাত্র সমাধান।

মন খারাপ,
মন খারাপ,
মন খারাপ।

এই ভাবটা চলে যাবে না হয়তো,
থাকবে হয়তো সারাজীবন,
তবুও...

তবুও এটাকেই মেনে নিতে হবে,
এটাকেই বরণ করতে হবে,
এটাকেই ভালোবাসতে হবে।

হয়তো...

হ্যাঁ, হয়তো এটাই একমাত্র উপায়,
এটাই একমাত্র সমাধান।

মন খারাপ,
মন খারাপ,
মন খারাপ।

অদৃশ্য তুমি, অথচ সর্বত্র তুমি

সুরঙ্গময় অন্ধকারে জ্বলে উঠেছিল তোমার আলো,
এখন তুমি নেই, তবুও তুমি আছ।

সকালের কুয়াশায় তোমার পায়ের ছাপের সন্ধানে
আমি হাঁটি, তুমি না থাকলেও।

মধ্যাহ্নের বাতাসে তোমার কণ্ঠস্বর
আমি শুনি, তুমি না থাকলেও।

নদীর স্রোতে তোমার আলিঙ্গন
আমি অনুভব করি, তুমি না থাকলেও।

বেলিফুলের গন্ধে তোমার চুম্বনের স্বাদ
আমি পাই, তুমি না থাকলেও।

গোলাপের রঙে তোমার হাসির দ্যুতি
আমি দেখি, তুমি না থাকলেও।

তুমি ছিলে না, তবু আমি তোমাকে পেয়েছি
প্রকৃতির প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি রূপে।
আমি তোমাকে পেয়েছি, আমার হৃদয়ের গভীরে।

শূন্যতায় তুমি পূর্ণতা, অস্তিত্বে তুমি অস্তিত্বহীন,
অনন্তের সুরে বাজে তোমার নাম, চিরকালীন।

যে তুমি খুঁজছ তার ছবি

স্বপ্নের মায়ায় জড়িয়ে, হৃদয়ের দীঘির তীরে,
খোঁজো তুমি কল্পিত প্রেমিক, অজানা নীল নীরে।

জানি, চাও এক দিব্য, এক অতীত মানুষ।
যে কবিতা আবৃত্তি করবে, প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা ভাববে।
কিন্তু সত্য কথা, সে হয়তো কখনো সত্যি হবে না।

সে নিখুঁত হবে না। তুমিও না।
আর তোমরা দু'জনে কখনো নিখুঁত হবে না।

কিন্তু যদি সে,

একবার হাসাতে পারে, দু'বার ভাবায়,
মানব হওয়া স্বীকার করে, ভুল করে,

তাহলে, ধরে রাখো তাকে।
আপন সবটা দাও।

সে কবিতা আবৃত্তি করবে না,
প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা ভাববে না।

কিন্তু সে তোমাকে তার এক টুকরো দেবে,
যা সে জানে তুমি ভেঙে দিতে পারো।

তাকে আঘাত করো না, তাকে বদলিও না,
আর এর চেয়ে বেশি পাওয়ার আশা করো না।

বিশ্লেষণ করো না।
সে সুখ দিলে হাসো, রাগিয়ে দিলে চেঁচিয়ে বলো,
সে না থাকলে অভাব বোধ করো।

যখন ভালোবাসা পাওয়া যায়, তখন সবকিছু দিয়ে ভালোবাসো।

কারণ নিখুঁত ছেলেরা হয় না,
কিন্তু তোমার জন্য নিখুঁত এক ছেলে সবসময় আছে।

স্বপ্ন ভাঙুক, বাস্তব আসুক, হৃদয়ের দীঘির তীরে,
নিখুঁত প্রেমিক নয়, পাবে যাকে প্রেমের সত্য স্পর্শে।

বর্ষার ট্যাক্সি

বৃষ্টি প্রহার করে হলদে ট্যাক্সি,
প্রতিটি ফোঁটা এক ক্ষুদ্র ঝাঁঝরির ধ্বনি।
হঠাৎ, এক নারী লাল শাড়িতে,
চোখ বর্ষার মেঘের মতো, আমায় ডাক দিল।
তার হাসি, বাতাসের ঘণ্টার সুরের মতো, বাতাস ভরে দিল।
'কোথায় যাবেন, ম্যাডাম?' আমি জড়সড় হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
'চাঁদে,' সে বলল,এবং চোখ মারল।
ট্যাক্সি ঝাঁকুনি খেল, মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে।
বৃষ্টি প্রহার করে হলদে ট্যাক্সি,
প্রতিটি ফোঁটা এক ক্ষুদ্র ঝাঁঝরির ধ্বনি।

চৈত্রের নিষ্ফল রাত্রি

বাবা কোলে শুয়ে আছেন, নিথর, শান্ত,
চাঁদের আলোয় ধুয়ে মুখ, কপালে তিলকের চাঁদ।
হায় রে, কী নিষ্ঠুর বিধি! কে বাঁধে মৃত্যুর বাঁধ?
নিশীথে চাঁদের আলোয় মৃদু হাসি ছিল,
কিন্তু কেন মৃত্যুর শীতল করাল স্পর্শ?

বৈদ্যর ওষুধ খাওয়াতে, ডাকলাম কতবার,
কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে চোখের দুই দীপশিখা।
বাবার চোখে জল, কিন্তু কথা নেই আর,
হাত দুটি ছেড়ে চলে গেলেন যে পার,
চাঁদের আলোয় ধুয়ে মুখ, কপালে তিলকের চাঁদ।
হায় রে, কী নিষ্ঠুর বিধি! কে বাঁধে মৃত্যুর বাঁধ?

এক নিঃশব্দ ডাক

ধুলোঝরা বিকেলের আলো, শীতল হাওয়ার ডাক,
একাকী পথ চলি, মনে হঠাৎ কে বলে, "ফিরে চাও তো!"
পিছনে তাকিয়ে দেখি, নীল আকাশে খেলা করে মেঘ,
ছায়া ঘনায়ে ঢাকছে শহর, দূরের শব্দ হয়ে যায় লীন।

খুঁজে ফিরি সেই মুখ, যার ডাক শুনেছিলাম কানে,
নেই কোথাও, শুধু ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা, ঘনিয়ে আসে ধূম্রালোক।
একটা শূন্য হাত উঠে যায় আকাশের দিকে, কাছে আসে রাত,
চুপচাপ পথ চলি, মনে হয়, কেউ যেন কাঁদে, কেউ যেন হাসে।

কিন্তু কোথায় সেই মুখ, কোথায় সেই ডাক?
শুধু নিঃশব্দে পৃথিবী চলে, এক অন্ধকারে ডুবে যায়।

হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মত, অস্পষ্ট এক ছায়া,
সেই ডাক কি কেবল মনেরই কল্পনা?
নাকি কোন অজানা দূর থেকে, এসেছিলো সেই ডাক,
খুঁজে ফিরি সেই মুখ, সেই দৃষ্টি, সেই হাসি,
কিন্তু কোথায় সেই সব?

