স্বপ্নের অন্ধকার
অন্ধকারে ডুবেছে স্বপ্নের নীড়,
নক্ষত্র হারিয়েছে আলোর ভীড়।
এই রাত্রি, কালো কাপড়ে ঢাকা
বিশালকার কোনো দানবের মতো
শহরকে গ্রাস করছে।
আকাশ? কোথায় আকাশ?
গ্যাসের বাতি আর নিওনের ঝলমলে আলোয়
সে ঢেকে গেছে।
তারারা কি আর স্বপ্ন দেখে?
না হয় এরা নকল তারা,
কালো রঙের ক্যানভাসে আঁকা অহংকারী কুচি।
এই শহর, এক জীবন্ত প্রাণী,
নিশ্বাস নেয় ধোঁয়ায়, আর খায় শব্দ।
কলকারখানার গর্জন, রিকশার চিৎকার,
হকারদের স্বরে সৃষ্ট এক বিশ্রী সামগ্রিকতা।
কেউ কি শোনে আর ফড়িঙের ডাক?
নাকি তাও হারিয়ে গেছে এই কংক্রিটের জঙ্গলে?
শহরের রাস্তা, কালো নদীর মতো,
গাড়ির লাইটের ঝলমলানি জল-ছায়া ঢাকা।
মানুষ চলে যেন নৈশিক জলজ প্রাণী,
চোখে অচেনা দৃষ্টি, হাতে ঝলমলে মোবাইল,
যেন কোনো আলোক-নিঃসারণকারী সামুদ্রিক সাপ।
এরা কি স্বপ্ন দেখে? না, হয়তো দেখে, কিন্তু কী দেখে?
ব্যাংকের লোড নম্বরের দুঃস্বপ্ন?
অথবা অফিসের রাজনীতির জালে জড়িয়ে যাওয়ার বিভ্রান্তি?
স্বপ্নে কি আর গ্রামের সবুজ মাঠ দেখে?
না হয়, শুধুই ঢাকার আকাশের কৃত্রিম আলোকচ্ছটা।
কিন্তু, স্বপ্ন তো অন্ধকার চায়। তারকা দেখতে চায়।
নিশীথের নিঃশব্দতা শুনতে চায়।
কোথায় সেই অন্ধকার?
এই শহরে তো শুধুই আলো, কৃত্রিম আলো, স্বার্থের আলো।
এ আলোয় কি স্বপ্নের বীজ জন্ম নেয়?
না, জন্ম নেয় অস্বস্তি, জন্ম নেয় অসম্পূর্ণতার বেদনা।
এই শহরের মানুষেরা ক্লান্ত, অতৃপ্ত। তাদের চোখের তলায় কালো রেখা।
এরা কি স্বপ্ন দেখে?
না হয়, স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সে স্বপ্নও নির্মম প্রতিযোগিতায় জর্জরিত।
এগিয়ে যাওয়ার পাগলামিতে স্বপ্নের রঙ হারিয়ে গেছে।
আমি, এই শহরেরই এক ক্ষুদ্র অংশ।
আমারও কি স্বপ্ন নেই?
আছে, কিন্তু তা কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না।
হয়তো কোনো গলির অন্ধকার কোণে,
অথবা কোনো পুরোনো বটগাছের নিচে,
শহরের ধোঁয়ায় ঢাকা পরে গেছে।
এই অন্ধকার, কোথায় পাবো এই অন্ধকার?
সেই অন্ধকার, যেখানে স্বপ্নের তারা জ্বলে,
যেখানে নিশীথের নিঃশব্দতা শুনে মনে হয় পৃথিবী থেমে গেছে,
শুধু স্বপ্নরাই জেগে আছে।
কিন্তু, না। এই শহরে সেই অন্ধকার নেই।
আছে শুধুই এই কৃত্রিম আলোর জাল।
এই আলোর রাতে কি আর কোনো কবি স্বপ্নের সনেট লিখতে পারে?
না, লিখতে পারে না।
কারণ, স্বপ্নের ভাষা এই আলো বোঝে না।
স্বপ্ন কথা বলে অন্ধকারের নিঃশব্দতায়,
তারার ঝলমলে আলোয়।
এই শহরের মানুষেরা, যেন নিজেদের স্বপ্নের কবর খুঁড়ছে,
ইটের পর ইট বিস্বাদে সাজিয়ে।
উঁচু হয়ে উঠছে অট্টালিকা,
কিন্তু নিচে নেমে যাচ্ছে স্বপ্নের মাট।
অর্থের তৃষ্ণায় পাগল, এরা ভুলে যাচ্ছে,
স্বপ্ন ছাড়া জীবন তো শুধুই পাথরের মতো শক্ত,
রোবটের মতো নিরাবেগ।
আমি কি আর এ শহরের বাইরে যেতে পারি না?
যেতে পারি। কিন্তু, কোথায় যাবো?
গ্রামেও কি আছে স্বপ্নের অন্ধকার?
না, হয়তো নেই।
সেখানেও ঢাকার আলো পৌঁছে গেছে,
হয়তো মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের আলোয়।
তাহলে কি আর কোনো আশা নেই?
না, আশা আছ।
হয়তো কোথাও,
হয়তো এই শহরেরই কোনো অন্ধ গলির কোণে,
কোনো পুরোনো বইয়ের পাতায়,
লুকিয়ে আছে স্বপ্নের একটা ক্ষুদ্র বীজ।
হয়তো আমি, অথবা তুমি, অথবা এই শহরের কোনো অচেন মানুষ,
সেই বীজটাকে খুঁজে পাব।
আর সেই বীজ থেকেই,
হয়তো, ফুটে উঠবে একটা নতুন গাছ।
একটা গাছ,
যার ছায়ায় বসে এই শহরের মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে পারবে。
স্বপ্ন দেখবে তারার আলোয়,
নিশীথের নিঃশব্দতায়।
স্বপ্ন দেখবে এই কৃত্রিম জগতের বাইরে,
আরো একটা জগতের কথা,
স্বপ্নের জগতের কথা।