মনের আকাশে কেঁদে ওঠে এক অজানা বেদনা,
কোথায় হারিয়ে গেলাম, কে জানে, কোথায় পাবো স্বদেশ।
ধুলোয় মিশে যায় স্মৃতি, হারিয়ে যায় সব চিহ্ন,
একাকী পথ চলি, মনে হয়, কেউ যেন হারিয়েছে।
দূরে কোথাও বাজে একটা ঘণ্টা, রাতের ঘুম ভাঙে,
কেউ যেন ডাকে, "ফিরে এসো", কেউ যেন বলে, "চলে যাও"।
মনের দুয়ারে কেউ যেন কড়া নাড়ে, কেউ যেন কাঁদে,
কোথায় পাবো স্বপ্নের দেশ, কোথায় পাবো শান্তি।
শেষ রাতের অন্ধকারে, একা পথ চলি,
মনে হয়, কেউ যেন হারিয়ে গেছে, কেউ যেন খুঁজে ফিরেছে।

ভাষার ঈশ্বর

ইরা:

আমার কাছে তুমি কেবল প্রেমিক নও,
তুমি ভাষার ঈশ্বর।

তোমার কণ্ঠে স্পন্দিত হয়
বিশ্বের সকল ভাষা।

তুমি যখন বাংলায় কথা বলো,
মনে হয়
গঙ্গার জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে।

তুমি যখন ইংরেজিতে কথা বলো,
মনে হয়
থেমস নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছি।

তুমি যখন ফরাসিতে কথা বলো,
মনে হয়
সেন নদীর তীরে
এক কাপ কফি হাতে
আমি বসে আছি।

__________________________

আমি:

ইরা,
তুমি জানো না
ভাষার ঈশ্বর হওয়া
কতটা কঠিন।

বিশ্বের সকল ভাষা
আমার কণ্ঠে স্পন্দিত হলেও
আমার হৃদয়
শূন্য।

আমি এক ঈশ্বর
যার কোন ভক্ত নেই।

__________________________

ইরা:

তুমি ভক্ত চাও কেন?

তোমার ভক্তি
তোমার ভাষায়
নিহিত।

তোমার ভাষা
যখন আমার কানে
স্পন্দিত হয়
তখন আমি
তোমার ভক্ত।

__________________________


আমি:

ইরা,
তুমি আমার একমাত্র ভক্ত।

তোমার ভালোবাসায়
আমি পূর্ণ।

আমি আর ভাষার ঈশ্বর
হতে চাই না।

আমি
শুধু তোমার প্রেমিক
হতে চাই।

__________________________

শেষ:

ইরা আর আমি
একসাথে
নতুন ভাষা
তৈরি করি।

এই ভাষায়
শুধু দুটি শব্দ থাকে:

"ভালোবাসি"

এবং

"তোমাকে"।

এই ভাষা
বিশ্বের সকল মানুষ
বুঝতে পারে।

এই ভাষা
বিশ্বের সকল মানুষকে
একত্রিত করে।

এই ভাষা
ঈশ্বরের ভাষা।

হাসির ফেরিওয়ালা

শহরের বুকে, অন্ধকারের আঁধারে,
বাতাসে লেগে আছে হতাশার গন্ধ।
ঝলমলে অট্টালিকা, দামি গাড়ি,
সবকিছু নিঃশব্দ, যেন শোকাহত।
মানুষের মুখে হাসি নেই,
চোখে জ্বলজ্বলে স্বপ্নগুলো মলিন।
আমি হাঁকি, “হাসি নেবেন?
আমি আপনাদের শহরের হাসির ফেরিওয়ালা।”

কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না-
যেন আমার কথাগুলো হারিয়ে যায়
ধোঁয়ায়, ধুলায়, শহরের বিষণ্ণতায়।
এই শহর কি হাসি ভুলে গেছে?
না কি হাসি আর কেউ কিনতে চায় না?

আমার ঝুলি ভর্তি হরেক রঙের হাসি-
লাল হাসি, সবুজ হাসি, নীল হাসি, হলুদ হাসি।
প্রতিটি হাসি আলাদা, প্রতিটি হাসি গল্প বলে-
সুখের গল্প, দুঃখের গল্প,
ভালোবাসার গল্প, হারিয়ে যাওয়ার গল্প।

আমি হাঁকি, “এই নিন, হাসি নিন।
আপনার মনের রঙের হাসি।”

কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না।
হয়তো তারা ভাবে হাসি কেনা যায় না,
হাসি তো মনের ভেতর থেকে আসে।
কিন্তু আমি জানি, হাসি হারিয়ে যায়,
চুরি হয়ে যায়, মরে যায়-
ঠিক যেমন এই শহরের হাসি।

আমি হাঁকি, “আপনাদের হাসি ফিরিয়ে দিন।
আমার ঝুলিতে নতুন হাসি নিন।”

কিন্তু কেউ ফিরে তাকায় না-
যেন আমি অদৃশ্য, আমার হাসিগুলো অশ্রাব্য।
এই শহর কি নিজের হাসি খুঁজে পাবে না?
না কি হাসি আর ফিরে আসবে না?

আমি হাঁকি, “হাসি নেবেন?
আমি আপনাদের শেষ হাসির ফেরিওয়ালা।”

কিন্তু শুধু বাতাসের শিস, রাস্তার কুকুরের ডাক,
আর নিঃশব্দে চলাচল।
এই শহর কি চিরকাল হাসিহীন থাকবে?
না কি হাসি আবার ফুটে উঠবে
কোনো অলঙ্ঘনীয় সকালে?

আমি চলে যাই,
ঝুলি ভর্তি রঙবেরঙের হাসি নিয়ে।
হারিয়ে যাই অন্ধকারের গলিঘুঁজিতে,
শহরের অবসন্নতার ভেতরে।
কিন্তু আমার হাসিগুলো মরে যায় না।
তারা অপেক্ষা করে,
হয়তো কোনো একদিন কেউ তাদের কিনে নেবে,
কেউ তাদের ফিরিয়ে দেবে এই শহরকে।

আমি হাসির ফেরিওয়ালা,
শেষ হাসির ফেরিওয়ালা,
হাসিহীন শহরে, হাসির স্বপ্ন নিয়ে।

প্রজ্ঞার আলোয় সত্যের সন্ধানে

স্বপ্নের অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া ক্লান্ত মন,
সত্যের সন্ধানে জ্বলে উঠুক প্রজ্ঞার দীপ্তিময় ক্ষণ।

জ্ঞানের আলোয় যেখানে জ্বলছে প্রজ্ঞার শিখা,
সত্যের ঝংকার সেখানে বাজছে নিরবধি।
ওহে পথিক, অন্ধ আনুগত্যে যেও না তুমি,
প্রশ্নের তীরে বিদ্ধ করো সত্যের ছদ্মবেশ।
বিস্ময়ের বনে ঘুরে বেড়াও অবাধে,
কৌতূহলের শিকড়ে খুঁজে নাও সত্যের বীজ।
অন্তর্জ্ঞানের কানে শুনে নাও নীরবতার সুর,
বিপরীত স্রোতে ভাসিয়ে দাও তোমার ইন্দ্রিয়।
নানান শব্দের এই জগতে,
স্বাধীন চেতনার ডাকে, করো যা ইচ্ছে।

তাড়াহুড়োয় সম্মতির মাথা নাড়িও না,
অন্ধ সম্মতি আপন আলোকে ম্লান করে দেয়।
যারা অন্ধের মতো মাথা নাড়ে প্রতি আদেশে,
তারা জীবনের সাগরে হারিয়ে যায়, দিশেহারা।
নিজের ধ্বংসের পথে তারাই এগিয়ে যায়,
অন্ধকারের পথে, বিনা যত্নে।
জীবনের উত্তাল তরঙ্গে,
ইন্দ্রিয়কে শানিত করো, তারাই পথ দেখাবে।

প্রশ্ন করো, শিখো, অন্বেষণ করো, আনুগত্য নয়,
এই পথেই তোমার সত্যিকারের সত্তা উড়ে যাবে।
এতেই খুঁজে পাবে তোমার মূল্য,
জ্ঞানের ভাণ্ডার, জন্মের গভীরে।
মিথ্যা দৃষ্টিভঙ্গির আবর্জনা পরিষ্কার করো,
আর ধ্বংসের পথ থেকে সাহসের সাথে সরে আসো।

অস্তিত্বের তলদেশে জ্বলে প্রজ্ঞার দীপ্তি,
সত্যের সন্ধানে চলো, মুক্তির অভিযাত্রী।

চাঁদের আলোয় তোমার চোখের তারা

স্বপ্নের নীলাকাশে, বেদনার তীব্র তারা,
প্রেমের অশ্রুঝরে, জীবনের অদ্ভুত যাত্রা।

তুমি চাইলে, তোমার চোখে আঁকি নীল আকাশ,
তোমার গালে ফুটিয়ে তুলি গোলাপের পাপড়ি।
কিন্তু তুমি চাইলে, তোমার হৃদয়ের মাঝে
আমার প্রেমের আগুন জ্বালাতে পারি।
আমি কখনও আমার আত্মাকে বিক্রি করিনি
অর্থ বা খ্যাতির জন্য।
আমি কখনও ভয় বা দুঃখে কাঁপিনি,
আমার প্রেম দিয়ে সবকিছু জয় করেছি।
তুমি যদি আমাকে ভালোবাস,
আমিও তোমাকে ভালোবাসব।
আমার ভালোবাসায় কোনো শর্ত নেই,
কোনো কৌশল বা মোহ নেই।
আত্মার জন্য আত্মা, তাই যথেষ্ট, আর কিছু নেই
চাওয়া বা বরাদ্দ করার জন্য।
বঁধু, ফুলের দরকার নেই,
যেগুলি তোমার চোখে জল আনে
এবং তোমার ভালোবাসার বেদনাকে বাড়িয়ে তোলে।
যদি তুমি সাহস করো
আমাকে যেমন আছি তেমনি গ্রহণ করতে,
দুঃখ এবং সুখের মাঝে,
কোনো ফুলের আবরণ
তোমার সাহসী চোখ থেকে আমার আকৃতি অস্পষ্ট করবে না
যা আমাকে সত্য বলে জানে।
যদি তুমি এই ভালোবাসার ফলটি আমার সঙ্গে ভাগ করতে চাও,
তবে আমার জীবনেরও স্বাদ নেও,
সহ্য করো।
আনন্দে বা দুঃখে,
আমরা চিরকাল একসঙ্গে থাকব,
নিকটে।
কোনো নারী কাঁদে না, কোনো কবি কাঁদে না,
কখনও এইভাবে না।
কিন্তু উভয়ই প্রেমের তীব্র যন্ত্রণা দ্বারা বিদ্ধ হয়,
ভেঙে যায়।
তারা দুমড়ে যায়, মুচড়ে যায়, কিন্তু মাথা নত করে না।

অশ্রুজলের নদীতে, ভেসে যায় প্রেমের তীব্রতা,
জীবনের শেষেও, অটুট থাকে মনের একাত্মতা।

অসমাপ্ত শব্দের ভূত

শব্দের অপূর্ণতা, মৃত্যুর আভাস,
ভাষার আঁধারে হারিয়ে যায় স্বপ্নের বাস।

ভাষা, এক নিশ্বাসে বিশ্বজনীন, অন্য নিশ্বাসে মা তার,
এক দিকে বর্ণালির তান, অন্য দিকে শহিদের অভিশাপের হাহাকার।

মায়ের কোলে আদরে বেড়ে ওঠা শিশু, কখন হয় বীর, কখন শহিদ, জানে না কেউ।

ফেব্রুয়ারির রক্তিম আকাশে

ঝরে পড়ে অক্ষরের ফুল, অসমাপ্ত শব্দের ভূত।
রবীন্দ্রের কলমের সঙ্গীত তাদের কানে যায় না,
বজলুর গর্জন গোপন মন্ত্র হয়ে যায়।

শুধু শোনা যায় অসমাপ্ত স্বাধীনতার চিৎকার,
অসমাপ্ত ভাষার আর্তনাদ।

আমি ঘুরে বেড়াই এই ভাষার

পুরাণকথার নগরীতে, স্মৃতির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে।
দেখি কবিদের ভাঙা স্বপ্ন, রাজনীতিবিদের ফাঁকা প্রতিশ্রুতি,
আর সাধারণ মানুষের অক্ষরে অক্ষরে কষ্ট।

কোথা সে স্বপ্নের রাজ্য

যেখানে ভাষা ছিল মুক্তি, আর অক্ষর ছিল অস্ত্র?

এখানে শুধু অচেনা ভাষার দানব

তার ধ্বনি গ্রাস করে স্বপ্ন, গ্রাস করে ভবিষ্যৎ।
আমরা, হতবাক দর্শক, শুধু দেখি লিপির রূপান্তর,
হারিয়ে যায় মূল।

কোন চিত্রকর এঁকে দিতে পারে না

এই বিষাদের ছবি, কোন কবি লিখতে পারে না
এই হাহাকারের কবিতা।

কিন্তু এখনো বাতাসে ভাসে শহিদের শেষ নিশ্বাস

অসমাপ্ত শব্দের আঁচ।
মনে পড়ে সেই স্লোগান - "ভাষা নেই, রাষ্ট্র নেই..."

ভাষা আছে, রাষ্ট্র আছে,
কিন্তু অসমাপ্ত শব্দের ভূত ঘুরে বেড়ায়।

কখন থামবে এই ভূতের কান্না?
কখন শোনা যাবে পূর্ণ স্বাধীনতার গান?

এই প্রশ্নের উত্তর জানে না কেউ,
শুধু জানে ভাষার প্রতি ভালোবাসা
এই ভূতের মুক্তির একমাত্র উপায়।

বিষণ্ণতার মুখোশ পরে ভাষা বেদনায় কাঁপে,
মুক্তির স্বপ্ন দেখে অশ্রুসজল চোখে।

অপরিচিত

সূর্যাস্তের বিলীন আলোয়, জ্বলন্ত প্রশ্ন জাগে মনে,
অন্তহীন পথের বাঁকে, কে আমি, কে তুই, কে জানে?

দোস্ত, আমি সেই একই, যে ছিলাম তোর আগের দেখায়।
তুইও কি সেই রকম?

আমার চোখে এখনও সেই একই স্বপ্ন,
আমার হৃদয়ে এখনও সেই একই আগুন।

আমি এখনও সেই একই পথিক,
যে চলেছে অনন্তের দিকে।

তুইও কি সেই রকম?

তোর চোখে কি এখনও সেই একই স্বপ্ন?
তোর হৃদয়ে কি এখনও সেই একই আগুন?

তুইও কি সেই একই পথিক,
যে চলেছে অনন্তের দিকে?

আমরা দুজনেই বদলে গেছি,
কিন্তু আমরা দুজনেই একই।

আমরা দুজনেই ভুলে গেছি,
কিন্তু আমরা দুজনেই মনে রেখেছি।

আমরা দুজনেই হারিয়ে গেছি,
কিন্তু আমরা দুজনেই খুঁজে পেয়েছি।

আমরা দুজনেই অপরিচিত,
কিন্তু আমরা দুজনেই চেনা।

নক্ষত্রের আলোয় ঝলমলে, রহস্যময় এই পথে,
একসাথে হারিয়ে যাব, অজানা এক নতুন স্বপ্নের দিকে।

নষ্ট হয়ে যাই

আহ! আমি সহজে নষ্ট হয়ে যাই, প্রিয়...

আমার মধ্যে আছে এক নরম, মিষ্টি গন্ধ,
ফুলের মতো, চিনির খামিরের মতো,
কিন্তু তাই আমার অভিশাপ হয়ে থেকেছে,
আমাকে সহজে নষ্ট করে দেয় সবাই।

শিশুর হাতে পুতুল হয়ে,
আমি হারিয়েছি চোখ, হাত, পা,
আদরের ঝাঁকুনিতে ছিঁড়ে গেছে গা,
কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই,
কারণ শিশুর হাসিই আমার সার্থকতা।

মিষ্টির দোকানে মিঠাই হয়ে,
আমি দেখেছি লোভী চোখ,
আঁচড়ে টানা হাত, মুখে লেগে যাওয়া আঙুল,
আমি গলে গেছি, মিষ্টি হয়ে মিশে গেছি,
কিন্তু অভিযোগ নেই,
কারণ মিষ্টির স্বাদ দেওয়াই আমার কর্তব্য।

ফুলের মালায় গাঁথা হয়ে,
আমি সাজিয়েছি কারো বুক,
কিন্তু রোদে পুড়ে, বাতাসে ঝরে,
আমি হয়ে গেছি শুকনো, নিষ্প্রাণ,
কিন্তু অভিযোগ নেই,
কারণ সুন্দর করে সাজানোই আমার কাজ।

আমি জানি, আমি সহজে নষ্ট হয়ে যাই, প্রিয়,
কিন্তু আমার নষ্ট হওয়াটাই তো মানুষের আনন্দ,
তাদের হাসি, তাদের স্বাদ, তাদের সাজ।

আমার অভিশাপই আমার আশীর্বাদ,
নষ্ট হয়েও আমি ছুঁয়ে যাই মনের কোণ,
আমি মিষ্টি স্মৃতির রেশ,
আমি ফুলে ফুলে ফোটা সুন্দর।

তাই আমি নষ্ট হয়ে যাই, প্রিয়,
কিন্তু আমার নষ্ট হওয়াটাই তো জীবনের স্বাদ।

নরকের নতুন রূপ

শুনলাম, নরকের নতুন রূপ হয়েছে,
সেখানে সব সৃজনশীল মানুষের বাস।
বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, চিত্রকর, ভাস্কর,
অভিনেতা, অভিনেত্রী, আরও কত কি।
সেখানে নরকের আগুন নেই,
সব কিছুই সবুজ, অভিজাত, দৃষ্টিনন্দন।
সব আধুনিক সুবিধা আছে,
নরককে মনে হয় প্যারিসের মতো।

একদিন একজন সাংবাদিক গেলেন নরকের রিপোর্ট করতে,
তিনি যা দেখলেন তা তার কল্পনার বাইরে ছিল।
নরকে সবাই খুশি, সবাই সুখী,
সবাই নিজের মতো করে কাজ করে।
বিজ্ঞানীরা নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন,
লেখকরা নতুন বই লিখছেন,
কবিতা লিখছেন,
গল্প লিখছেন।
চিত্রকর চিত্র আঁকছেন।
ভাস্কর ভাস্কর্য তৈরি করছেন।  
অভিনেতা, অভিনেত্রীরা নতুন নাটক,
নতুন ছবিতে অভিনয় করছেন।

সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনারা এতো সুখী কেন?
নরক তো সাজার জায়গা।"
নরকের বাসিন্দারা বললেন, "হ্যাঁ, জানি।
কিন্তু আমরা এখানে সৃষ্টি করি,
আমরা নতুন কিছু তৈরি করি।
এটাই আমাদের সাজা।
আমরা এখানে এতো সুখী কারণ
আমরা আমাদের প্রতিভাধরনকে কাজে লাগাতে পারি।"

সাংবাদিক অবাক হয়ে গেলেন।
তিনি নরক থেকে বেরিয়ে এলেন,
এবং নরকের নতুন রূপ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট লিখলেন।
সেই রিপোর্ট পড়ার পরে সবাই অবাক হয়ে গেল।
নরকের নতুন রূপ সম্পর্কে কেউ কিছুই জানত না।
সবাই ভাবতে শুরু করল,
নতুন নরকের মতো জায়গায় যেতে হলে,
কী করতে হবে?

একজন কবি বললেন, "আমাদের কবিতা লিখতে হবে,
গল্প লিখতে হবে,
নতুন নতুন চিন্তা করতে হবে।"
একজন বিজ্ঞানী বললেন, "আমাদের নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে,
নতুন নতুন জিনিস তৈরি করতে হবে।"
একজন অভিনেতা বললেন, "আমাদের নতুন নাটক,
নতুন ছবিতে অভিনয় করতে হবে,
লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।"
একজন চিত্রকর বললেন, "আমাদের নতুন চিত্র আঁকতে হবে,
নতুন চিত্রে নতুন জীবনের আলো ছড়াতে হবে।"
একজন ভাস্কর বললেন, "আমাদের নতুন ভাস্কর্য তৈরি করতে হবে,
সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠতে হবে,
যারা আসবে, তাদের প্রেরণা হতে হবে।"

সবাই একমত হল,
নতুন নরকের মতো জায়গায় যেতে হলে,
সৃজনশীল হতে হবে,
নতুন নতুন কিছু করতে হবে।
সেই থেকে সবাই সৃজনশীল হওয়ার চেষ্টা করছে,
নতুন নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে,
কারণ সবাই জানে,
নতুন নরকের মতো জায়গায় যেতে হলে,
সৃজনশীল হতে হবে।

আমি হব, তুমি যা চাও

স্বপ্নের নীল জলে ভেসে যায় মন,
কল্পনার রঙে রাঙিয়ে তোলে জীবন।

কেন ভালোবাসো, এই প্রশ্নের জবাব কী খুঁজবে জীবনে?
হয়তো ঝরনার ধারার মতো স্বচ্ছ নই আমি,
নীল আকাশের মতো বিস্তৃতও নই,
অথবা গভীর সুগন্ধি ধানিজমির মতো মাতিয়েও দিতে পারি না মন।

কিন্তু কী আছে আমার?

যদি বলতাম, চিরকালের সাথি হব,
দুঃখের ছায়া হঠাৎ এলে তোমার হাত ধরে থাকব,
সবার চেয়ে বেশি বুঝবো মনের অগোছালো অংশগুলো,
তবু এই সব কিছু কি ঠিক কারণ ভালোবাসার?

না, ভালোবাসার জন্য কোনো কারণ দরকার নেই।

যেমন আকাশ তারায় তারায় সেজেও কিছুই বলে না কেন সে এমন করে,
কীভাবে গাছপালা ফুল ফোটায়, ছায়া দেয়, শুধুই দেয়, আর কিছু চায় না,
ঠিক তেমনি, ভালোবাসাও নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে ঝরে পড়ে।

তুমি কেবল এটা বিশ্বাস করো, তোমাকে ভালোবাসি এই কারণেই,
কারণ আমি ভালোবাসি।

আমায় ঘরের কোণে ওয়েস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিতে পারো অনায়াসে,
কিন্তু যেদিন ঘুরে, ফিরে আসবে, দেখবে, ঠিক সেখানেই থাকব আমি,
পরিবর্তিত, হয়তো আরও পুরনো,
কিন্তু ভালোবাসাটা অক্ষতই থাকবে।

তুমি চাও আমাকে শক্ত, তাই শক্ত হব,
চাও মৃদু, তাই মৃদু হব,
চাও পাগল, তাই পাগল হব,
চাও চুপ থাকতে, চুপ থাকব,
চাও কথা বলতে, কথা বলব।

আমি হব, তুমি যা চাও,
কারণ আমি ভালোবাসি,
কেবল ভালোবাসি।

আর এটাই যথেষ্ট, তাই না?

ভালোবাসার গান গায় মন,
স্বপ্নের রঙে ভরে ওঠে জীবন।

এই শহর

স্বপ্নহীন যাত্রায় ক্লান্ত, হৃদয় শূন্যতায় ভরা,
এই নগরী মৃত্যুর রাজ্য, জীবনের গান হারা।

যখন যমুনা কেঁদেছিল রাজা সৌদাসের বিরহে,
ঢেউ খেলায় ভাসিয়েছিল সারা নগর,
ঠিক তখনই কি জন্ম নিয়েছিল এই শহর?
এই অগ্নিময়, নির্মম, নিঃশেষ শহর?

রাত পোহালে সূর্য ওঠে না, জ্বলে ওঠে শুধু আগুন,
কলি তার বিষের ফণা ধরে ঢেকেছে শহরের গলিঘুঁজি।
এখানে প্রতিটি নিশ্বাস, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা,
মায়ের বুকের দুধের মতো সাদা মেঘ, কালো হয়ে যায় দুঃখে।

তাই এখানে আকাশটা কালো কাপড়ের চাদর,
তারায় তারায় জ্বলে অসংখ্য চিতার আগুন।
রাস্তাগুলো কালো নদী, বয়ে চলে আর্তনাদ,
মানুষেরা পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে অগ্নিকুণ্ডে।

বাতাস বয়ে যায় কঙ্কালের হাহাকার নিয়ে,
প্রতিটি নিশ্বাসে ছাইয়ের গন্ধ,
এখানে স্মৃতি জ্বলে মৃত প্রদীপের মতো,
আশা ধোঁয়ার মতো উড়ে যায় দূরে কোথাও।

এই শহর নিস্নেহ দেবতার মন্দির,
যেখানে বলি দেওয়া হয় স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা।
এখানে প্রতিটি  ইট নিজ গল্প বলে,
প্রতিটি গলি কবর দেয় অতীতকে।

কবিরা এখানে লেখে রক্তের কালি দিয়ে,
শিল্পীরা আঁকে কালো সূর্যের ছবি।
এই শহরে সুর হলো চিৎকার,
নৃত্য হলো মৃত্যুর শেষ নাচ।

কিন্তু, কোথাও কি একটা ফাটল আছে নাকি?
এই কালো দেয়ালের কোণে কি একটু আলোর ঝিলমিল রয়েছে?
হয়তো কোনো শিশুর হাসি, কোনো প্রেমিকের চোখ,
না হয় কোনো বাঁশরিয়ার  বাঁশির সুরে...

না,
এ শহরে আশা নির্বাসিত,
এখানে শুধু জ্বলে অগ্নি,
এই শহর মৃত্যুর নাট্যশালা।

এই শহরে মৃত্যু নির্মম খেলার ছলে
নিজেরই সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয় হাসতে হাসতে।
শুধু কিছু ছাই থেকে হয়তো হবে কোনোদিন ফিনিক্সের জন্ম,
কিন্তু আজ, আছে শুধু নিশ্বাস, নিঃশব্দ চিৎকারের স্রোত।

কোথায় হারিয়ে গেছে জ্যোতি, কোথায় আশার আলো?
শুধু ধ্বংসের সুর বাজে, চিরকালের কালো।

অফিসের অদ্ভুত কাহিনি

স্বপ্নের মায়ায় ঘেরা এই অফিসের আঙিনা,
কত রহস্য লীলা, কত বিস্ময়ের খেলা!

সকালে অফিসে গিয়ে দেখি,
সবকিছুই উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে।
ডেস্কগুলো মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে,
চেয়ারগুলো এক পাশে ঝুম বসে আছে,
কম্পিউটারগুলো ঝুম বসে গান গাচ্ছে,
আর ফোনগুলো এক পাশে নাচছে।

কর্মচারীরাও উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে।
বস একটা কুকুরের মতো তেড়ে বেড়াচ্ছে,
সহকর্মীরা একটা বিড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করে চিৎকার করছে,
রিসেপশনিস্ট একটা পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে,
আর নিরাপত্তা রক্ষী একটা মাছের মতো পানিতে চলে গেছে।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে,
কিন্তু আমি ভয় পেলাম না।
আমি জানতাম যে এটা আমার স্বপ্ন নয়,
কিন্তু বাস্তবতা।

আমি একটা চেয়ারে বসলাম,
আর কম্পিউটারটা খুললাম।
কম্পিউটারটা আমাকে একটা হাসি দিল
এবং বলল, "শুভ সকাল! আজকে কি করতে চান?"

আমি বললাম, "আমি আজকে কাজ করতে চাই।"
কম্পিউটারটা বলল, "আচ্ছা, কিন্তু আজকে সবকিছুই উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে।"
আমি বললাম, "আমার কোনো অসুবিধা নেই।"

আমি কাজ শুরু করলাম,
আর দেখলাম যে আমি সবকিছু করতে পারি,
যা আমি আগে কখনো করিনি।
আমি এক মিনিটেই একটা রিপোর্ট লিখে ফেললাম,
এক মিনিটেই একটা ইমেইল পাঠিয়ে দিলাম,
আর এক মিনিটেই একটা ফোন কল করলাম।

আমি খুব খুশি হয়ে গেলাম,
আর বুঝলাম যে আজকে একটা অদ্ভুত দিন।

আমি অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম,
আর রাস্তায় দেখলাম যে,
সবকিছুই উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে।
গাছগুলো মাথার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে,
পাখিগুলো পানিতে চলে গেছে,
মাছগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে,
আর বিড়ালগুলো গান গাচ্ছে।

আমি হেসে ফেললাম,
আর বুঝলাম যে,
আজকে একটা অবিস্মরণীয় দিন।

বাস্তব-অবাস্তব মিশে, একাকার,
চিরন্তন রহস্যে, হারিয়ে যায় ভাবনার ধার।

আমি কখনো বৃষ্টি দেখিনি, শুধু শুনেছি

স্বপ্নের বর্ষা ঝরে, মনের আকাশে,
কল্পনার মেঘে লেখা, অজানা গল্প জাগে।

আমি কখনো বৃষ্টি দেখিনি

কাঁচের ফাটল দিয়ে ঝরে পড়া
অসংখ্য চোখের কান্না

ধানক্ষেতে ঢেউ খেলে উঠেছে
মৃদু, স্বচ্ছ নিশ্বাসের মতো।

মাটির বুকে ফুটে উঠেছে সবুজ হাসি,
কিন্তু আমি দেখিনি এই বিশ্বময় আনন্দধারা।

শুধু শুনেছি

আকাশের কান্না, দূরের কোনো অজানা মঞ্চে।
মেঘেরা নিয়ে এসেছে অসংখ্য গান,
কিন্তু আমার কাছে পৌঁছায় না কোনো সুর।

এই শহরে বৃষ্টি নামে না,
শুধু গল্পে, কবিতায়।

মানুষেরা ছাতা খুলে বেড়ায়

কিন্তু আমার মাথার নেই কোনো আশ্রয়।

এই শহরে বৃষ্টি নেই,
শুধু আছে ধূসর আকাশের অসমাপ্ত চিঠি।

মাটি ফেটে যায়

তৃষ্ণায় কাতর হয়ে,
কিন্তু বৃষ্টির স্পর্শ পায় না।

মানুষেরা বলে, "বৃষ্টি হবে।"

কিন্তু কেউ জানে না কখন, কোথায়।

আমি অপেক্ষায় থাকি

এই শুষ্ক বাতাসের বুকে,
এক অজানা দিনের জন্য।

এই শহরে বৃষ্টি নেই

শুধু আছে কবিদের কল্পনার রঙিন ছায়া।

তারা লেখে, "বৃষ্টি নেমেছে।"

কিন্তু আমি দেখি না কোনো ভেজা পাতা।

তারা লেখে, "বৃষ্টির গান।"

কিন্তু আমি শুনি না কোনো ধ্বনি।

আমি শুধু খুঁজি

এই শুষ্ক চোখে,
এক ফোঁটা বৃষ্টির স্পর্শ।

এই শহরে বৃষ্টি নেই

শুধু আছে মানুষের বুকে ঢাকা
অসংখ্য প্রশ্ন।

"বৃষ্টি কী?" "কেন নেই?" "কখন আসবে?"

প্রতিধ্বনি ঘুরে বেড়ায় বাতাসে।
আমিও জানি না

এই রহস্যের কোনো উত্তর।

শুধু শুনি

দূরের কোথাও,
বৃষ্টির গান, অবিরাম, অস্পষ্ট।


কিন্তু আমি

বৃষ্টির স্পর্শ কখন পাব?
কখন ভিজবে এই শুষ্ক মাটি?
কখন ধুয়ে যাবে এই ধূসর আকাশের চিঠি?

বৃষ্টি! বৃষ্টি!

আমার বুকে নামো, আমার মাটিতে নামো,
এই শুষ্ক চোখে, এই তৃষ্ণার্ত অস্তিত্বে,
নামো, নামো, নামো!

অজানা সুরে বাজবে নতুন গান,
বৃষ্টির স্পর্শে জাগবে নতুন প্রাণ।

শব্দশ্মশানের ছুটি

মৃত্যুর দরজায় কান পেতে, শব্দের ঝড়ে ভেসে,
একদিনের নিস্তব্ধতায়, নিজের সাথে দেখা হবে।

মা, ঘোষণা দাও, কাল আমার অবসর। মৃতের মতো শুয়ে থাকব,
হাড়ে হাড়ে ক্লান্তি, কোনো কথায় সাড়া দেব না।
আমার শরীর এক স্তব্ধ সমুদ্র, চিন্তা তার ঢেউ,
কাল শুধু নিস্তব্ধতা চাই, কোনো তুফান নয়।

বলো, কাল আমি মৃত, কথা বলব না, হাসব না,
এই শব্দশ্মশানে শুধু শান্তি খুঁজব।
ফোনের রিং হোক, দরজায় কেউ ডাকুক,
আমি নির্বাক, আমি নিশ্চল, শব্দহীন এক পাথর।

মা, ঘোষণা দাও, জানুক সবাই,
আমি কাল সূর্যের আলোয়, চাঁদের আলোয় ঘুমাব।
স্বপ্ন দেখব মেঘের দেশে, নীরবতার রাজ্যে,
যেখানে শুধু শান্তির সুর, কোনো কলহ নেই।

বলো, কাল আমি মৃত, কাগজের খবরে,
কাল আমি মৃত, সামাজিক যোগাযোগে।
একদিনের মৃত্যু, বিশ্রামের স্বপ্ন,
জীবনের ঝামেলা থেকে একটুখানি অব্যাহতি।

মা, ঘোষণা দাও, কাল আমার অবসর।
আমি ঘুমাব, নিশ্বাস ফেলব না,
শুধু শব্দের ঢেউয়ে ভাসব, নিজের সাথে কথা বলব।
কাল আমি মৃত, কাল আমি শান্ত, কাল আমি নিজের।

শব্দের অপেক্ষায় থেমে, নিঃশব্দে হারিয়ে যাব,
একদিনের মৃত্যুতে, চিরকালের শান্তি পাব।

কাঠুরিয়া প্রেমিক

গাছের ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে আছি,
এক অসম্ভব, নিঃশব্দ ভালোবাসায়।
তুমি আসো প্রতিদিন কাঠ কাটতে,
আমার শরীরে চলে তোমার কুঠারের খেলা।

জ্বলে ওঠে বেদনা, কিন্তু চুপ থাকি,
তোমার চোখের আগুনে পুড়ে যেতে চাই।
শাখায় শাখায় ছড়ায়ে থাকে
আমার অসহ্য বেদনার গান।

কিন্তু তুমি শোনো না,
শুধু কাঠ জোগাড় করো,
আগামী শীতের নির্মম অগ্নি জ্বালাতে।

...এই ভালোবাসায়,
আমি কাঠ, তুমি কাঠুরিয়া।

আবার হব ছোট্ট, আবার হব নষ্ট

ছোট্ট হব আবার, হব নষ্ট,
মায়ের কোলে ঢুকে, সব দায় থেকে মুক্ত।

বুঝি, ফিরে না আসে, অতীতের দিন,
ঝিমিয়ে যাওয়ার বয়স, মায়ের কোলে লুকিয়ে থাকার দিন।

তবুও মনের কোণে, একটা আশা জেগে আছে,
আবার হব ছোট্ট, আবার হব নষ্ট, তোমার কোলে ঢুকেই, সব দায় থেকে হব মুক্ত।

ঝড়ো হাওয়ার মতো বকাবকি শুনব, মৃদু বাতাসের মতো হাত বুলিয়ে দেবে যদি,
চোখে ধুলো দিয়ে মিষ্টি খাব, আবার সইব তোমার বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো চোখ-রাঙ্গানি।

মায়ের আদেশ যেমন মেনেছি, তোমারও সব আদেশ মানব সহজেই,
কিছু চাইতে, কাঁদব, আর তুমি হবে সব উত্তর, সব সমাধানেই।

রাতের বেলা  ঘুমের ঘোরে, ডাকব তোমায় বারে বারে,
তুমি এসে বসবে পাশে, গল্প শোনাবে ধীরে ধীরে।

ভয়ের ছায়া কাটবে, তোমার আঁচলে ঢাকা পড়ব,
নিশ্চিন্ত নিদ্রায় ডুবে যাব, সকালে নতুন স্বপ্ন দেখব।

কিন্তু জানি, এসব স্বপ্ন, কেবল মনের খেলা,
বয়সের সাথে বাড়ে দায়, বাড়ে আরো ঝড়, ঝামেলা।

তবুও, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফিরে যেতে,
আবার হব ছোট্ট, হব নষ্ট, তোমার কোলে ঢুকেই, সব দায় থেকে হব একেবারে মুক্ত।

যখন ক্লান্তি গা ভরবে, জীবনের যুদ্ধে হেরে,
হাত ধরে এসো তুমি, কাছে এসো আমার কাছে।
নষ্ট হতে চাই মাঝে মাঝে,
তোমার কোলে ঢুকে, আদুরে খাতির,
মায়ের মতো করেই।

কিছু বল না, শুধু বুঝে নাও,
ছোট্ট হব আবার, নষ্ট হব আবার,
তোমার কোলে ঢুকেই,
শান্তিতে ঘুমিয়ে যাব।

প্রতিফলনের রঙ

প্রেমের দুঃসাহসে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে।
নদীর জল, সমুদ্রের জল, পাথর, পাথর, লাল পাথর নীল হয়ে যায়, নীল পাথর লাল।
জীবন যখন সত্যিকারের চেষ্টা করে, তখনই...

কিন্তু আগে অভিরূপের কথা শুনুন। সে থাকতো লালবাগের গলির মাঝে, আর স্নিগ্ধা, সেই চতুর্থ তলার বারান্দায়। দুজনের মাঝে অগণিত গল্পের সিঁড়ি, কিন্তু একটাও ধাপ বোঝা যায় না। অভিরূপ কাঠের খেলনা বানায়, আর স্নিগ্ধা বই পড়ে।

একদিন, একটা ঘুড়ির সুতো স্নিগ্ধার বারান্দায় ঝুলে গেল। অভিরূপ উঠে গেল, ঠিক যেমনটা লালবাগের ছেলেরা সবসময় করে। কিন্তু স্নিগ্ধা অবাক হয়ে গেল, কারণ সে তো কখনো অভিরূপের চোখের দিকে তাকায়নি।

সেইদিন থেকে, লালবাগের গলি আর চতুর্থ তলার বারান্দার মাঝে গল্পের সিঁড়িগুলি একটু একটু করে স্পষ্ট হতে লাগল।

একদিন, ঝড়ের রাতে, বৃষ্টির ঝাপটায় লালবাগের গলি ভেসে গেল। স্নিগ্ধার বারান্দার রেলিং ধরে অভিরূপ দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে ছিল একটা নৌকা, লাল কাঠের, ভেতরে একটা চিঠি।

চিঠিতে লেখা ছিল, "আমার প্রেমের নৌকা, ঝড়ের জলে ভাসিয়ে দিও। যদি কোনোদিন নদীতে পৌঁছায়, তাহলে জেনো, তোমার পাথরের বুক থেকেও পাথর ঝরে পড়েছে।"

সেই রাতেই, স্নিগ্ধা নৌকাটিকে ঝড়ের জলে ভাসিয়ে দিল। পরদিন সকালে, নদীর ধারে, লাল কাঠের নৌকাটা পড়ে আছে। তার ভেতরে, একটা নীল পাথর।

অভিরূপ নেই, লালবাগের গলি নেই।

কিন্তু স্নিগ্ধার বুক থেকেও পাথর ঝরে পড়েছে। নদীর জল, সমুদ্রের জল, লাল পাথর নীল হয়ে গেছে।

প্রেমের দুঃসাহসে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে।
জীবন যখন সত্যিকারের চেষ্টা করে, তখনই...

সেই পাথর নীল হয়ে যায়।
কিন্তু, প্রতিফলন থাকে, লাল।

চলে যা, বন্ধু!

আনন্দ নিয়ে চলে যা, বন্ধু!
আজ সূর্য কুয়াশার কাঁধে বসে হাসছে
হীরের টিপ পরে সেজেছে নীল আকাশে।
আমাদের রাস্তা আজ স্বপ্নময় ভোরের ভেজা মাঠ, সবুজ আর
শিশিরস্নাত আশ্চর্যের হাতছানি। কোনো ট্রেনের ঘড়ির টিকটিক শব্দ
আমাদের কানে আসে না, কোন ট্রামের বেলের ডিঙডিঙ নেই।
শুধু ঘাসের ফিসফিস ও কোকিলের ডাক
যেন দুটো কানে দুটো গোপন রহস্য ফাঁস করে যায়।

চলে যা বন্ধু,
কাঁচল পরা মেঘের নৌকায় চড়ে,
ঐ যে ভাসছে আকাশের নদীতে, গন্তব্য
নতুন কোনো দ্বীপ। সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফুটে আছে,
সব
রঙের, একটার গন্ধ অন্যটার গন্ধকে চেনে না,
একটার রূপ অন্যটার রূপকে ধার দেয় না।
সেখানে বাতাস মেঘের চুম্বন নিয়ে ফিরে আসে, নীরব নাচের তালে,
কখনো গল্প শোনাবে, কখনো গান গাইবে।

চলে যা বন্ধু, সেখানে
সময় পাখি হয়ে উড়ে যায়, ঘড়ির কাঁটাগুলো
ফুলের পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়ে। সেখানে
দুঃখ নেই, শুধু আনন্দ আছে, এক জলপ্রপাতের
মতো ঝরে, এক ঝরণার মতো গুনগুন করে।

চলে যা, এই পৃথিবীর পাগলামি তোকে ছুঁতে পারবে না।
চলে যা, স্বপ্নের দেশে, যেখানে আমরা আবার দেখা করব।

চলে যা বন্ধু,
আনন্দ নিয়ে চলে যা!

ঈশ্বরের রঙিন পাখি

আমার কণ্ঠে গান, আমার ডানায় আকাশ,
আমিই ঈশ্বরের রঙিন পাখি, উড়ি নির্ভয়ে।

মাটির বুকে কোনো স্বর্গের সিঁড়ি নেই,
শুধু কাকের ডানায় রাতের অন্ধকার লেগেছে।

শালিকেরা চলে গেছে দিগন্তের ক্ষয়ে,
আমিই রয়ে গেছি, ঈশ্বরের অস্তিত্বহীন আকাশে।

আমার পাখায় নেই দেবতার আশীর্বাদ,
শুধু আছে প্রাণের স্পন্দন, বর্ষার উচ্ছ্বাস।

আমার চোখে ফোটেনি সৃষ্টির রহস্য-ফুল,
দেখি শুধু গাঙচিলের একাকী দাপট, বনের মর্মর।

নদীর তীরে শূন্যতারই বীজ বুনি,
তার থেকে ওঠে অ-জন্ম নেওয়া সবুজের অরণ্য।

আমিই ঘাসফড়িং, আমিই পিঁপড়ের হাঁটা,
আমিই ক্ষয়ে যাওয়া পাতার শিরায় শিরায় বেঁচে থাকা।

মেঘ নেই, তারা নেই, শুধু আছে এই ধরিত্রীর বুক,
এই অচেনা রঙের মিছিল, অনিশ্চয়তার মহোৎসব।

আমি উড়ি, কারণ আমার পাখাই আমার ধর্ম,
আমিই নক্ষত্রহীন আকাশের নিঃসঙ্গতা, আমিই মহাবিশ্বের কাব্য।

ঈশ্বরের অনুপস্থিতিই আমার মুক্তির গান,
আমিই নিজের মহিমা, আমিই ঈশ্বরের রঙিন পাখি।

আমার ডানায় নেই স্বর্গলোকের বোঝা,
আছে মাটির গন্ধ, আর অসীমের বিস্ময়।

আমিই গান, আমিই কবিতা, আমিই নাটকের অভিনেতা,
আমিই ঈশ্বরের রঙিন পাখি, মুক্তির অবিরাম পথিক।

আমিই ঈশ্বরের রঙিন পাখি, উড়ি অবাধে,
মুক্তির আকাশে, নিজের গান গেয়ে।

আমার ডানা ছুঁয়ে যায় নীল অম্বরের কোলে,
আমার গানে মিশে যায় সূর্যের আলো।
আমি উড়ি, উড়ি, উড়ে চলে যাই,
অনন্তের দিকে, অনন্তের বুকে।

আমিই ঈশ্বরের রঙিন পাখি,
পৃথিবীর বুকে মহাবিশ্বের ছবি।

অনন্ত নারী

প্রিয় নারী -

তুমি উদাহরণ, তুমি ব্যতিক্রম,
তুমি ব্যক্ত, তুমি অব্যক্ত।
তুমি শব্দ, তুমি নীরব,
তুমি স্বপ্ন, তুমি বাস্তব।

তুমি স্বপ্নের নীড়, তুমি অদৃশ্য সুর,
তুমি আলোর রেখা, তুমি অন্ধকারের গহ্বর।

তুমি সমুদ্রের ঢেউ, তুমি পাহাড়ের চূড়া,
তুমি মরুর বালিয়াড়ি, তুমি বনভূমির নীরবতা।

তুমি আকাশের তারা, তুমি নদীর জলধারা,
তুমি বৃষ্টির ফোঁটা, তুমি রৌদ্রের প্রখরতা।

তুমি কালের গতি, তুমি জীবনের স্পন্দন,
তুমি মৃত্যুর রহস্য, তুমি অজানার আকর্ষণ।

তুমি সবকিছু, তুমি কিছুই নও,
তুমি শূন্যতা, তুমি পূর্ণতা।

তুমি হলে -

যে সুর বাজে অজানার বীণায়,
যে গান গাওয়া হয় অদৃশ্য কণ্ঠে,
যে ফুল ফোটে অসম্ভবের বাগানে,
যে প্রেম জাগে অকল্পনীয় স্বপ্নের কোলে।

তুমি হলে -

যে সত্য লুকিয়ে আছে মিথ্যার আড়ালে,
যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে অসুন্দরের বুকে,
যে আশা লুকিয়ে আছে নিরাশার গর্ভে,
যে জীবন লুকিয়ে আছে মৃত্যুর বীজে।

তুমি হলে -

যে আলো দেখে অন্ধ চোখ,
যে গান শোনে মৃত কান,
যে স্পর্শ অনুভব করে অস্পর্শ শরীর,
যে প্রেম অনুভব করে পাষাণ প্রাণ।

তুমি হলে -

যে অজানা লুকিয়ে আছে জানার বুকে,
যে অদৃশ্য লুকিয়ে আছে দৃশ্যের আড়ালে,
যে অসীম লুকিয়ে আছে সীমার বেড়াজালে,
যে অনন্ত লুকিয়ে আছে ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তের কোলে।

কিন্তু তুমি নও -

একটি সহজ সংজ্ঞায় বন্দি, সীমাবদ্ধ জীব,
হারিয়ে যাওয়া পথ, অজানার ভয়াবহতা,
বিষণ্ণতার কালো মেঘ, অঝোর ধারার বৃষ্টি,
মরচে ধরা আয়না, ম্লান হওয়া রূপের আলো।


তুমি নও -

জীর্ণ প্রতিবিম্ব, ভঙ্গুর কাচের মূর্তি,
স্তব্ধ প্রতিমা, অনুভূতিশূন্য মাটির স্পর্শ,
মনের কোণে বসে থাকা, সুরের মাঝে মুক্তি খোঁজা পাখি,
অদেখা বাঁধন, যা বাস্তবের গণ্ডিতে বাঁধা।


তুমি নও -

মৃতপ্রায় প্রেতিনি, রাতের অন্ধকারে ভেসে বেড়ানো,
বাজারের মাংসের টুকরো, দরদাম করে বিক্রি করা,
পুরুষের খেলার পুতুল, ইচ্ছেমতো নাচানো,
চুপচাপ ঘরের কাজের যন্ত্র, কৃতজ্ঞতা না পাওয়া।


তুমি নও -

অপমানিত, অপদস্থ, নির্যাতিতা,
অধিকারহীনা, ক্ষমাহীনা, ভাগ্যবিড়ম্বিতা।

তুমি -

জীবন্ত আগুন, প্রবল ঝড়ের বীজ,
অদম্য সাহসী, অটুট ইচ্ছার শক্তি।

তুমি -

সৃষ্টির জননী, ভালোবাসার মূর্তি,
করুণার ঝর্ণা, আশার আলোকিত দিশা।

তুমি -

নারী, তুমি নারী,
সম্ভাবনার আকাশ, স্বপ্নের অভিযান।

তুমি -

স্বাধীনতার সুর, প্রতিবাদের শিখা,
সাম্যের প্রতীক, নব প্রভাতের আশা।

তুমিই রহস্য, তুমিই সমাধান,
তুমিই প্রশ্ন, তুমিই উত্তর।
সব কিছুই তুমি, অস্তিত্ব তোমার নাম,
কল্পনার বাইরেও তুমিই অবিরাম।

Name

anglo-bengali,6,bengali-poetry,71,explore,2,know-more,29,tag-faqs,2,tag-quizzes,11,tags-common,11,you-tube,1,
ltr
item
PGDRMC | Master Question Tags & Enjoy Bengali Poems: আমার কবিতার সঙ্কলন | My Poetry Collection
আমার কবিতার সঙ্কলন | My Poetry Collection
সকল শক্তি ও দুর্বলতা এক অদৃশ্য নদীতে মিশে যায়... মৃত্যুঞ্জয়ী বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কিছু স্বপ্ন রয়ে গেল অনাগতের, শুধু এই – ক্ষমতা ও দুর্বলতার...
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjxXjQ6BdRiHR1rASvSYrUnXyxOXvgiI89qsyfWUA17QhEUOpvAtb6-WSQ1PvpV0PR8pPOrrZvBil3HLzGpAC8eJvXWqcF_7eY2OJis-69EUFISIUKUarEGvq2XkTHPeeVE3w9-b6fSSFYIbw6s76Ld0MIMXsPWEijCg77bILRiwlkcNR1_F5d0yPFckV8/s1600/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE%20%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%A8.webp
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjxXjQ6BdRiHR1rASvSYrUnXyxOXvgiI89qsyfWUA17QhEUOpvAtb6-WSQ1PvpV0PR8pPOrrZvBil3HLzGpAC8eJvXWqcF_7eY2OJis-69EUFISIUKUarEGvq2XkTHPeeVE3w9-b6fSSFYIbw6s76Ld0MIMXsPWEijCg77bILRiwlkcNR1_F5d0yPFckV8/s72-c/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE%20%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%A8.webp
PGDRMC | Master Question Tags & Enjoy Bengali Poems
https://www.pgdrmc.eu.org/2025/04/my-poetry-collection.html
https://www.pgdrmc.eu.org/
https://www.pgdrmc.eu.org/
https://www.pgdrmc.eu.org/2025/04/my-poetry-collection.html
true
2250597950626338054
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read more Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share on social media STEP 2: Click the link on your social media Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Contents